দোল, রঙের উৎসব; বসন্তের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎসব। বাঙালির অন্যান্য উৎসবের মতো দোলেও মিশে রয়েছে খাওয়া-দাওয়া। তাতে মিষ্টির প্রাচুর্যতাই বেশি। দোল মানে আজও মঠ, ফুটকড়াই আর ঘি-পোয়া। স্বামী বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখায় উল্লেখ পাওয়া যায়, "সেকালে দোলে তত্ত্ব তৈরি করে আদান প্রদানের প্রথা প্রচলিত ছিল। সেই তত্ত্ব পাড়া প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি বিলোনো হত। দোল উপলক্ষে চিনির মুড়কি, মঠ, ফুটকড়াই খাওয়ার রেওয়াজ ছিল।"
মঠ: নিরেট চিনির মিষ্টি। প্রাচীন বঙ্গদেশে ছানার তেমন চল ছিল না। চিড়ে, মুড়কি, মঠ ইত্যাদি দিয়েই দেবতাকে নিবেদন করা হত। মঠ আদপে চিনির রস ছাঁচে ফেলে বানানো এক মিষ্টি। নানান রঙের ও নানান আকারের হয়ে থাকে মঠ। চিনির তৈরি উঁচু মিষ্টির ইতিহাস সুপ্রাচীন। দোল পূর্ণিমায় প্রসাদের থালায় স্থান পেত মঠ। পর্তুগিজদের হাত ধরে মঠ এসেছে বাংলায়। শোনা যায়, হুগলির ব্যান্ডেল চার্চে প্রভু যিশুর প্রসাদী থালায় প্রথম জায়গা পেয়েছিল মঠ। বাঙালি ময়রারা পরবর্তীতে একে নিজের সংস্কৃতির অঙ্গ করে তুলেছে। যা দোলের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। একেবারে প্রথমে এর নাম ছিল চিনির ছাঁচ। গির্জার আকার, আকৃতির সঙ্গে মিষ্টির আকারের মিল থাকায় মঠ নামের উৎপত্তি হতে পারে।
ফুটকড়াই: দোলমানেই ফুটকড়াই। কলাই বা মটর ভেজে, ঘন রসে ফেলে তৈরি হয় ফুটকড়াই। কালচে ভাজা কলাইয়ের উপর সাদা চিনির আস্তরণ। মুখে দিয়ে চিবোলে কড়মড় করে আওয়াজ, সঙ্গে মিষ্টি স্বাদ। বাচ্চারা বড়দের প্রণাম করলে এলে মিলত এক মুঠো মঠ-কদমা-ফুটকড়াই। এটাই ছিল বাঙালির দোলযাত্রা।
নীহাররঞ্জন বাবু ও সুকুমার সেন; দু'জনেই লিখে গিয়েছেন এককালে ছানার মিষ্টি ছিল ব্রাত্য। নিরেট চিনি বা ক্ষীরের মিষ্টিই স্থান পেতে ঈশ্বরের প্রসাদের থালায়। তার মধ্যে অন্যতম হল নকুলদানা। বৈষ্ণবপদাবলী থেকে শুরু করে চৈতন্যচরিতামৃত সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে নকুলদানা। জগন্নাথ দেবের তিনবেলার ভোগে নকুলদানার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। নকুলদানার ভিতরে ছোলা ভরা থাকলেই তার নাম হয় ফুটকড়াই। বাংলায় দোলপূর্ণিমার আগের দিন ফুটকড়াইয়ের বিশেষ চাহিদা থাকে। যদিও এককালে এর চাহিদা ছিল প্রশ্নাতীত।
শ্রীকৃষ্ণদেবের দোলযাত্রা ও চৈতন্যদেবের আবির্ভাব তিথি উপলক্ষ্যে বিভিন্ন মঠ মন্দিরে বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীরা দোলের দিনটি মহাসমারোহে উৎযাপন করেন। দোল উৎসবের প্রসাদ হিসাবে নানান ধরনের মিষ্টি জাতীয় খাবার প্রস্তুত করা হয় তার মধ্যে ফুটকড়াই বিশেষ উল্লেখযোগ্য। প্রসাদ হিসাবে ছাড়াও বুড়ির ঘর বা হোলিকা দহনের সময় নিভে যাওয়া আগুনের মধ্যে ফুটকড়াই দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। ছেলেপুলেরা লোকজ ছড়া আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া কাল আমাদের দোল বলতে বলতে ফুটকড়াই বুড়ির ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ঐতিহ্যবাহী খাবারটি ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে।
ঘি-পোয়া: উত্তর কলকাতায় দোলের এক বিশেষ মিষ্টি রয়েছে। সে মালপোয়া কূলের সম্ভ্রান্ত সদস্য। তার নাম ঘি পোয়া। ডুবন্ত ঘিয়ে ভাজা হয় বলেই এমন নাম। আজও উত্তরের মূলত বৌবাজার অঞ্চলের বেশ কিছু দোকানে এর দেখা মেলে। নবকৃষ্ণ গুঁইয়ের বেশ সুনাম আছে ঘি-পোয়া বানানোয়। ঘি-পোয়া ভেজে রাখলে, দেখে মনে হবে আলুর চপ রাখা রয়েছে। চালের গুঁড়ো, সুজি, ময়দা, আখের গুড়, মৌরী আর ঘি দিয়ে মেখে মণ্ড তৈরি করা হয়। তারপর লেচি কেটে হাতের তালুর চাপে চ্যাপটা করে গরম ঘিয়ে ভাজা হয় পোয়া।