কালী কথা: হাওড়ার মণ্ডলা কালী, আজও ষোলো আনায় মাতৃমূর্তি গড়েন পটুয়ারা

জৈষ্ঠ্য মাসের অমাবস্যা তিথিটি ফলহারিণী অমাবস্যা নামে পরিচিত। ওই তিথিতে তারাপীঠ থেকে শুরু করে দক্ষিণেশ্বর প্রতিটি মন্দিরের মহাসমারোহে দেবী কালিকার আরাধনা হয়। এমনকি বাংলার বহু কালী মন্দিরেই পূজিতা হন দেবী। তেমনই ফলহারিণী অমাবস্যার রাতে হাওড়া জেলার জগৎবল্লভপুরের অন্তর্গত পাঁতিহাল মহেশতলার শ্রী শ্রী মণ্ডলা কালীর পুজোও হয়। ঐতিহ্যবাহী মণ্ডলা কালীর আনুমানিক বয়স তিনশো বছরেরও বেশি। এই পুজো বারোয়ারি পুজো হিসেবেই চলে আসছে। পুজো উপলক্ষ্যে বিরাট মেলা বসে।

এখানের বিশেষত্ব মাতৃ প্রতিমা গড়তে যাই খরচ হোক না কেন, ষোলো আনা অর্থাৎ এক টাকার বিনিময়েই কালী প্রতিমা বিক্রি করে আসছেন প্রতিমা শিল্পী। প্রায় ৩৫০ বছর এই রীতিই চলে আসছে হাওড়ার পাঁতিহালে। যে প্রতিমায় পুজো হয় তার মূল্য ষোলআনা অর্থাৎ এক টাকা৷ জানা গিয়েছে, প্রায় ৩৫০ বছর আগে যে নিয়মে মণ্ডলা মায়ের পুজো শুরু হয়েছিল, আজও সেই একই নিয়মে পুজো চলে আসছে। বংশ পরম্পরায় আজও মৃৎশিল্পীরা ষোলো আনা অর্থাৎ এক টাকার বিনিময় প্রতিমা তৈরি করেন। যদিও আদপে এই প্রতিমা গড়তে তাদের অনেক টাকা খরচ হয়৷ কিন্তু পুজো আয়োজকদের কাছ থেকে মাত্র এক টাকাই নিয়ে থাকেন তাঁরা৷ প্রতিমা শিল্পীরা পুজো শুরু থেকে বংশ পরম্পরায় প্রতিমা গড়ে চলেছেন। মায়ের মূর্তি গড়া নিয়ে নানা রীতি, রেওয়াজ রয়েছে। পুজোর একমাস আগে বৈশাখী অমাবস্যায় মায়ের কাঠামো পুজো করা হয়। প্রতি বছর বৈশাখী অমাবস্যায় মৃৎশিল্পীরা মায়ের কাঠামোর উপর প্রথম মাটির প্রলেপ দেওয়ার কাজ আরম্ভ করতে, তারপর মূর্তি নির্মাণ শুরু হত। এই রীতি নিয়েও রয়েছে কিংবদন্তি রয়েছে। কোনও এক বৈশাখ মাসের অমাবস্যায় কালাচাঁদ রায় মামলা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। মামলা মোকদ্দমার চিন্তায় সেবার মায়ের কাঠামোর মাটি পরেনি। আদালত যাওয়ার রাস্তায় তিনি এক বালিকাকে দেখতে পান। সেই বালিকা মনে করিয়ে দেন, তখনও মায়ের কাঠামোয় মাটি দেওয়া হয়নি। একথা শুনে ফিরে এসে মায়ের গায়ে মাটি দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। ঘোষাল পরিবারের প্রিয়নাথ ঘোষালকে দিয়ে প্রতিমার কাঠামোয়ে মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়েছিল। সেই থেকে অদ্যাবধি ঘোষাল বংশের উত্তরপুরুষরাই রীতি মেনে মাটির প্রলেপ দেওয়ার কাজটি করেন। মায়ের পুজোয় তারাই তন্ত্রধারকের আসন অলংকৃত করেন। মুন্সিহাটের যতীন ভট্টাচার্য মায়ের স্বপ্নাদেশেই মায়ের পুজোয় পৌরহিত্যের কাজ সামলাতেন। আজও ভট্টাচার্যরাই মায়ের পুজো করেন। এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা সকলেই বংশপরম্পরায় দায়িত্ব সামলে যাচ্ছেন। মূর্তি গড়া থেকে পৌরহিত্য, সবই অনেকদিন ধরে চলে আসেছে, যে পরিবারের হাতে শুরু হয়েছিল তাদের বংশধরেরাই আজ একই কাজ করছেন। এমন খুব একটা দেখা যায় না।

আজও তিথি অনুযায়ী কাঠামো পুজো করে মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়। কাঠামো পুজোর তিনদিন পর শনি বা মঙ্গলবারে মায়ের কাঠামো মৃৎশিল্পীর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। তারপর তিনি যথা সময়ে মূর্তি নির্মাণ শেষ করেন। মা মণ্ডলাকে নিয়ে কিংবদন্তির অন্ত নেই। বহু বছর আগে মায়ের ঘাট থেকে খড়্গ পাওয়া গিয়েছিল। সেই খড়্গ দিয়েই একদা পুজোর বলিদান চলত, প্রথম তিনটি বলি দেওয়া হত। আজও পুজোর সময় সেই খড়্গ মন্দিরে আনা হয়। বলিদানের প্রথম তিন কোপের মাটি, দূরারোগ্য রোগ নিরাময়ের জন্য ওষুধ হিসেবে গ্ৰহণ করেন ভক্তরা।

আজ পাঁতিহাল গ্রামের প্রধান উৎসবে পরিণত হয়েছে মণ্ডলা কালীর পুজো। জনশ্রুতি অনুযায়ী, সাড়ে তিনশো বছর আগে পাঁতিহাল গ্রামের বিখ্যাত বনেদি পরিবার ঘোষালদের বাড়িতে মা পূজিতা হতেন। সেই ঘোষাল পরিবারের আরাধ্যা দেবীই আজ সার্বজনীন। সকলের মা। কথিত আছে, ঘোষালদের পরিবারের কোনও এক পূর্বপুরুষ তন্ত্র সাধনা করতেন। তন্ত্র সাধনাকে কেন্দ্র করে, পরিবারে মত বিরোধ দেখা দিলে তাদের বাড়িতে কালী পুজো বন্ধ হয়। সেই সময় গ্রামের আরেক সম্ভ্রান্ত পরিবার, রায় পরিবারের জমিদার কালাচাঁদ রায়কে মা স্বপ্নাদেশ দিলেন। কালাচাঁদ রায় অত্যন্ত ঈশ্বর বিশ্বাসী ও ধর্ম অন্ত প্রাণ মানুষ ছিলেন। দেবী তাকে স্বপ্নে, মণ্ডলা নামের একটি জায়গায়, জলাশয়ের পাশে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করতে নির্দেশ দিলেন। সেই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন তিনি। ঘোষাল পরিবারের গৃহীসাধক রামশরণ ঘোষালের সাহায্যে তিনি পঞ্চমুন্ডির আসনে জৈষ্ঠ্য মাসের ফলহারিনী অমাবস্যায় মায়ের পুজা আরম্ভ করলেন। জলাশয়টি আজ মণ্ডলা পুকুর নামেই পরিচিত। সেই থেকেই মায়ের নাম হয় মণ্ডলা কালী। একদম প্রথম দিকে মাটি এবং হোগলা পাতার ছাউনি দিয়ে নির্মিত মন্দিরে মায়ের পুজো শুরু হয়। পরবর্তী কালে রায় পরিবারের বেচারাম রায়, ১৩২২ বঙ্গাব্দ নাগাদ মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দির, মন্দিরের সামনেই প্রশস্ত নাটমন্দির, বলিদানের জায়গা, শিবরের মন্দির, মায়ের ঘাট, বাবা পঞ্চানন্দের মন্দির তৈরি হয়েছে। দেবী কালিকা এখানে সদাহাস্যময়ী, দেবীর গাত্রবর্ণ নীল, গলায় মুণ্ডমালা। বাম প্রথমে এবং ডান পা পিছনে, শবরূপী শিবের উপর দাঁড়িয়ে তিনি। দ্বিভূজা দেবী কালিকার এক হাতে রয়েছে নর মুণ্ড, অন্য হাতে কারন পাত্র। গর্ভগৃহের পঞ্চমুন্ডির আসনের উপর দারু নির্মিত সিংহাসনে বিরাজ তিনি দেবী।

মণ্ডলা কালীর মাহাত্ম্য সার্বজনবিদিত। দূর-দুরান্ত থেকে মনোবাঞ্ছা পূরণের আশায় ভক্তরা আসেন। ইচ্ছে পূরণ হলে তারা মায়ের পুজো দেন। ফলহারিণী পুজোর দিন ভক্তরা সূদুর গঙ্গা থেকে পায়ে হেঁটে গঙ্গাজল নিয়ে আসেন মায়ের জন্যে। অমাবস্যার দিন শোভাযাত্রা করে মায়ের মূর্তি আনতে যাওয়া হয়। ভক্তরাই শোভাযাত্রায় সামিল হন। মাথায় করে মায়ের মূর্তি মন্দিরে আনা হয়। সন্ধ্যায় পুকুরে স্নান সেরে দণ্ডি কাটেন অনেকেই। অমাবস্যা তিথি পড়লে, রাতে শুরু হয় মায়ের পুজো শুরু হয়, বলিদান, আরতি, ভোগ নিবেদন হয়। পরদিন ভোর বেলায় সূর্য ওঠার আগেই মায়ের মঙ্গলঘট বিসর্জন দেওয়া হয়। আষাঢ় মাসে অম্বুবাচী শেষ হাওয়ার এক সপ্তাহ পর, শনিবার দেখে মাতৃ মূর্তি বিসর্জন দেওয়া হয়। পুজো উপলক্ষ্যে অন্নকূট উৎসব হয়। মানুষের ভক্ত আর বিশ্বাস মা মণ্ডলা, গ্রামের মা হয়ে উঠেছেন। তিন শতাব্দীরও বেশি সময়ের রীতি আজও পালিত হচ্ছে একইভাবে নিষ্ঠা ভরে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...