বীরভূম জেলা বঙ্গের অন্যতম বিখ্যাত কালীক্ষেত্র। অজস্র পীঠ ছড়িয়ে রয়েছে এখানে, শক্তি আরাধনার পীঠস্থান বীরভূম শৈবক্ষেত্রও বটে। চৈত্র শিবের মাস, তাই বীরভূম শৈবতীর্থ মল্লারপুর নিয়ে আজকের আলোচনা। ঐতিহ্যবাহী গ্রাম মল্লারপুরে বিরাজ করছেন মল্লেশ্বর, যাকে কেন্দ্র করে আরও পঁচিশটি শিব মন্দির গড়ে উঠেছে এখানে। এই মন্দির পল্লীর নাম শিবগঞ্জ। আনুমানিক দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে এই মন্দিরগুলি তৈরি হয়েছিল। প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এক বিরাট চত্বরের মধ্যে বড় এক মন্দিরে বিরাজ করছেন মল্লেশ্বর শিব, অন্য মন্দিরগুলো অপেক্ষাকৃত ছোট। চারচালা রীতিতে তৈরি। প্রধান তোরণটি দ্বিতল। তোরণদ্বারের ওপর নহবতখানা রয়েছে।
মল্লারপুরের সিদ্ধেশ্বর শিবমন্দিরে বিরাজ করছেন গুপ্ত অনাদি অখণ্ড শিবলিঙ্গ। এখানে শিবলিঙ্গের বেশিটাই রয়েছে মাটির নীচে। তাই একে গুপ্ত শিবলিঙ্গ বলা হয়। ভক্তদের দাবি, এখানে শিবকে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গিয়েছে। শিবলিঙ্গ আলাদা করে এনে প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। প্রায় ৯৩০ বছর আগে ১২০২ সালে মল্লারপুরের রাজা ছিলেন মল্লেশ্বর। তিনি এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মন্দিরের গায়ে খোদিত আছে, এই মল্লেশ্বর শিবই নাকি আসলে ঋষি। তিনি তারাপীঠের দেবী তারার ভৈরব। এখানকার শিবলিঙ্গ গুপ্ত। ওপরে রয়েছে ওঁ চিহ্ন। মল্লেশ্বর শিবমন্দিরের পাশের মন্দিরেই রয়েছেন দেবী মল্লেশ্বরী বা সিদ্ধেশ্বরী। এই মল্লেশ্বর শিব মন্দিরের পিছনেই রয়েছে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের জীবন্ত সমাধি বেদী। জনশ্রুতি রয়েছে, পাণ্ডবজননী কুন্তী এখানেই মহাদেবের পুজো করেছিলেন। মহালিঙ্গেশ্বর তন্ত্রে স্বয়ম্ভূ শিবমন্দিরের তালিকায় মল্লেশ্বরের নাম রয়েছে। ভক্তদের বিশ্বাস, এখানকার শিবলিঙ্গে সাধকদের সাধনায় ওঁ চিহ্ন তৈরি হয়েছে। এই চিহ্নেই মহাদেবের তিন নয়ন রয়েছে বলে স্থানীয়দের বিশ্বাস। ভক্তদের দাবি, এখানকার শিবলিঙ্গকে ঘিরে নাকি গঙ্গা রয়েছে। যা শিবের জটাজালে বিরাজ করছে বলেই দাবি করা হয়। এই শিবলিঙ্গকে ঘিরে জলের তলায় চন্দ্রবোড়া সাপ রয়েছে বলেও দাবি করা হয়।
মল্লেশ্বর শিব মন্দিরের কাছেই একটি মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন সিদ্ধেশ্বরী দেবী, আদপে যা একটি শিলামূর্তি। সিদ্ধেশ্বরী দেবীকে মল্লেশ্বর শিবের শক্তিস্বরূপা বলা হয়। মল্লেশ্বর শিব সম্পর্কে জনশ্রুতির অন্ত নেই। প্রাচীনকালে মল্লারপুর ছিল জঙ্গলে ঘেরা। সেখানে একদা এক মেষপালকের কন্যা পদ্মিনীর সঙ্গে এক সন্ন্যাসীর মিলন ঘটে। তাঁদের সন্তান হয়, তার নাম রাখা হয় মল্লনাথ। জঙ্গলে গরু চড়াতে গিয়ে, সে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখে। একটি গরু দলছাড়া হয়ে একটি বটের ছায়ায় দাঁড়িয়ে। নিজে থেকেই সেই গরুর বৃক্ষমূল থেকে দুধ ক্ষরিত হচ্ছে। কয়েক দিন পরপর একই দৃশ্য দেখেন মল্লনাথ, তার বাবাকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি তাকে জায়গাটি খনন করতে নির্দেশ। মল্লনাথ জায়গাটি খুঁড়তে শুরু করে। ঘড়াভর্তি গুপ্তধন উদ্ধার হয়। তারপর আরও খুঁড়তে দিয়ে কোনও কিছুতে কোদালের আঘাত লেগে আগুন জ্বলে ওঠে। মল্লনাথ দৈববাণী শুনতে পান আমি জয়দ্রথ পূজিত দেব সিদ্ধিনাথ। এখানে তোমার নাম অনুসারে মল্লনাথ বা মল্লেশ্বর নামে আত্মপ্রকাশে অভিলাষী। তুমি মন্দির নির্মাণের উদ্যোগ নাও। মল্লেশ্বরের মাথায় আজও সেই কোদালের ক্ষতচিহ্ন বিদ্যমান। গুপ্তধন পেয়ে মল্লনাথ হলেন রাজা মল্লনাথ। মল্লনাথের নামানুসারে জায়গাটির নামও হল মল্লারপুর।
আরেকটি কিংবদন্তিও প্রচলিত রয়েছে, মল্লরাজের নামানুসারেই নাকি মল্লারপুরের নামকরণ হয়েছিল। কেউ কেউ বলেন, প্রাচীন মল্লভূমি অর্থাৎ বাঁকুড়ার অধীনে ছিল এই জনপদ। আবার অন্য মতে, অন্য কোনও রাজার রাজধানী ছিল মল্লারপুর। এই অঞ্চলে একদা জনজাতির বসবাস ছিল। জনজাতির এক তরুণীর সঙ্গে এক সাধকের মিলনে সর্বগুণ সম্পন্ন এক বরপুত্রের জন্ম হয়। তার নাম রাখা হয় মল্লনাথ। পরবর্তীকালে মল্লনাথই মল্লারপুর রাজ্যের প্রবর্তন করেন এবং মল্লরাজ নামে পরিচিত হন। মন্দিরের গায়ে খোদিত রয়েছে, ১১২৪ শকাব্দে ৭৭২ বিঘে জমি দান করে তিনিই মন্দির প্রতিষ্ঠা করে মল্লেশ্বর শিবের পুজো প্রচলন করেন।
সিদ্ধিনাথ শিবকে ঘিরেও একাধিক জনশ্রুতি আছে। বনবাসকালে পাণ্ডবরা যখন কাম্যক বনে অবস্থান করছিলেন, তখন দ্রৌপদীকে হরণ করতে গিয়েছিলেন জয়দ্রথ। সে সময় ভীমের হাতে অপমানিত হয়ে, এই গ্রামের পূর্ব দিকে শিবপাহাড়ি নামে এক পাহাড়ে এসে সিদ্ধিনাথ শিবের কাছ থেকে বর লাভের আশায় কঠোর তপস্যা শুরু করেন জয়দ্রথ। সিদ্ধিনাথ শিব শেষ পর্যন্ত জয়দ্রথের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে শিব তাঁকে যুদ্ধে অপরাজেয় হওয়ার বর দেন। মল্লেশ্বর শিব মন্দিরের প্রধান উৎসব হল গাজন ও শিবরাত্রি। দুই উৎসব উপলক্ষ্যেই এখানে মেলা বসে। পঁচিশে চৈত্র থেকে চৈত্র সংক্রান্তির দিন পর্যন্ত মল্লেশ্বর শিবের গাজন উৎসব হয়। উৎসব উপলক্ষ্যে প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়। স্থানীয়রা, ইচ্ছে পূরণের জন্য মল্লেশ্বর শিবের কাছে মানত করে।
আজ মল্লেশ্বর ইতিহাস আঁকড়ে পড়ে থাকা এক জনপদ। প্রাচীনকালের সমৃদ্ধ ইতিহাস আজও সে বহন করে চলেছে। হস্তিকান্ধায় রাজার হাতিশালা, মহিষকুড়ায় মহিষবাথান, মালঞ্চডাঙায় প্রমোদ উদ্যান, কেলি সরোবর, রানিপুকুর, মল্লেশ্বর দিঘি, গৌড় সরোবর রাজত্বের সাক্ষ্য দেয়। প্রচলিত ইতিহাস বলে, সরোরের পাড়েই নাকি রাজার সাতমহলা প্রাসাদ ছিল। বাইরের শত্রুর হাত থেকে রানিদের সম্ভ্রম রক্ষা করতে ওই সরোবরে সপরিবারে নৌকাডুবীতে প্রাণ বির্সজন দেন রাজা। মল্লারপুরের ঝুমরিপাড়ার ঝুমুরগান আজ লুপ্ত। নানা সময়ে একই চত্বরে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন রীতির আরও ২৪টি মন্দির। জৈন তীর্থঙ্করের মূর্তিও এখানে রয়েছে। রয়েছে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের ইচ্ছা সমাধি। পরবর্তী কালে স্থানীয় এক জমিদার কৃষ্ণরাম বসু নতুন করে নহবত খানা, সিদ্ধেশ্বরী মন্দির এবং প্রাচীর তৈরি করেন বলে জানা যায়। সবই ইতিহাস, ফেলে আসা সময়ের দলিল।
তবে মন্দিরের নহবত খানায় আজও সকাল সন্ধ্যা সানাইয়ের সুর শোনা যায়। রাজার আমল থেকে সানাইয়ের সুরে ভোগ আরতির সময় সূচিত হয়ে আসছে। আজও তার অন্যথা হয়নি। একদা সানাইয়ের সঙ্গেই নূপুরের শব্দও শোনা যেত। সানাইয়ের সুর শুনেই রানিরা পুজোর ডালি নিয়ে রাজপ্রাসাদ থেকে মন্দিরে আসতেন। তাঁদের নূপুরের শব্দে পুরোহিতেরা সজাগ হয়ে যেতেন। দরবারে বসার আগে মন্দির থেকে প্রসাদী ফুল নিতে আসতেন স্বয়ং রাজাও। আজও ভক্ত পূণ্যার্থীরা সানাইয়ের সুর শুনেই টের পান ভোগ আরতির সময় হল।