শুভ মোহনবাগান দিবস

আমির খানের ‘লগান’ সিনেমাটি প্রায় প্রত্যেকেরই দেখা। শেষ বলে যখন ভুবন ছয়টি মারল এবং শোষিত ভারতীয়দের তিন বছরের খাজনা মুকুব হল, তখন যেন ভুবনদের সঙ্গী হয়ে উঠেছিলাম আমরাও, সেই ২০০১ সালে। কিন্তু সেদিন থেকে ঠিক ৯০ বছর আগে তরুণ ১১জন বাঙালি যেভাবে ইংরেজদের খেলায় তাদেরই মাত করল তা কোনওমতেই মুক্তিযুদ্ধের থেকে কম নয়। ১৯১১ সালের আজকের দিনেই, ২৯ জুলাই, ইস্ট ইয়র্কশায়ার দলকে ২-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবার ইংরেজদের কাছ থেকে আইএফএ শিল্ড দখল করেছিল মোহনবাগানপালতোলা নৌকার সেই ঐতিহাসিক যাত্রা শুরুই হল ইতিহাসের পাতা থেকে। আর সেদিন থেকে ২৯ জুলাই পরিচয় পেল ‘মোহনবাগান দিবস’ হিসাবে। তখন ছিল বঙ্গভঙ্গের সময়। টালমাটাল ছিল বাংলার পরিস্থিতি। আর এদিকে একের পর এক ফুটবল টুর্নামেন্ট জিতেই চলেছিল ইংরেজ দলগুলি। কখনও বা ভালো খেলায়, কখনও বা নোংরা রাজনীতি করেকিন্তু ১৮৮৯ সালে তৈরি হওয়া মোহনবাগান ক্লাবের ‘ডিএনএ’তেই যেন ছিল বিশ্বজয়ের আভাস। আর তাতেই যেন সবুজ মেরুণের জন্ম। ১৯১১ সালের আইএফএ শিল্ডেও একেবারে তৈরি ছিল মোহনবাগানের ১১ জন খেলোয়াড় তথা সৈনিক। গ্রুপ লিগে একের পর এক শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠেছিল তারা। সেন্ট জেভিয়ার্সকে ৩-০, রেঞ্জার্সকে ২-১ ও রাইফেল ব্রিগেডকে ১-০ গোলে হারিয়ে সেমি-ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল টুর্নামেন্টের ফেভারিট মিডলসেক্স রেজিমেন্ট এর বিরুদ্ধে। দুই লেগের খেলায় প্রথম লেগে ড্র করার পর দ্বিতীয় লেগে ৩-০ এ জিতে ফাইনালে পৌঁছেছিল মোহনবাগান।

কিন্তু ফাইনালে ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টের মত শক্তিধর দলের বিরুদ্ধে নামার আগে চলেছিল নানা রাজনীতি। যেভাবে মোহনবাগান ক্লাব এগিয়ে চলছিল, ইংরেজ শাসকরা আশঙ্কায় ছিল শোষিতরা যেন কাপ, ঘরে তুলতে না পারে। অধিনায়ক শিবদাস ভাদুড়ির বাড়িতে হামলা থেকে শুরু করে অভিলাষ ঘোষকে চাকরি থেকে বের করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি এসেছিল বারংবার। কিন্তু তারা দমে যাননি এই ১১জন যোদ্ধা, দমে যাননি হাবুল সরকার, দমে যাননি সুধীর চ্যাটার্জি, দমে যাননি রাজেন সেনগুপ্ত। এই সমস্ত আক্রমণ, এই সকল হুমকি যেন তাদের ভেতরকার আগুনকে আরও জ্বালিয়ে দিয়েছিল। বুট পড়া ইংরেজদের বিরুদ্ধে খালি পায়ে লড়াই যেন সাঁওতালি বিদ্রোহের কথা মনে করিয়ে দেয়। সাঁওতালদের তীর ধনুকের বিরুদ্ধে ইংরেজদের আধুনিক বন্দুক। কিন্তু সাঁওতালদের লড়াইয়ে দমে গিয়েছিল ইংরেজ শাসকরা। আর তাহাই যেন অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছিল শিবদাস ভাদুড়িদের।

সেদিন ময়দানের চেহারা একেবারে অন্য, যা দেখে লজ্জায় পড়ে যেতে বাধ্য আজকের মারাকানা স্টেডিয়াম কিংবা যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন। তখন পত্রপত্রিকার অত চল ছিল না। কিন্তু যখনই ছড়িয়েছে যে একটি ভারতীয় দল আইএফএ শিল্ডের ফাইনালে ইংরেজদের টক্কর দেবে। তখন যেন ফুঁসতে থাকা গোটা বাঙালি সমাজ এসেছিল ময়দানে। আশা তাদের একটাই, ইংরেজদের বিরুদ্ধে জয়। আর ভরসা তাদের একটাই, নাম তার মোহনবাগান। প্রথমে, ফ্রিকিক থেকে গোল করে ইস্ট ইয়র্কশায়ারকে এগিয়ে দেয় জ্যাকসন। আকাশে উড়তে শুরু করে কালো পতাকা। কিন্তু তার ২০ মিনিটের মধ্যেই পেনাল্টি থেকে গোল করে সমতায় ফেরান শিবদাস ভাদুড়ি। কালো ঘুড়ির সাথে উড়তে লাগল সবুজ মেরুণ ঘুড়ি। আর খেলার শেষদিকে অধিনায়ক শিবদাস ভাদুড়ি পাসে গোল করে ইস্ট ইয়র্কশায়ার ও ইংরেজদের আধিপত্যের ঘুড়ি ‘ভোকাট্টা’ করে দেন অভিলাষ ঘোষ।

শিল্ড জয়ের ১০৮ বছরে পা রাখা মোহনবাগানের, আজও সেই একই জেদ, আজও সেই একই খিদে। সমর্থকেরা আজও নিজেদের আদরের সবুজ মেরুণ রঙকে আকাশে উড়িয়ে দেয়, আজও তারা ক্লাবের গেটে ঢোকার আগে প্রণাম করে ঢোকে। আধুনিকতার মোড়েও, মোহনবাগান আজও যেন রয়েছে ইতিহাসের কান্ডারি হিসেবে। হিন্দুশাস্ত্রে তেত্রিশ কোটি দেবতা রয়েছে এমনটা শোনাই যায়, কিন্তু মোহনবাগান সমর্থকদের কাছে ঈশ্বর সেই ১১ জন বাঙালি, যাদের জন্য আজও গর্বের সাথে মোহনবাগান দাপিয়ে বেড়ায় ভারতীয় ফুটবল ময়দানে। জিয়ো বাংলার তরফ থেকে সকল মোহনবাগান ও ফুটবল প্রেমীদের ‘মোহনবাগান দিবস’ এ  জিয়ো বাংলার তরফ থেকে রইল শুভেচ্ছা ও আন্তরিক অভিনন্দন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...