সোনালী রোদে কালো পিচের রাস্তা চিড়ে মন্থর গতিতে এগিয়ে চলেছে ট্রাম। সকাল থেকে মধ্যরাত্রি ব্যস্ত কলকাতার পথ। এই পথেই কত গল্প ছড়িয়ে রয়েছে। এই পথ সাক্ষী থেকেছে ইতিহাসের। কফি হাউস, মহাবোধি সোসাইটির রাস্তা ধরে পৌঁছনো যায় ইতিহাসের কাছাকাছি। ১/১/১ডি বঙ্কিম স্ট্রিটে আজও গল্পেরা ভিড় করে আসে।
১৯১৮। ব্রিটিশের হাতে বন্দী ভারত। প্রায় দুশো হতে চলেছে ব্রিটিশ শাসন। দেশের পরাধীনতার গ্লানি মোছাতে তরুণের দল নিজেদের জীবন বিপন্ন করে মুক্তির স্বপ্ন দেখছে। তাঁদের একজন নীহাররঞ্জন মজুমদার। বরিশালের "অনুশীলন সমিতির" সদস্য।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক। নিবাস বরিশালের কাঁচাবেড়িয়া গ্রামে। অনুশীলন সমিতির কাজ ঠিকমতো করার জন্য ডেরা বাঁধেন কলকাতায়। সমিতির কাজের পাশাপাশি প্রেসিডেন্সি কলেজের মাঠে হামিদা পালোয়ানের কাছে চলত তাঁর কুস্তি লড়ার প্রশিক্ষণ।
সমিতির সদস্যরা তাঁর ডেরায় এসে গোপন সভা করতেন। এখান থেকে চলত স্বাধীনতার স্বপ্ন বোনা। ব্রিটিশ টিকটিকি আর পুলিশের চোখে ধূলো দিতে নীহাররঞ্জন মজুমদার একটি সরবতের দোকান খোলেন। সালটা ছিল ১৯১৮। দোকানের নাম দেওয়া হয় "প্যারাডাইস"।
তখন অবশ্য সরবতই একমাত্র পণ্য ছিল না। বরিশালের ছুরি, কাঁচি, বঁটি ইত্যাদিও বিক্রি করা হতো। কলেজস্ট্রিট, সূর্যসেন স্ট্রিটের তখনকার পাইস হোটেল, মেসবাড়িতে ওইসব বঁটি, কড়াই, হাতা, খুন্তির ভালো বাজার ছিল।
বাজারে তখন সরবতের একটাই সাহেবি সংস্থা "ভিমটো"। দেশীয় বলতে ছিল খগেন্দ্র নাথ মিত্রের "প্যারাগন"। নীহাররঞ্জন মজুমদারের "প্যারাডাইস" বাঙালি হিসেবে ব্যবসায় আরও একটি নতুন নাম হিসেবে সংযোজন হয়।
খুব কম সময়ের মধ্যেই সরবতের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। উত্তর কলকাতার বনেদি পরিবারের সিরাপ আর সরবতের নতুন ঠিকানা হয়ে উঠে "প্যারাডাইস"। সাধারণ মানুষের মধ্যে তখনও দোকানে এসে সরবত খাওয়ার চল ছিল না। পরবর্তী সময়ে কলেজের ছাত্র থেকে বিপ্লবী যুবকদের আনাগোনা শুরু হয় "প্যারাডাইসে"।
শুধু বিপ্লবীদের আসা যাওয়া নয়, গোপন নথিপত্রের আদান-প্রদানও চলতো এখান থেকে। ফলে ব্রিটিশ সরকারের নজর পড়ল এই সরবতের দোকানের ওপর। এই সময়ে দোকানটি ১/এ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট থেকে উঠে এলো ১/১/১ডি বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বর্তমান ঠিকানায়। নাম হল "প্যারামাউন্ট"। বিপ্লবী সরবতওয়ালা নামে পরিচিত হয়ে ওঠলেন।
পুলিন বিহারি দাস, সত্যেন সেন ছাড়াও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুও পুলিশের টিকটিকিদের নজর এড়িয়ে এই দোকানের সরবত খেতে আসতেন। এছাড়া আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, জগদীশ চন্দ্র বসু, কাজী নজরুল ইসলাম, মেঘনাদ সাহা পরবর্তী কালে সত্যজিৎ রায়, রবি ঘোষ, জহর রায় আরও অনেক প্রখ্যাত মানুষ এই দোকানের সরবত পান করেছেন এবং এখনও পান করে চলেছেন।
"প্যারাডাইস" তথা "প্যারামাউন্টের" বিখ্যাত সরবত হল "ডাবের সরবত"। এই সরবতের রেসিপি দিয়েছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। নীহাররঞ্জন মজুমদারকে আচার্য বলেছিলেন- 'ডাবের সরবত তৈরি করিস। বেশি নয়, হালকা শাঁস রয়েছে এমন ডাব। বসিরহাটের ডাব এই ব্যাপারে ভালো। ছেলেরা ডাব খাওয়ার পর শাঁসে ফুড ভ্যালু আছে, ওটিও খেয়ে নেবে'। আজও ডাবের সরবতের জন্য এখানে বসিরহাট থেকেই ডাব আসে।
বর্তমানে ডাবের সরবত ছাড়াও তিন রকমের সরবত পাওয়া যায়। স্পেশাল ড্রিঙ্ক, ক্রিম বেসড ড্রিঙ্ক আর সিরাপ। স্পেশাল ড্রিঙ্কের মধ্যে পাওয়া যায় কোকো মালাই, পাইন অ্যাপেল মালাই, স্ট্রবেরি মালাই, রোজ মালাই, ভ্যানিলা মালাই, গ্রেপস ক্রাস আর কোল্ড কফি। এছাড়া প্যাশন ফ্রুট।
ক্রিম বেসড ড্রিঙ্কের মধ্যে রয়েছে রোজ, বানানা লেমন, অরেঞ্জ, পাইন অ্যাপেল, গ্রিন ম্যাঙ্গো, ভ্যানিলা উল্লেখযোগ্য। সিরাপের মধ্যে পাওয়া যায় রোজ, লেমন, অরেঞ্জ, গ্রিন ম্যাঙ্গো, লিচু এমনকি ট্যামারিড বা তেঁতুলের সিরাপ। পঁচিশ রকমের সরবত রোজ হাতে তৈরি করা হয়। দাম ৫০-১৫০ মধ্যে। বর্তমানে বিবাহ ও যে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে সরবত সরবরাহ করা হচ্ছে।
লম্বা সরু লেনের মতো এই দোকানে কম-বেশি মিলিয়ে জনা তিরিশের মতো লোক একসঙ্গে বসতে পারেন। দেওয়াল বিভিন্ন অ্যান্টিক জিনিস আর ছবি দিয়ে সাজানো। আজও দোকানে এসি নেই। মাথার ওপর লম্বা রডের ইলেকট্রিক ফ্যান। গদি আঁটা চেয়ার নয়, বেঞ্চ ও টেবিল। টেবিলের টপগুলোতে রয়েছে ইতালিয়ান মার্বেল। ৮ টাকা দরে কিনেছিলেন নীহাররঞ্জন মজুমদার। মালিক বদলে হয়েছেন তাঁর ছেলে মৃগেন্দ্র মজুমদার। তবে ঐতিহ্য এখনও ধরে রাখার চেষ্টা করে চলেছে প্যারামাউন্ট।
শতাব্দী প্রাচীন "প্যারামাউন্ট" সরবতে সুখ্যাতি শুধু দেশে নয়, বিদেশেও সুপরিচিত। বইপাড়ার পড়ুয়ারা ছাড়াও দেশ-বিদেশের সাধারণ মানুষ এখানে আসেন সরবতের স্বাদ নেওয়ার পাশাপাশি স্বাদেশিকতা ও ঐতিহ্যের মুখোমুখি হতে। অতীত ও বর্তমান সরবতের মতোই মিলেমিশে তৈরি করেছে "প্যারামাউন্টের" ব্র্যান্ড ইকুইটি।