মিঠে পিঠে পুলি

মিঠে পিঠে পুলি

‘পৌষ প্রখর শীতে জর্জর’। পৌষের ঘন শীতের আবহেই জমে ওঠে  পিঠে পুলির স্বাদ। কি শীতের দুপুরে  রোদে পিঠ দিয়ে, কি শীত সন্ধ্যের নিবিড় গৃহকোণে-শীত আর পিঠে জড়িয়ে থাকে অঙ্গাঙ্গীভাবে। তবে পিঠে কিন্তু একা খেয়ে মজা নেই। সবাই মিলে বসে আনন্দ করে খেলে তবেই এর স্বাদ খোলে। লোকজীবনের যেকোনও উৎসবই সবাইকে ঘিরে, সবাইকে দিয়ে, সবাইকে নিয়ে।

রবীন্দ্রনাথ ও লিখেছেন, “পৌষে খাওয়ান ডেকে মিঠে পিঠে পুলি”‘ঠাকুরমার ঝুলি’-তে আছে, “রাজপুরীতে গিয়া মানুষ রাণীকে বলিল,-' রাণীমা, রাণীমা, আজ পিটকুড়ুলির ব্রত, রাজ্যে পিটা বিলাইতে হয়। আমি লালসূতা, নীলসূতা রাঙাইয়া দি, আপনি গে আঙিনায় আলপনা দিয়া পিঁড়ি সাজাইয়া দেন, ও দাসী মানুষ যোগাড়-যাগাড় দিক”। পিঠে তাই দিয়ে খেতে হয়।

তারপর রাণী আর দাসী দুজনেই পিঠে বানাল। “ওমা! রাণী যে পিটা করিলেন,- আস্কে পিটা, চাস্কে পিটা, আর ঘাস্কে পিটা!দাসী,- চন্দ্রপুলী, মোহনবাঁশী, ক্ষীরমুরলী, চন্দনপাতা এই সব পিটা করিয়াছেন। মানুষ বুঝিল যে, কে রাণী আর কে দাসী”। আরও একটি কাহিনিতে আছে-‘ ব্রাহ্মণীটি বুদ্ধির ঘড়া, ব্রাহ্মণ বোকা অতি। কাজেই সংসারের মত কাজ ব্রাহ্মণীকেই হত করতে। ব্রাহ্মণ শুধু খেতেন বসে, ব্রাহ্মণীর হত মরতে।…… জ্বালাতন পালাতন বামনী ধান ঝাড়ে, তার তুষ ফেলে কি ধান ফেলে। এমন সময় ব্রাহ্মণ গিয়া বলিল- ‘বামনী, আজ বুঝি পিটে করবি, না?’ কুলোমুলো ফেলিয়া খ্যাংরা নিয়া ব্রাহ্মণী গর্জে উঠিল- হ্যাঁ পিটে করতেই বসেছি। চাল বাড়ন্ত হাঁড়ি খটখট- এক কড়ার মুরোদ নাই পিটাখেকোর পুত পিটা খাবে”! তারপর অনেক ঝঞ্ঝাটের দিন পেরিয়ে তারা সুখের মুখ দেখল। তখন 'রোজ- ই বামুন পিটা খায়’। সুখের সঙ্গে এভাবেই জড়িয়ে যায় পিঠের সুবাস।

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন খাদ্যরসিক। অন্যান্য প্রবাদের তুলনায় মিষ্টদ্রব্যের প্রতি তাঁর কিঞ্চিৎ দুর্বলতা ছিল। ঘরে তৈরি মিষ্টি- পিঠে পুলি ইত্যাদি তিনি খুব পছন্দ করতেন। প্রায়ই তিনি শান্তিনিকেতনের প্রাচীন শিক্ষক নেপালচন্দ্র রায়কে জিজ্ঞাসা করতেন,'কি হে, তোমাদের পৌষ-পার্বণের আর কত দেরি’? এমনই একবার জনৈকা গৃহিণী রবীন্দ্রনাথের জন্য পিঠে বানিয়ে পাঠিয়েছেন।

কয়েক দিন কেটে গেল।কবির কাছে থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,’গুরুদেব সেদিন যে পিঠে পাঠিয়েছিলাম তা  কেমন খেলেন’? রবীন্দ্রনাথ মৃদু হেসে বলেছিলেন, “নিতান্তই যখন শুনতে চাইছ তখন বলি-‘লোহা কঠিন, পাথর কঠিন আর কঠিন ইষ্টক/ তার অধিক কঠিন কন্যে তোমার হাতের পিষ্টক”

পিঠের মূল উপকরণে বাহুল্য নেই। আতপ চালের গুঁড়ো, নারকেল কোরা, খেজুরের গুড় তিল, চিনি, দুধ, ক্ষীর, তেল ও ঘি। এই উপকরণ গুলির আশ্চর্য মিশ্রণে জন্ম হয় এই দেবভোগ্য খাদ্যবস্তুটির। প্রাচীন সাহিত্যে পিঠে পায়েসের উল্লেখ আছে। যজ্ঞ শেষের চরু তো পায়েসের নামান্তর। পঞ্চদশ শতকের মনসামঙ্গল কাব্যে আছে,’মিষ্টান্ন অনেক রান্ধে নানাবিধ রস/ দুই তিন প্রকারের পিষ্টক পায়স/ দুগ্ধে পিঠা ভালো মতো রান্ধে ততক্ষণ/ রন্ধন করিয়া হৈল হরষিত মন’।দ্বিজ বংশীদাসের লেখায় পিঠের বিশদ বর্ণনা আছে- ‘কত শত ব্যঞ্জন যে নাহি লেখাজোখা/ পরমান্ন পিষ্টক যে রান্ধিছে সনকা/ ঘৃত পোয়া চন্দ্রকাইট আর দুগ্ধপুলি/ আইল বড়া ভাজিলেন ঘৃতের মিশালি/ জাতি পুলি ক্ষীরপুলি চিতলোটি আর/ মনোহরা রান্ধিলেন অনেক প্রকার’

কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের লেখায় পাই, “ঘোলে মিশাইয়া লাউ দুগ্ধ তিলে গুড় জাউ/ পিঠা  কর খিল – নারিকেল”। আরও অনেক পিঠের উল্লেখ করেছেন তিনি, “কলা বড়া মুগ সাউলি ক্ষীরমোয়া ক্ষীরপুলি/নানা পিঠা রান্ধে অবশেষে”। ‘ মৈমনসিংহ গীতিকা’র 'কাজলরেখা’-র কাহিনিতেও নানান পিঠের বিবরণ পাওয়া যায়।‘নানা জাতি পিঠা করে গন্ধে আমোদিত/ চন্দ্রপুলি করে কন্যা চন্দ্রে আকিরত/ চই চপরি পোয়া সুরস রসাল/ তা দিয়া সাজাইল কন্যা সুবর্ণের থাল / ক্ষীর পুলি করে কন্যা ক্ষীরেতে ভরিয়া/ রসাল করিল তায় চিনির ভাঁজ দিয়া’।

‘চৈতন্যচরিতামৃতে’ শচীমাতা পুত্র কে যেসব মিষ্টান্ন খেতে দিয়েছিলেন তার অন্যতম কর্পূরীপিঠা। কেশবভারতীর কাছে দীক্ষাগ্রহণের পর শ্রীচৈতন্য উপবাস করেছিলেন। উপবাসভঙ্গের সময় যেসব খাদ্যবস্তু তাঁর জন্য তৈরী হয়েছিল  সেসবের মধ্যে আছে, ’ক্ষীর পুলি নারিকেল পুলি পিঠা‘ ইত্যাদি। চন্ডীমঙ্গলকাব্যেও আছে,'মনে করি সাধ খাইতে মিঠা/ ক্ষীর নারিকেল তিলের পিঠা’।

এই সব পিঠের বেশির ভাগই আজ স্মৃতিমাত্র। কালস্রোতে ভেসে যায় কত পাকপ্রণালী। জনরুচিও যায় পাল্টে। তবু কিছু থেকেও যায়। সেদিনের রন্ধনের হুবহু পদ্ধতি না হলেও আজ যেভাবে তৈরি করা হয় সেটাই ধরা থাক উৎসাহী রসিকজনের জন্য। আর কে না জানে,  অরসিকের কাছে রস নিবেদন করতে  তীব্র আপত্তি জানিয়েছেন প্রাচীন তাত্ত্বিকেরা।

এপার বাংলা ওপার বাংলা- র পিঠে বানানোয় কিছু পার্থক্য আছে। ওপার বাংলার পিঠেয় নারকেলের ভাগ থাকে বেশি। তার সঙ্গে আছে তিল। এদিকে ক্ষীরের চল বেশি। তবে একই পিঠে এক এক পরিবারে একটু আধটু অন্যভাবে বানানো হয়। প্রবাদ আছে, “ভুলি লো ভুলি/খর জ্বালে খই আসকে/ ধিকি জ্বালে পুলি”

শুরু করা যাক আপামর গ্রামবাংলার খুব চেনা পিঠে- আসকে পিঠে দিয়ে। আসকে পিঠে কে ওবাংলায় বলে চিতই পিঠে। এই পিঠে বানানোর উপকরণ হল- চালের গুঁড়ো, সামান্য নুন, সরষের তেল, কিছুটা বেগুন সহ বেগুনের বোঁটা আর নলেন গুড়। এই পিঠে বানানোর ছাঁচ দোকানে কিনতে পাওয়া যায়। গ্যাসের ওভেনে মাটির সরা বসানোর সময় খেয়াল করে ছোট বার্ণারে বসাতে হবে। আতপ চালের গুঁড়োয় সামান্য উষ্ণ জল ও সামান্য নুন দিয়ে গোলা করতে হবে।এরপর ছাঁচে সামান্য তুষ বা চালের গুঁড়ো দিয়ে গরম হলেই ফেলে দিতে হবে।

একটা পাত্রে তেল রাখতে হবে। বেগুনের বোঁটায় তেল মাখিয়ে ছাঁচে দিয়ে চালের গোলা হাতায় করে ছাঁচে দিয়ে ঢাকনা দিয়ে দিতে হবে। ঢাকনার চারপাশে সামান্য জল দিতে হবে। গ্যাসের আঁচ যেন খুব বেশি বা কম না হয়।ঢাকনার জল শুকোলেই পিঠে তৈরি শেষ। এবার খুন্তি দিয়ে তুলে নরম খেজুরের গুড় দিয়ে পরিবেশন করতে হবে। এই চিতুই পিঠে আবার জ্বাল দেওয়া ঘন দুধে ফুটিয়ে তাতে খেজুরের গুড় দিয়ে অল্প জ্বাল দিলে হবে দুধ চিতুই পিঠে। গোপাল উড়ের গানে আছে ‘আসকে খেয়েছ যাদু ফোঁড় তো গণনি’।

ভাপা পিঠে- এই পিঠে তৈরী করতে লাগবে চালের গুঁড়ো, খেজুরের গুড়, নারকেল কোরা, সামান্য নুন ও হালকা গরম জল।

বানানোর পদ্ধতি- হালকা গরম জলে নুন মিশিয়ে সেই জলে চাঁদের গুঁড়ো এমন ভাবে মাখতে হবে যাতে খুব নরম বা শক্ত না হয়।কড়াই গ্যাসে চাপিয়ে নারকেল কোরা আর খেজুরের গুড় মিশিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে পাক দিতে হবে। এই সময় আঁচ থাকবে মাঝারি। পুর বা ছেঁই তৈরি করার সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে নারকেল ধরে না যায়। পুর আগে তৈরি করে ঠান্ডা না করলে পিঠে বানানো যাবে না।

 

MithePithePuli1

 

পুর ঠান্ডা হলে চালের গুঁড়োর মন্ড থেকে লেচি কেটে তাতে পুর ভরে আধো চাঁদের আকারে পিঠে গড়তে হবে। এরপর গ্যাসে জল ফুটতে দিয়ে তার ওপর ফুটো ফুটো থালা চাপিয়ে তার ওপর পিঠেগুলো সাজিয়ে ওপরে আর একটা থালা চাপা দিতে হবে। মিনিট দশেক পর থালা তুলে পিঠেগুলো উলটে দিতে হবে। এই ভাবে জলের ভাপে এই পিঠে হয় বলে এর নাম ভাপা পিঠে। ভাপা পিঠে পরিবেশন করতে হবে খেজুরের গুড় দিয়ে। ভাপা পিঠেও ঘন দুধে ফুটিয়ে তাতে খেজুরের গুড় দিয়ে নামিয়ে নিলে তৈরি হয় দুধ ভাপা পিঠে।

পাতপিঠে- এই পিঠে আজ বিশেষ হয় না।

উপকরণ- চালের গুঁড়ো, গুড়, নারকেল কোরা, তিল, কলাপাতা

 

MithePithePuli2

 

বানানোর পদ্ধতি- সমস্ত উপকরণগুলি একসঙ্গে মেখে কলাপাতায় সামান্য তেল বা ঘি  মাখিয়ে চালের গুঁড়ো আর নারকেল কোরা মাখা পুরটা তাতে দিয়ে পাতা মুড়ে সুতো দিয়ে বেঁধে পাতুড়ির মতো সেঁকে নিলেই তৈরি হবে পাতপিঠে।

তিলশা বা ক্ষীরশা পিঠে- মধ্যযুগের কবি বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গলের আছে,' উত্তম ক্ষীরশা দিয়ে গঙ্গাজলি নাড়ু’-র কথা।

উপকরণ- সাদা তিল, নারকেল, খেজুরের গুড়, দুধ।

 

MithePithePuli3

 

বানানোর পদ্ধতি- তিল মিহি করে বেটে নিতে হবে। গ্যাসে দুধ চাপিয়ে জ্বাল দিয়ে ঘন করার ধৈর্য বা সময় না থাকলে গুঁড়ো দুধ মিশিয়ে তাড়াতাড়ি ঘন করে নেওয়া যায়। দুধ কিছুটা ঘন হলে নারকেল কোড়া ও তিল বাটা দিয়ে ভালোভাবে পাক দিতে হবে। এই সময় গ্যাস একটু কমিয়ে খুন্তি দিয়ে কড়াই- এর নীচে পর্যন্ত ভালোভাবে নাড়তে হবে। ধরে গেলে সর্বনাশ। পাক হয়ে গেলে এলাচ গুঁড়ো দিয়ে নামিয়ে হাতের চাপে চ্যাপ্টা ক্ষীরশা বানাতে হবে।এ পিঠে আজ নিতান্তই বিরল।

দুধপুলি বা ক্ষীরপুলি- মঙ্গলকাব্যে বর্ণিত দুগ্ধপুলি বা ক্ষীরপুলি এখনও দুই বাংলাতেই খাওয়া হয়।

উপকরণ- চালের গুঁড়ো, মিষ্টি আলু সিদ্ধ, নারকেল কোড়া, খেজুরের গুড়, দুধ

 

MithePithePuli4

 

বানানোর পদ্ধতি- কড়াইয়ে জল ফুটিয়ে তাতে চালের গুঁড়ো দিয়ে নাড়াচাড়া করে, মিষ্টি আলু সিদ্ধ দিয়ে ময়দা মাখার মতো মেখে নিতে হবে।আগেই মিষ্টি আলু সিদ্ধ করে খোসা ছাড়িয়ে আঁশ সরিয়ে ভালোভাবে মিহি করে মেখে রাখতে হবে। আর একটা কড়াই গ্যাসে বসিয়ে তাতে নারকেল কোরা, খেজুরের গুড় দিয়ে ভালো মতো পাক দিয়ে পুর বানিয়ে রাখতে হবে।

এবার চালের গুঁড়ো আর মিষ্টি আলু মাখা মন্ড থেকে হাতের চাপে গোল বাটির মতো করে তাতে নারকেলের পুর ভরে পুলি গড়ে রাখতে হবে। পুলির দুই মুখ হবে সূঁচলো। এবার কড়াইতে দুধ জ্বাল দিয়ে  ঘন করে পুলিগুলো দিয়ে গুড় দিয়ে জ্বাল দিলেই তৈরি পুলিপিঠে। এই নারকেলের পুরের পুলিপিঠেতে যদি দুধ আর গুড় মিশিয়ে ক্ষীর করে পুর দেওয়া হয় তবেই হবে ক্ষীরপুলি।

চিড়ের পুলি- চিড়ের পুলিও আজ আর বিশেষ বানানো হয় না। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সহধর্মিণী মৃণালিনী দেবীর সুখ্যাতি ছিল এই পিঠে বানানোয়। রবীন্দ্রনাথেরও পছন্দের ছিল এই পিঠে।

উপকরণ- চিঁড়ে, চালের গুঁড়ো, গুড়, নারকেল, চিনির রস

 

MithePithePuli5

 

বানানোর পদ্ধতি- উষ্ণ জলে  চিঁড়ে ভিজিয়ে হাত দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে।মোটা চিঁড়ে হলে মিক্সিতে মেশাতে হবে। এবার চালের গুঁড়ো মিশিয়ে ভালোভাবে মাখতে হবে।কড়াইতে চিনি আর জল দিয়ে খুব পাতলাও না আবার ঘনও না এমন ভাবে রস তৈরি করে রাখতে হবে।এবার নারকেল কোরা আর খেজুরের গুড় দিয়ে পুর বানাতে হবে। পুর ঠান্ডা হলে চিঁড়ে ও চালের গুঁড়োর মন্ড থেকে লেচি কেটে হাতের চাপে ছোট ছোট লেচি কেটে তাতে নারকেলের পুর দিয়ে পুলি বানাতে হবে। কড়াইতে সাদা তেল গরম করে তাতে পুলিগুলো সাবধানে ভেজে নিলেই তৈরি চিঁড়ের পুলি। এবার রসে ডুবিয়ে পরিবেশন করলেই হবে।

দিনগুলি তো আর সোনার খাঁচায় বন্দি থাকে না। বয়ে যায় বেলা কখন কে জানে! তাই হারিয়ে যায় কত কিছু- হারিয়ে যায় সেই জীবনও- “সেদিন হল মানা/ আমার পেয়ারা পেড়ে আনা/ রথ দেখতে যাওয়া/ আমার চিঁড়ের পুলি খাওয়া”। শুধু রয়ে যায় স্মৃতি।।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...