পরবাসের জীবন রোজকার একঘেয়েমিতে কেমন যেন স্বাদহীন হয়ে যায় মাঝে মাঝে। কাঁচা, সেদ্ধ আর ভাজার চর্বিত চর্বন।
বদল আনতে চাই অল্প পাঁচফোড়ন। স্মৃতির ভান্ডারঘরে খোঁজ পড়ে। হাতড়ে চলি হারানো সুগন্ধের স্বাদ। জিরে, ধনে, এলাচ, মৌরির টান।
রান্নাঘরের মশলার কৌটো ভিতরে থেকে বেরিয়ে আসে ভুলে যাওয়া ভালোবাসার সম্পর্ক। খুঁজে পাওয়া পুরনো স্বাদ ভুলিয়ে দেয় দেশান্তরীর মান অভিমান।
দারচিনির মিষ্টি গন্ধে স্ট্রবেরি পাই এক নিমেষে লক্ষী পুজোর ভোগের পায়েসের আদর দিয়ে যায় খরখরে ব্যস্ত মুখে। ছোট এলাচ দাঁতের মাঝে পিষতে পিষতে মনে পড়ে এক ফালি পান মুখে দিয়ে এবারে হয়তো অলস দুপুর একটু জিরোবে যাদবপুরে। জায়ফলে নিমন্ত্রণ বাড়ির গন্ধ। বিয়ে বাড়ির রজনীগন্ধার মালা, দামি ফরাসি পারফিউম হয়ে সারা শরীরে নতুন শাড়ির মতন গর্বে মটমট করে জাফরান ভালোবাসার গোধূলিদিন!
মৃদু হাওয়ার মতন ধীরে ধীরে অবিরাম সুবাস মন ভালো করে দেয়।
শুধুই কি মশলাপাতির এলাহী বিষয় এইসব?
না, এরা কৌটোয় খুব যত্নে রাখা আদরের সম্পর্ক! কিছু নোনতা, কিছু মিষ্টি, কিছু ঝাঁঝালো, কিছু সূক্ষ!
অপক্ক রাঁধুনির রান্নাঘরে ফোড়নে দেওয়া কাঁচা লঙ্কা, অল্প কালো জিরে।
বিদেশী হাওয়ার ঝাপটা গায়ে মেখেও মনে পড়ে অনেক বছর আগে ছেড়ে আসা মায়ের রান্নাঘরখানা। এদিকে প্যানে ক্লোভসের ইন্ডিয়ান স্টোর থেকে নিয়ে আসা বরফিল ইলিশ মাছ। কালো জিরের তেলে মেশা ঝোলে একটা একটা করে মাছ ছাড়তে অদ্ভুত এক ভালো লাগা। হয়তো এক মুহূর্তের জন্যে হলেও অজানা বিদেশী আবহাওয়াতে পুরোনো চেনা গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দেয়।
শুক্তোতে আদা বাটা পড়লেই ছোটবেলার রবিবাসরীয় অবসর। চেনা গন্ধ ছুঁতে পারার একটা সুখ আছে। সেই তৃপ্তি কিছুটা বিদেশী প্রতিবেশীর সঙ্গেও ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ করে দেয় এক বাটি শুক্তো!
আদার হালকা ঝাঁঝের সঙ্গে মুখে পড়ে রাঁধুনির অজানা স্বাদ। প্রথম চেখে সেই স্বাদ ‘ডিকোড’ করা অসম্ভব! তাই দু-তিনবার আরো একটু চেয়ে খেতে হয় !
একদিকে ইউক্যালিপ্টাস অয়েল রুম ফ্রেশনরের গন্ধ, ঠিক তার পাশেই কিচেন। সেখানে রান্না হচ্ছে গোটা লবঙ্গ, ছোট এলাচ, তেজপাতা, দারচিনি দিয়ে বাসন্তী পোলাও। কোন গন্ধ কার গায়ে মিশেছে বোঝা দুষ্কর। শুধু ঘরময় উৎসব ঘোর ঘুরে বেড়ায়। দুর্গাপুজো, দেওয়ালি, দশেরা...
আমেরিকার দেশি রেস্তোরাঁগুলোতে বিদেশী গ্রাহকদের কাছে সাধারণ ইন্ডিয়ান চিকেন কারি এক ভীষণ বাহারি সুখাদ্য! চিকেন বাহবা কুড়োবার আগেই তাদের মুখে মিশে যায় গরম মশলার আন্তরিকতা। ঝালঝাল ইন্ডিয়ান কারি মুখে লেগে থাকে অনেকদিন!
স্বাদের কোনও পার্থিব সীমানা নেই সেখানে। মশলাপাতি যেন অসমাপ্ত গল্পকথা। মুখে মুখে তারা ছড়িয়ে যায় এক সীমানা ছেড়ে আরেক নতুন জায়গায়।
আজকাল হলুদ, আদা, তেজপাতা দিয়ে অল্প ফুটিয়ে বানানো COVID চা বাজারে খুব চলছে! হলুদের ঔষধি গুণাগুণ সকলের জানা হয়ে গিয়েছে গুগল থেকে। cumin সাপ্লিমেন্ট ইউএসএ-তে ইন্ডিয়ান 'হলদিকারি'র থেকেও বেশি জনপ্রিয়। ছোট এলাচ যেমন হজমশক্তি বাড়ায় তেমন লবঙ্গ অতিরিক্ত খিদে ভাব নিয়ন্ত্রণ করে। মৌরি ভেজানো জল শরীরের টক্সিক ভাব কম করে, ত্বক ভালো রাখে।
অবশ্য এতো ভেবে আমরা রোজ রান্নার মধ্যে মশলা দিই না,আর সেটাই বোধহয় স্বাভাবিক। প্রাত্যহিক ব্যবহারের সামগ্রীর মত আমাদের মশলার কদর আমাদের নিজেদের কাছেই সস্তা হয়ে যায়; রোজ মুখে পড়া গোটা দারচিনি মায়ের রান্নাকে বিরক্তিকর করে তোলে। তাই না বুঝে হয়তো খাওয়া ফেলে উঠে চলে যাওয়া সহজ এত! অথচ ইন্ডিয়ান স্টোর থেকে ১০ ডলার দিয়ে ওই একই দারচিনির প্যাকেট এখন খুব যত্নে থাকে কাচের জারে।
মায়েরা যে খাবারের থালা বেড়ে দিত তার মধ্যে সহজে ভালো রাখার কারণগুলো লেখা থাকত না।
অনেক দূর থেকে সুগন্ধি স্মৃতির মতো ‘গুড ওল্ড ইন্ডিয়ান স্পাইসেস’র তাৎপর্য বুঝতে যেন অনেক সময় লেগে গেলো গোটা বিশ্বের!
শুধু শরীর না মন ভালো রাখতে এর মশলার গন্ধের জুড়ি নেই! স্মৃতিশক্তি সুস্থ রাখতে খাবারে নুনের মতন অনেকখানি দেশি মশলা ভালোবাসার মতন ছড়িয়ে দিন! মুখরোচক হয়ে উঠবে একঘেয়ে পানসে জীবন!