আত্মার আবাহনে মিশর

দীপাবলি উৎসবের ব্যাপ্তি শুধু ভারত নয় তার প্রতিফলন ঘটে মিশর, শ্রীলংকা, মায়ানমার, ত্রিনিদাদ, টোবাগো, সিঙ্গাপুর, বাংলাদেশ সহ বেশ কিছু জায়গাতে। সরকারি ছুটির দিন হিসেবেও পালন করা হয়। সমগ্র ভারতের এক বিশেষ উৎসব যার মধ্যে শুধুই ব্রাহ্মণ নয়বৈষ্ণব, জৈন, আর্য, বৌদ্ধ, শিখ তাদের নিজেদের সংস্কার অনুযায়ী এই উৎসব এ সামিল হন। তবে এর পৌরাণিক ব্যাখ্যা যেমন আছে তেমন প্রাচীন ভারতবর্ষে কোন রাজা কিভাবে তা পালন করতেন তার উল্লেখ আমরা বিভিন্ন লেখমালা ও কিছু  সাহিত্যে পাই। মিশরে কিন্তু এই উৎসব পালনের অন্য মানে ।

                       দীপাবলির আক্ষরিক অর্থ প্রদীপের সমষ্টি। হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী ওই দিন অমাবস্যা এবং সবচেয়ে অন্ধকারতম দিন। দীর্ঘ ঐতিহ্যবাহী এই উৎসবকে অনেকে বৈজ্ঞানিক দিক দিয়ে বিশ্লেষণ করলেও মূলত মানসিক কারণ অমঙ্গল বিতাড়ন, লক্ষ্মীর আগমন, সৌভাগ্য সূচক ও আপেক্ষিক কারণ সৌন্দর্যায়ন যা বিগত বহু বছরের ঐতিহ্যও বটে। কার্তিক মাসের কৃষ্ণ ত্রয়োদশীর দিন ধনতেরাসের মধ্যে দিয়ে ৫দিন ব্যাপী যে উৎসবের সূচনা হয় তার সমাপ্তি ঘটে ভাইফোঁটা দিয়ে। এর উল্লেখ পাই স্কন্দপুরান, পদ্মপুরাণ-এ। হর্ষবর্ধন তার 'নাগানন্দ' গ্রন্থে (৭ম শতাব্দীতে) দ্বীপপ্রতিপদোৎসব (অর্থাৎ দ্বীপ = আলো, প্রতিপদ = প্রথম দিন, উৎসব=অনুষ্ঠান) উল্লেখ পাই, যেখানে নব দম্পতি প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করতো এবং রাজা হর্ষ তাদের উপহার দিতেন। কাব্যমীমাংসা গ্রন্থে  রাজশেখর (৯ম শতাব্দী) বাড়ির সৌন্দর্যায়ন ও আলোক সজ্জার রীতির কথা বলেছেন। সংস্কৃত লেখমালাতে ও তাম্রপট্টে দিওয়ালির সমার্থক শব্দ দ্বীপোৎসব, দ্বিবালীগ উল্লিখিত যা সমগ্র ভারতের বিভিন্ন রাজাও রাজবংশের অন্যতম উৎসব। রাষ্ট্রকূট রাজ ৩য় কৃষ্ণের তাম্রপট্টে দ্বীপোৎসব উল্লিখিত (১০ম শতক), ১২ শ শতকের সংস্কৃত- কন্নড সিন্ধ লেখ প্রাপ্ত হয়েছে ধারওয়াড(কর্ণাটক), থেকে। সেখানেও পবিত্র উৎসব বলে দিওয়ালি উল্লিখিত। ১৩শ শতকের কেরালার হিন্দু রাজা রবিবর্মা সংগ্রামধিরাজের রঙ্গনাথ মন্দিরের লেখার ষষ্ঠ ও সপ্তম পংক্তিতে 'দ্বীপতসভাম' এর উল্লেখ্য আছে। জৈন লেখ যা ১০ম শতকের সৌনদত্ত লেখতে এই উৎসব উপলক্ষে জিনেন্দ্রর বিশেষ দিওয়ালির উপাসনায় তেল প্রদানের কথা আছে। জ্বালোরের প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরগাত্রে সংস্কৃতে (১৩শ শতকে) দেবনাগরী তে বর্ণিত আছে যে রামচন্দ্রাচার্য দিওয়ালি উপলক্ষে নাটকের জন্য বিশাল নাট্যশালা ও স্টেজ নির্মাণ করেন।

                      বিদেশী পর্যটক আল বিরুনী (১১ শতকে) তাঁর গ্রন্থে হিন্দুদের দিওয়ালি পালনের উল্লেখ করেছেন। নিকোলো কোন্টি (১৫ শতকে) মন্দির-এ এই উৎসবের বিবরণ দিয়েছেন। পর্তুগিজ পর্যটক ডোমিঙ্গ পায়েস বিজয়নগর রাজার আতিথ্য গ্রহণকালে এই উৎসবের সাক্ষী হন যার বিবরণ তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে আছে। বিশেষভাবে কিছু মিষ্টির কথা জানা যায় যা বিজয়নগর সাম্রাজ্যের বিশেষত্ব। সম্রাট আকবর এই উৎসব মহাসমারোহে পালন করলেও ঔরঙ্গজেব নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ১৭৯৯ সালে স্যার উইলিউম জোন্স তার 'lunar year of the Hindus' লেখায় ৫দিন ব্যাপী এই উৎসবের পূর্ণ বিবরণ দিয়েছেন। 

                        ধর্মীয় তাৎপর্য হিসেবে বলা যায় যে হিন্দুরা মনে করেন রাম-সীতা বনবাস কাটিয়ে ঐদিন অযোধ্যায় ফেরেন রাবন বধ করে। দ্বাপরযুগে বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণ নরকাসুরকে বধ করেন প্রাগ্জ্যোতিষপুরে (বর্তমানে আসাম) এবং ১৬০০০ অপহৃত নারী কে মুক্ত করেন, তাই দিওয়ালির আগের দিন নরকচতুর্দশী। অনেকে লক্ষ্মীর আরাধনা করেন সমৃদ্ধির জন্য ও অলক্ষ্মী বিতাড়নে। তবে পদ্মপুরান বলে সমুদ্রমন্থনে ওই দিন লক্ষ্মীদেবী আবির্ভূত হন। আবার অন্য মতে গনেশের পূজাও হয় বিঘ্ন বিনাশক হিসেবে। পূর্ব ভারতে কালীর আরাধনা হয় অশুভ বিনাশে। জৈনরা ওই দিন মহাবীরের নির্বাণ দিবস হিসেবে পালন করেন। শিখরা গুরু হরগোবিন্দের মুক্তির দিন পালন করেন। বৌদ্ধ মতে বজ্রযান সম্প্রদIয় নেয়ারের (নেপাল অঞ্চলে) ৫দিন ব্যাপী উৎসব পালন করলেও তাদের আরাধ্যা দেবী লক্ষ্মী-গণেশ, মা কালী নয়।

            মিশরে পালিত দিওয়ালির আলোকসজ্জা, ৫ দিনের ব্যাপকতা এক কিন্তু ব্যাখ্যা ভিন্ন। খ্রিস্টপূর্ব ৩০-এ মিশরে এই উৎসবের সূচনা হয় যার উল্লেখ আমরা পাই হায়রোগ্লিফিক্স লিপির মাধ্যমে। এক্ষেত্রে আরাধ্য দেবী হলে এইসিস, যিনি মিশরের লক্ষ্মী। মিশরে ওই প্রদীপ বা আলোকসজ্জা হয় পূর্বপুরুষের আত্মা আবাহনের জন্য, ওই আলো সারা রাতব্যাপী জ্বলে তার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পছন্দের খাবারের আয়োজন হয়। গান গেয়ে এবং নানা ধরণের বাজির প্রদর্শন করে এই উৎসব পালিত হয়। তাই ব্যাখ্যা যাই থাকে না কেন একটা কথা ধ্রুব সত্য যে উৎসবের আলাদা কোনো কারণ লাগে না, লাগে সূচনা, ব্যাখ্যা আর উদ্দেশ্য, আত্মজাগরণ ও শুভ চিন্তার বিকাশ। 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...