১৯৯৪/৯৫ হবে, সে একেবারে ছোটবেলার কথা, বোধোদয় তখনও ঘটেনি, অস্পষ্ট বুলি। সিডি বা ডিভিডি তখনও চোখে দেখিনি, কিন্তু তার থেকে তিন চার গুন বড় একইরকম গোল গোল চেহারার অনেকগুলো জিনিস বাড়িতে পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। প্রথম দিন দেখে মনে হয়েছিল, আরে এটা তো কৃষ্ণের সেই সুদর্শন চক্র টা(টিভিতে ওই সময় 'শ্রীকৃষ্ণ''-র টি আর পি হাই ছিল), মাঝে একটা ছিদ্রও রয়েছে, আঙুলে নিয়ে একবার যদি বন বন করে ঘোরাতে পারি তাহলে আমিই কংস মামাকে বধ করে ফেলব! একেবারে 'বধ' করে ফেলার এই আত্মবিশ্বাসের কারণ আমার আবিস্কৃত চক্র টা শ্রীকৃষ্ণের চক্র-এর থেকেও মাপে বেশ বড়ই ছিল। অবশ্য কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সেই সাধের আত্মবিশ্বাস ভেঙে খানখান হয়ে গেল যখন দেখলাম আমার দু'আনা আঙুলে ষোল আনার সেই চক্র বনবন করে ঘোরানো তো দূরের কথা, দু'দণ্ড স্থির করে বসিয়ে রাখাই দায়। ব্যাপারটা সুবিধের না মনে হওয়ায় পেল্লায় সেই চক্র দু'হাতে ধরে ছুটলাম বাবার কাছে। দেখে শুনে বাবার মাথায় হাত। 'আমার' সুদর্শন চক্র নিয়ে বেশ বিরক্তি নিয়ে বাবার কোলে চড়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী? বাবা বললেন, 'এটা গ্রামাফোন রেকর্ড'। সেদিন নিউ মার্কেট সংলগ্ন মির্জা গালিব স্ট্রীটের 'ভাইব্রেশন'-এর সামনে দাঁড়িয়ে মনে পড়ে গেল কীভাবে আমার ছোটবেলার একটুকরো মুহূর্তের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল 'গ্রামাফোন রেকর্ড'।
মির্জা গালিব স্ট্রীটের এই 'ভাইব্রেশন' এককালে সত্যিই শহরে 'কাঁপুনি' ধরাতো। কারণ এই 'ভাইব্রেশন'ই এককালে ছিল সাধারণ শ্রোতা থেকে শুরু করে তাবড় তাবড় শিল্পীদের 'কমন' ট্রেজারি। বাছাই করা কিছু গান-বাজনা-সিনেমার কালেকশন পাওয়া যেত শুধুমাত্র এই নির্ভরযোগ্য ঠিকানাতেই। কলকাতায় বসে আন্তর্জাতিক কিছু 'মাস্টারপিস'-এর হদিশ মিলত গুড্ডু ভাইয়ের পূর্বপুরুষদের কাছেই। এইমুহূর্তে 'ভাইব্রেশন'-এর দেখভাল করেন গুড্ডু ভাই, চত্বরে 'ভাইব্রেশন'-এর থেকে 'গুড্ডু ভাই'-এর দোকান নামটাই সবার বেশি সড়্গড়, এক বাক্যে সবাই চেনে। চোখমুখ উজ্জ্বল করে সেই গুড্ডু ভাই বলছিলেন ৭-৮ দশকের কথা, "আমি তখন খুব ছোট। আমার ঠাকুরদা এই দোকান শুরু করেছিলেন, ঠাকুরদার পরে বাবা দায়িত্ব নিল, বাবার সঙ্গে আমি প্রায়ই দোকানে এসে বসতাম। দেখতাম অঞ্জন দত্ত, সুমন, নচিকেতা আরও কত গুনী মানুষ এসে কিনে নিয়ে যেতেন রেকর্ড। তখন বাছাই করা কিছু রক কনসার্টের কালেকশন শুধুমাত্র আমাদের কাছেই পাওয়া যেত। শুধু কি গান? বার্গম্যান, ফেলিনি, ত্রুফো, গোদার, কিয়োরোস্তামি, কুরোসওয়া সব 'এক সে বড় কর এক' পরিচালকের সিনেমা আমরা রাখতাম। কারোও কাছে পাওয়া যেত না। কে আগে পাবে এই নিয়ে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। তারপর আমি বড় হওয়ার সাথে সাথে সবই বন্ধ হয়ে গেল...প্রথমে গ্রামাফন রেকর্ড, ভিসিআর, ক্যাসেট, সিডি, ডিভিডি একে একে সবই যেতে দেখলাম আমি। এখনও বাড়িতে এত কালেকশন, রাখার জায়গা নেই, ভাঙাড়িতে দিলেও নেয় না। গান দিয়েই আমাদের পারিবারিক ব্যবসা শুরু হয়েছিল তাই এখন 'গান রিলেটেড' জামাকাপড়, অ্যাকসেসরিজ এর বিজনেস করি, গান টা ছাড়তে পারিনি... "।
শুধু গান নয়, গুড্ডু ভাই ছাড়তে পারেননি অনেকিছুই, ছাড়তে পারেননি পারিবারিক মূল্যবোধ, ছাড়তে পারেননি পুরনো রুচি, ভালোলাগা, ভালোবাসা। পুরনো রেকর্ড, গ্রামাফোন, সিডি এখনও মেলে 'ভাইব্রেশন'-এ। কী তার যত্নআত্তি! রাস্তার পাশে দোকানের অবস্থানে ধুলোবালি মাত্রায় একটু বেশীই, তাই ক্ষণে ক্ষণে পরিস্কার করেন পুরনো সামগ্রী। এখনও নাকি বিক্রি হয় সেসব। ন'মাসে ছ'মাসে হলেও পুরনো জিনিসের অর্ডার পান গুড্ডু ভাই। তাতেই 'দিল খুশ' তাঁর। আরও একটা বিষয় উল্লেখ করা ভীষণ দরকার, তা হল গুড্ডু ভাইয়ের বাংলার প্রতি টান, দীর্ঘদিন খিদিরপুর নিবাসী হিন্দিভাষী খাঁটি বিহারী মুসলমান হয়েও বাংলা ভাষা- সংস্কৃতি এত ভালো চেনেন বোঝেন তিনি, যা হার মানাবে 'আধুনিক' কলকাতা-বঙ্গবাসীদের।
পুরনো যা কিছু পাওয়া যায় সবকিছু ছুঁয়ে বেশ রোমাঞ্চিত হয়ে দোকান ছাড়ার আগে গুড্ডু ভাইকে বললাম সে একেবারে ছোটবেলার কথা...বলতে বলতে শুরু থেকে বলেই ফেললাম আমার সেই ছোটবেলার একটুকরো মুহূর্রতের কথা।
ও আরও একটা কথা, ছোটবেলার সেই মুহুর্তে বাবা আমায় 'গ্রামাফোন রেকর্ড' চিনিয়েছিলেন তো বটেই কিন্তু গ্রামাফোন-এর দম দিয়ে 'কলের গান' আমায় শোনাতে পারেননি তিনি এবং আক্ষেপ করে বলেছিলেন, 'গ্রামাফোন টা চলছিল না দোকানে দিলাম সারাতে, দোকানদার বলল এখন এসব উঠে গেছে একটা টেপ রেকর্ডার কিনে নিন। গ্রামাফোনটা আর সারানো হলনা।' দোকান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কী যেন ঘুরছিল মাথায়, ফের ফিরে গেলাম গুড্ডু ভাইয়ের কাছে, এক নিঃশ্বাসে বলে ফেললাম, 'একটা গ্রামাফোন নিয়ে যাব, দম দিয়ে শুনব কলের গান।'
তখন আমিও হাসছি, গুড্ডু ভাইও হাসছেন।