মাইকেল মানেই ছুটি-ছুটির টান

কলার তোলা চেক শার্ট। কালো পাতলুন। পেতে আঁচড়ানো চুল। দেখলেই মনে হবে নেয়ে খেয়ে ইস্কুলের বেঞ্চে এসে বসেছে। টরটরিয়ে কথা বলে, মিটিমিটিয়ে তাকায়। কথার মজায় হো হো হাসির হল্লা তখন গোটা ক্লাসরুম জুড়ে। নাম যে তার মাইকেল! কেন হাসবে না বন্ধুরা!

আশি নব্বইয়ের দশকে স্কুল পড়ুয়াদের আবেগের এক নাম ছিল মাইকেল। মাইকেল মানেই ছুটিছুটির টান। গ্রীষ্মের ছুটি হোক বা পুজোর ছুটি শেষ দিনটাতে বেঞ্চ আর সাদা পর্দা ঝোলানো স্কুলের হলঘরে তার আগমন ঘটত। চেয়ারের উপর কোলের মধ্যে বসত। ক্লাসরুম ভরে গেলেই খই ফুটতে শুরু করত কথার, ‘কী, সবাই ভাল আছ?’

সক্কলের অমনি উত্তর হত ‘হ্যাঁ…’।

কিন্তু কে এই মাইকেল?

এক কথা বলা পুতুলের নাম ‘মাইকেল’। আশি নব্বই দশকের বাঙালির শৈশব-বাল্যকে যে মাতিয়ে রেখেছিল নিজের কথার জাদুতে। কী করে যে সে অমন কথা বলত সেই রহস্য ভেদ করতে করতে একদিন স্কুল পেরিয়ে কলেজের পথে। মাইকেলের কথার রহস্য এক সময় সমাধানও করে ফেলত বড় বয়সের মগজ, কিন্তু তাতে মুগ্ধতা কমত না।

মাইকেলের ‘বাবা’ প্রবীর দাস। স্কুলের দিনগুলোতে তাঁর কোলেই বসে থাকতে দেখা যেত মাইকেলকে। চলত দু’জনের কথোপকথন। তাঁকে কখনও মনে হত মাইকেলের দাদা, বাবা, শিক্ষক কিংবা নিখাদ অসমবয়সী বন্ধু।

একসময় কলকাতা দূরদর্শনেও ‘ছুটি ছুটি’ বা ছোটদের জন্য অনুষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল মাইকেল। ৩০ মিনিটের শোও হত পর্দায়। মাইকেলের আসরের সঙ্গী হতে মুখিয়ে থাকত ছোটরা, বড়রাও সেই দলে।

Talking-doll-DD

মাইকেলের আসর নামে বাস্তবিক একটি শো করতেন প্রবীর দাস। অনুষ্ঠান শেষ হলে মাইকেলের সঙ্গে দেখা করতে আসত ছোটরা। হাত মেলাতে চাইত। অনেক সময় ব্যাগের ভিতর রাখা মাইকেলকে দেখে তারা কেঁদে ফেলত। ভাবত ব্যাগের মধ্যে দমবন্ধ হয়ে মাইকেল বোধহয় মরেই যাবে। শেষে তাদের বলতে হত ‘মাইকেল ঘুমিয়ে পড়েছে’ ব্যাগটা আসলে তার স্লিপিং ব্যাগ তবে শান্ত হত তারা, মাইকেল যে আসলে একটা পুতুল এটা ভাবতেই পারত না তারা। তাদের কাছে মাইকেল ছিল তাদের মতো, স্কুলে পড়ুয়া এক দস্যি খুদে।

 পুতুল-কথার এই আর্ট ফর্মকে বলা হয় ‘ভেন্ট্রিলোকুইজম’। ল্যাটিন শব্দ ‘ভেন্ট্রি’র মানে উদর এবং ‘লোকুই’ ‘বলা’। উদর বা পেট থেকে উঠে আসে শব্দ, সেভাবেই উপস্থাপিত করা হয়। বিভিন্নভাবে বদলে যায় কণ্ঠ। সেভাবেই কথোপকথন চলে একাধিক চরিত্রে।

মাইকেলের শো দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। ‘ভূতো’ নামে একটি গল্পও লিখেছিলেন তিনি মুগ্ধতা থেকে। পরবর্তী সময়ে ‘ভূতনাথ’ নামে তার হিন্দি রিমেকও হয়। অভিনয়ে ছিলেন উৎপল্ল দত্ত আর পঙ্কজ কাপুর।

Talking-doll-telefilm

পরবর্তী সময়ে সামাজিক সচেতনতা প্রসারের বিভিন্ন বার্তা শোনা যেত মাইকেলের মুখে। মাইকেলের আসরে যুক্ত হয় তার আরও এক বন্ধু। কিন্তু মাইকেল ছোটদের বড় বেশি আদরের।

প্রবীর দাসের বাবা ছিলেন ছবির দুনিয়ার মানুষ। ছবি তৈরি দেখতে দেখতে তাঁর বড় হয়ে ওঠা। তাঁর টান ছিল ম্যাজিকে। ম্যাজিশিয়নদের কৌশল আয়ত্ব আনতে চেষ্টা চলত বাড়িতে। বয়স যখন পনেরো তখন নিজেই ম্যাজিক দেখাতে শুরু করেন স্কুলের অনুষ্ঠানে। স্কাউট দলের সদস্য ছিলেন। ১৯৬৬তে একাবার সেই দলের সঙ্গেই যান সোভিয়েত সফরে। সেখানে এক সার্কাস তাঁবুতে প্রথম দেখেন কথা বলা পুতুল। অবাক হয়েছিলেন দেখে! ভেবেছিলেন পুতুল বোধহয় মেশিনে কথা বলছে। তারপর বুঝতে পারেন আসলে পুতুলের মালিক সেই শিল্পীই নানা রকম গলায় কথা বলছেন। প্রচন্ড কৌতূহল নিয়ে দেখা করেন তাঁর সঙ্গে। জিজ্ঞেস করেন মঞ্চে এমন কাণ্ড কীভাবে ঘটাচ্ছেন তিনি? 

ভারত থেকে বেড়াতে আসা কিশোরটিকে সেই শিল্পী জানান সবটাই গলার মডিউলেশনের কারসাজি। তখন ‘ভেন্ট্রিলোকুইজম’ সম্পর্কে ধারণা হয় তাঁর। কিছু বই আর পুতুলও উপহার পেয়েছিলেন রাশিয়ান পারফর্মারের কাছ থেকে।

দেশে ফিরে এসে ডুবে যান বই আর পুতুলে। রাশিয়ান ভাষায় লেখা বই পড়তে রাশিয়ান ভাষাও আয়ত্ব করেন। সেই যে শুরু হল কথা বলা পুতুলের কথা চলল দশকের পর দশক ধরে…  

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...