ভারতের মাইকেল

নব্বই এর দশক। ‘উইজ ক্রাফট ইন্টারন্যশনাল এন্টারটেইনমেন্ট’ এর প্রতিষ্ঠাতা ভিরাফ সরকারি একদিন একটা ফ্যাক্স পেলেন। ফ্যাক্সটি এসেছে মাইকেল জ্যাকসনের কাছ থেকে। খোদ এমজে’ তাঁকে ফ্যাক্স পাঠিয়েছে! ব্যাপারতা তাঁর ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। ফ্যক্সে লেখা ছিল, “মাইকেল জ্যাকসন ভারতে কনসার্ট করতে আগ্রহী। তাঁর সংস্থা কী পারবে ব্যবস্থা করে দিতে?”

মাইকেল জ্যাকসন তখন খ্যাতির তুঙ্গে। ‘গ্লোবাল স্টার’। মিউজিক চার্টে টপ রেটিং-এ সব সময় তাঁর নাম। ভিরাফ সরকারি ঠাট্টা ভেবে উড়িয়ে দিলেন মেসেজটা। দিন কয়েক পর আবার একটা ফ্যাক্স । বক্তব্য একই। এবার ধন্দে পড়লেন ভিরাফ। তিনি উত্তর পাঠালেন। লিখলেন, মাইকেল জ্যাকসন নিজে কথা বললে, উইজক্রাফট তবেই মেসেজ বিশ্বাস করবে এবং অনুরোধ রাখার কথা ভাববে।

ফ্যাক্স টা যে নিছক ঠাট্টা ছিল না, তার প্রমাণ পেলেন ভিরাফ। কিছু দিন পরই তাঁর সঙ্গে দেখা হল পপ কিং এর। মুখোমুখি। লস অ্যাঞ্জেলস এর স্টুডিওতে মাইকেল জ্যাকসনের ভারত সফর নিয়ে আলোচনায় বসলেন তাঁরা।

সঙ্গে ভিরাফ এর সঙ্গী অ্যান্ড্রে টিমিনস। ভিরাফের ভয় ছিল শেষ মুহূর্তে হয়ত বাতিল করে দিতে পারে সফর। ‘সেলিব্রিটি’ খেয়াল। কিন্তু জ্যাকসন কথা দিয়েছিলেন তাঁদের। সে কথার নড়চড় হল না।

৩০ অক্টোবর। মুম্বইয়ের মাটি ছুঁলেন মাইকেল জ্যাকসন। পপ লেজেন্ডকে একবার চোখের দেখা দেখতে ভিড়ে ভিড়াক্কার এয়ারপোর্ট। এয়ারপোর্টে পা দিয়েই উচ্ছ্বাসে পাগল ফ্যানেদের ভিড়ে মিশে গেলেন তিনি। দ্য পপ কিং। প্রায় ৫০০০ মানুষ এসেছেন বিখ্যাত পপ তারকাকে একবার চোখের দেখা দেখতে। ঢোল, ব্যান্ড, সঙ্গে মহারাষ্ট্রের স্থানীয় নাচের দল। উপস্থিত ছিলেন বলিউড অভিনেত্রী সোনালী বিন্দ্রে। তিনি তখন কেরিয়ারের মধ্য গগনে। আগুনে সুন্দরী। কমলা রঙের শাড়ী আর নাথনিতে ট্র্যাডিশনাল মহারাষ্ট্রী বেশ। আরতি, টিকায় বরণ করে নিয়েছিলেন তাঁকে। এমজে'র গাড়ির সঙ্গে বাইক র‍্যালি চলেছিল হোটেল পর্যন্ত। সফর চলাকালীন যেখানে এম জে ছিলেন।

নিজের টয়োটা থেকে বারবার বেরিয়ে এসে হাত নাড়তে হচ্ছিল তাঁকে। তাঁর যাবার পথে এত মানুষ। শুধু এক ঝলক দেখার জন্য রাস্তার দু’পাশে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে।

ভীষণ মিষ্টি খেতে ভালবাসতেন এই লেজেন্ড ফ্যানেদের সে কথা অজানা ছিল না। তাঁর জন্য হোটেলে মিষ্টি, চকলেটের বিশেষ বন্দোবস্ত করা হয়েছিল।

নভেম্বরের প্রথম দিন। মুম্বই-তে কনসার্টের আয়োজন হল। আন্ধেরি স্পোর্টস কমপ্লেক্সে। রকেট ক্যাপসুলে চেপে নাটকীয়ভাবে মঞ্চে প্রবেশ করলেন ‘এমজে’।  পরনে গোল্ডেন- ব্ল্যাক স্যুট। বিপুল দর্শকের সামনে পারফর্ম করলেন।  মাতিয়ে দেওয়া গান। কাঁপিয়ে দেওয়া পারফরমেন্স।

FotoJet (20)

কিন্তু পপ স্ম্রাটের গানের চেয়েও দর্শকদের মনে রয়ে গেল তাঁর ব্যবহার। স্টেজ আর অর্ডিয়েন্সের মাঝখানের ব্যবধানকে ভেঙ্গে দিয়েছিলেন তিনি। গায়কের সঙ্গে শ্রোতার এক হয়ে যাওয়া। কোথাও কোনও ব্যারিকেড নেই।

ভিআইপি বক্সে আশা ভোঁসলে। মাইকেলের গানের ছন্দে মেতে উঠেছেন। সঙ্গী আর এক তারকা। সুনীল গাভাস্কার। আরও একজন ছিলেন সেই ভিড়ে। উন্মাদ জনতার মাঝখানে। প্রভু দেবা।

স্পোর্টস কমপ্লেক্সের বাইরে হাজার খানেক মানুষ। তার ভিতরে ঢোকার সুযোগ পাননি টিকিটের অভাবে। দূর থেকেই খুশি থাকতে হচ্ছিল।

মাইকেল জ্যাকসনের সফর ছোট্ট ছিল। কিন্তু ভীষণভাবে দাগ কাটতে পেরেছিলেন মানুষের মনে। অনাথ শিশুদের নিয়ে টি-পার্টির আয়োজন হয়েছিল তাঁর হোটেলের রুমে। হোটেলে তাঁর সার্ভিসে যাঁরা ছিলেন তাঁদের নিয়ে এক বাসে ট্যুর করেছিলেন।

ভারত ছেড়ে যাওয়ার আগে মাইকেল তাঁর ভারতীয় ফ্যানেদের উদ্দ্যেশে একটা চিঠি লিখেছিলেন। ভীষণ অভিনব সেই চিঠি। তাজ হোটেলের যে রুমে তিনি ছিলেন সেখানের একটি বালিশের কভারে নোট লিখে রেখে গিয়েছিলেন।

ভারত, তোমায় দেখার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম সারা জীবন। তোমার সঙ্গে দেখা হল। তোমার মানুষদের সঙ্গে মিশলাম। ভাল লেগে গেল। প্রেমে পড়ে গেলাম।

এখন আমার মন খারাপ। চলে যেতে হবে আমাকে। কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি এই ভালবাসার টানেই আবার ফিরব।

তোমার ভালবাসায় আমি ডুবে গিয়েছি। দেশের আধ্যাত্মিক টান আমাদের ছুঁয়ে গিয়েছে।

তুমি সব সময় আমার কাছে ভীষণ অন্যরকম। আদরের।

আর কখনও ভারতে আসার সুযোগ তাঁর হয়নি। এক দশক আগে আজকের দিনে চিরদিনের মত থেমে যায় তাঁর কন্ঠ। গান থামিয়ে বিদায় নেন ‘কিং অফ পপ’ মাইকেল জ্যাকসন। কিন্ত সারা পৃথিবীর শ্রোতাদের কাছে আজও তিনি ‘সেনশেসন’। উন্মাদনা অটুট তাঁর জন্য। তাঁর গানের জন্য। হাজার  বিতর্কের রেশ স্পর্শ করতে পারে না সেই ভালবাসাকে।

এমজি কে নিয়ে ভারতের ছবিটাও একই।

একবারই ভারতে এসেছিলেন মাইকেল।  কিন্তু আর ফিরে আসা হয়নি।  আজ পৃথিবীর কোনও কোনও রেডিও স্টেশন তাঁর গান বন্ধ করে দিলেও এমজে এমজে-ই।  মাইকেল জ্যাকসনের মুম্বই কনসার্ট ভারতের বিনোদন জগতে ইতিহাস হয়ে আছে।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...