রালদুর্গার ব্রত

একদিন চিত্রকূট পর্বতে পাশা খেলছিলেন লক্ষ্মী আর নারায়ণ। এমন সময় এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ এল সেখানে ফুল তুলতে।নারায়ণ তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ওহে তুমি পাশা খেলতে জানো?” ব্রাহ্মণ উত্তর দিল, “হ্যাঁ জানি।”

নারায়ণ তাকে পাশা খেলায় আমন্ত্রণ জানালেন। কিন্তু শর্ত দিলেন, যদি ব্রাহ্মণ নারায়ণ খেলায় হারিয়ে দেয় তাহলে তাকে কুটে আতুর করে দেবেন। সেই শুনে দেবী লক্ষ্মী বললেন, “তুমি যদি আমাকে হারাও তাহালে মুহূর্তে ভস্ম হয়ে যাবে।” ব্রাহ্মণ তখন ভাবল ভস্ম হওয়ার চেয়ে কুটে-আতুর হওয়া ভালো।

খেলা শুরু হল। দেবী লক্ষ্মীকে সেই ব্রাহ্মণ খেলার দান বলে দিতে লাগল। কিছু সময় পর লক্ষ্মীর কাছে হার হল নারায়ণের। তখন নারায়ণ কুপিত হয়ে ব্রাহ্মণকে অভিশাপ দিলেন, “যাও এবার কুটে আতুর হয়ে পাহাড়ের নীচে রাজপথে পড়ে থাকো।” ব্রাহ্মণ তখন কেঁদে পড়ল নারায়ণের কাছে। জিজ্ঞাসা করল, “প্রভু এ থেকে মুক্তির পথ কী?”

নারায়ণ তখন বললেন, “ এদেশের রাজার মেয়ে সূর্য্যের ব্রতদাসী। সে যদি তোমায় বিবাহ করে, তবেই তোমার দুঃখ ঘুচবে।” সেই থেকে রাজপথের একধারে পড়ে থাকত ব্রাহ্মণ। রোগের জ্বালায় চলা লের ক্ষমতা সে হারিয়েছিল।  বাই তাকে ডিঙিয়ে যায়। একদিন সেই পথ দিয়েই সখীদের নিয়ে শিব পুজো করতে মন্দিরে যাচ্ছিল রাজকন্যা ইচ্ছেমতী।

ব্রাহ্মণকে দেখে পথ থেকে সরে যেতে বলল। ব্রাহ্মণ তখন তাকে বল,” সবাই আমায় ডিঙিয়ে যায়, তুমিও যাও না কেন!” রাজকন্যা তখন বলল, “সবাই ব্রাহ্মণকে ডিঙিয়ে যায় বলে আমি যাব না।” ব্রাহ্মণ বভলন, “আমি কিছুতেই নড়াচড়া করতে পারব না।”

তখন ব্রাহ্মণ শর্ত দিল, রাজকন্যা যদি তাকে বিয়ে করে তবেই সে রাজকুমারীকে রাস্তা দেবে। কুষ্ঠ আক্রান্ত ব্রাহ্মণকে বিয়ে করবে বলে তিন সত্যি করল রাজকন্যা। সে কথা আর নড়চড়ের উপায় থাকল না। সে শিবের পুজো দিতে মন্দিরে চলে গেল। রাজকন্যা ইচ্ছেমতী রাজপ্রাসাদে ফিরে এসে সেদিনই পিতাকে স্বয়ংবর সভার আয়োজন করতে বলল। রাজা মহা খুশী। রাজার মেয়ের স্বয়ংবরে দেশবিদেশ থেকে এসে পড়ল রাজপুত্র, রাজবর্গরা। ঢ্যাঁড়া শুনে সেই ব্রাহ্মণও এল সভায়। তার চলনের ক্ষ্মতা নেই। কোনও কমে গড়াতে গড়াতে সভায় উপস্থিত হল সে।

যথা লগ্নে বধূবেশে সেজে রাজকুমারী এল সভায়। তার হাতে বরমাল্য। কন্যার রূপের আলোয় ঝলমলে করে উঠল গোটা রাজ দরবার। কেউ আর চোখ ফেরাতে পারে না।

কিন্তু রাজকন্যা কারুর দিকেই তাকালো না। সোজা এসে গলায় মালা দিল সেই কুটে ব্রাহ্মণের গলায়। দরজার ধারে শুয়ে ছিল সে।

রাজকন্যার এমন কান্ডে সভা জুড়ে হইচই পড়ে গেল। রাজপুত্ররা রেগে-ক্ষেপে বেরিয়ে গেলেন। রাজা নিজেও এমন কান্ডে বনেবাসে দিলেন মেয়েকে।

অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে ইচ্ছেমতী বনে থাকেন। স্বামীর শুশ্রূষাতেই দিনের অর্ধেক কেটে যায়। এমন করে দিন কাটে। একদিন গাছের তলায় বসে আছে তারা। ইচ্ছেমতী নিজের মনে মনবে বলে, “ এক বছর ধরে সেবা করছি কিন্তু এতটুকু কূট ভালো হল না।”

এমন সময় ব্রাহ্মণ বলল, “ইচ্ছেমতী দ্যাখো তো আমার গায়ে কী পড়ল।” রাজকন্যা তাড়াতাড়ি গিয়ে দ্যাখে তার গায়ে গাছ থেকে একটা পাতা পড়েছ । পাতার মধ্যে কী সব লেখা। সে দ্যাখে, তাতে রাল দুর্গার ব্রত মাহাত্ম্য লেখা আছে।

তখন অগ্রহায়ণ মাসের অমাবস্যা আসতেই ইচ্ছেমতী সতেরো ধান। সতেরো দূর্বা, কলা গাছের মাঝপাতায় অর্ঘ্য দিয়ে, সিঁদুর চন্দন, ওড়ফুল, রক্তচন্দন, জবার মালা দিয়ে তামার টাটে রেখে প্রতিদিন তাতে জল আর ফুল দেয়। এমনি করে এক পক্ষ গেল। পূর্ণিমার দিন ষোড়শাপচারে রালদুর্গার পুজো করে সতেরোমুঠো চালের ওলিসুলি খেল।

ওমনি করে আবার পৌষ মাসের পূর্ণিমায় ঘট পেতে রালদুর্গার পুজো করল। তামার ঘটে সূর্য্যর পুজো করে সতেরো মুঠো চালের পায়েস খেলো।

মাঘ মাসে পুজো করে সতেরো মুঠো চালের দই ভাত খেলো। ফাল্গুন মাসে পুজো করে সতেরো মুঠো চালের পুলি পিঠে করে খেলো।

ফাল্গুন মাসে ওড়ফুল, জোড়াকলা, রক্তচন্দন, জবার মালা, তামার টাটে অর্ঘ্য সাজিয়ে সূর্য্যকে নিবেদন করে পাত্র জলে ভাসিয়ে দিল।

তার সামনে আবির্ভূত হলেন সূর্য্যদেব। জিজ্ঞাসা করলেন, “কী বর চাও বলো” ইচ্ছেমতী বলল, “ আমার কুটে স্বামীর চেহারা কন্দর্পের মতো হোক”। সূর্য্যদেব ‘তথাস্তু’ বলে চলে গেলেন। দেখতে দেখতে বদলে গেল কেটে ব্রাহ্মণের চেহারা।

পরের বছর অগ্রহায়ণ আসতেই আবার ব্রত পালন করতে শুরু করল ইচ্ছেমতী। ফাল্গুন মাস আসতেই জলে অর্ঘ্য ভাসাল সে। ফের দেখা দিলেন সূর্য্যদেব।

এবার বরে ইচ্ছেমতী বলল, “রাজার মতো বাড়ি-বাগান-ধন-সম্পদ-হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া দিন আমায়”। এবারও সূর্য্যদেবের কৃপায় তার সব হল।।

পরের অগ্রহায়ণ আসতেই আবার ব্রত পালন শুরু করল রাজকন্যা। এবার সে সন্তান চাইল। বিফলে গেল না তার ব্রত পালন। দষ মাস দষ দিন পর চাঁদের মতো ছেলে হল তার।

এদিকে রাজকুমারী বাবা হঠাৎ মেয়ের খোঁজে লোক লাগালেন। মেয়েকে বনবাসে দিয়ে কোনওদিন তার কোন খোঁজ নেননি রাজা। কোটাল রাজপথে বনে খোঁজ করল। কাউকে পেল না।

রাজার কাছে এসে বলল,“সেই বনে কেউ থাকে না। শুধু খুব বড় এক রাজা বাস করে।” রাজা তখন নিজেই বেরলেন মেয়ের খোঁজে। বনের মধ্যে সেই বাড়ির কাছে এসে লোককে জিজ্ঞাসা করলেন,“এ বাড়ি কার? ”তারা উত্তর দিল, “বুড়ো বামুনের।”এরপর বাগান, নহবতখানা, মন্দির, পুকুর দেখিয়ে জানতে চাইলেন “এসব কার?”

একটাই উত্তর এল, “বুড়ো বামুনের”।  তারপর রাজবাড়ি আসতেই রাজকন্যা দেখতে পেল বাবাকে। তার সব কাহিনি বলল বাবাকে। রাজা শুনে খুব আশ্চর্য হ্যে গেল। মেয়ে আর জামাইকে নিয়ে রাজপ্রাসাদে ফিরল।

মেয়ের মুখে রালদূর্গার ব্রতের কথা শুনে পুত্র সন্তানের জন্য ব্রত করল। দশমাস দশদিন পর রাণীর একটি পুত্র সন্তান হল। ছেলে বড় হল। ইচ্ছেমতীর ছেলেও বড় হল। বিয়ে হল তাদের।

পৃথিবীতে তাদের কাজ ফুরিয়েছে বলে ইচ্ছেমতী বলল, “চল এবার আমরা স্বর্গে যাই”। তারা সন্তানদের রালদুর্গার ব্রত শিখিয়ে দিল। অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন ব্রত পালন করার পর লক্ষ্মী-নারায়ণের নাম করে জলে অর্ঘ্য ভাসাল।

লক্ষ্মী নারায়ণ তাদের দেখা দিয়ে বললেন, “বল কী বর চাই তোমাদের। ”সকলে বলল, “ আমাদের পৃথিবীর সুখ-ভোগ হয়ে গিয়েছে। আমাদের স্বর্গে নিয়ে চলুন।” তখন চারদিক থেকে পুষ্পবৃষ্টি শুরু হল। স্বর্গ থেকে পুষ্পরঠেল। রথে চেপে স্বর্গযাত্রা করল তারা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...