কালী কথা: ডুয়ার্সের মেটেলি কালী

ডুয়ার্স অরণ্য আর বন্যপ্রাণের জন্য বিখ্যাত। সেখানেই রয়েছেন দেবী মেটেলি কালী। প্রায় দেড় শতাব্দী যাবৎ পূজিতা হচ্ছেন দেবী। ডুয়ার্সের অন্যতম প্রাচীন জনপদ হল মেটেলি। একদা ভুটানের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য চলত মেটেলির মাধ্যমে। ভুটানি লামাদের দু’টি বৌদ্ধ গুম্ফাও ছিল মেটেলিতে। জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় বৌদ্ধদের সঙ্গে সঙ্গে ছিল শাক্তদের আরাধনাস্থল। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এক কালীমন্দির। কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা নিয়ে নির্দিষ্ট করে কোনও তথ্য নেই। মন্দিরের বয়স প্রায় দেড়শো বছর বা তারও বেশি হতে পারে। এখনও বৈদিক রীতি মেনেই মেটেলি কালীবাড়িতে পুজো হয়। প্রায় বত্রিশ কাঠা জমির এই কালীবাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। 

একদা মেটেলি ছিল ভুটানের অধীনে। সেই সময় কোনও শাক্ত সম্প্রদায়ের মানুষ এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। পরবর্তীতে ইংরেজরা এই এলাকায় জাঁকিয়ে বসে। গড়ে ওঠে চা বাগান ও জনপদ। সেই থেকেই নিয়মিত পুজো হয়ে আসছে। বৌদ্ধ গুম্ফা দু’টির অস্তিত্ব বর্তমানে না থাকলেও কালী মন্দির তার স্বমহিমায় বিরাজমান। পরাধীন ভারতের তৎকালীন ব্রিটিশ সাহেবরা মেটেলি আসতেন মা কালীর দর্শন করতে। ১৮৬৫ সালে ব্রিটিশদের এসেছিল ডুয়ার্সের মাটিতে। সিনচুলা চুক্তির মাধ্যমে ভুটান রাজ পরিবারের দখলে থাকা ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ এলাকা নিজেদের দখলে নেয় ব্রিটিশরা। যদিও তারপর বেশ কয়েক বছর ডুয়ার্সের বিভিন্ন এলাকা ভুটান সাম্রাজ্যের দখলে ছিল। সম্ভবত সেই সময়ে ভুটানের রাজা জিগমে নামগেয়ালের আদেশে মেটেলি এলাকায় তৈরি হয়েছিল কালী মন্দির। সেই সময় টিনের তৈরি কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। পরবর্তীতে স্থানীয় বাসিন্দারা পাকা মন্দির তৈরি করেন। 

শুধুমাত্র ব্রিটিশ অথবা ভুটান রাজ পরিবার নয়, ইতিহাসের সাক্ষী এই কালীবাড়ি। মেটেলি কালীবাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছেন সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অন্যতম নেতা ভবানী পাঠক। জনশ্রুতি রয়েছে, নির্মাণের সময় খনন কাজের সময় মেটেলি কালীবাড়ির একটি অংশে গোপন সুরঙ্গ আবিষ্কৃত হয়। মনে করা হয়, সেই সুরঙ্গ ব্যবহার করে বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গল থেকে মেটেলি কালীবাড়িতে মায়ের আরাধনা করতে আসতেন স্বয়ং ভবানী পাঠক। মেটেলি কালীবাড়ি নিয়ে নানান অলৌকিক কাহিনিও শোনা যায়। কোনও এক সময় কালী পুজোর রাতে কার্তিক অমাবস্যায় ১০১টি পশুবলি হত মেটেলি কালীবাড়িতে। এখন আর পশু বলি হয় না। মানবিক কারণে এখন পুজোর উদ্যোক্তারা পশুবলি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে ফল, চালকুমড়ো বলি হয়। দেবী মূর্তি কষ্টিপাথর নির্মিত। কালী মূর্তির চোখ দুটি অপূর্ব। কালী মূর্তির মধ্যে হিন্দু এবং বৌদ্ধ সংস্কৃতির ছোঁয়া রয়েছে। মেটেলি কালী পুজো ১৫৩ বছরে পা দিয়েছে। 

লোককাহিনি অনুযায়ী, একদা ভুটানিদের আরাধ্যা দেবী, এখন মেটেলির মানুষদের পবিত্র দেবী হয়ে উঠেছে। ডুয়ার্স তথা উত্তরবঙ্গের প্রাচীন কালীপুজোগুলর মধ্যে অন্যতম হল মেটেলি কালিবাড়ির পুজো। ১৯৬৮ সালের প্রবল ঝড়ে প্রকাণ্ড এক গাছ ভেঙে পড়েছিল মন্দিরের উপর। যার জেরে মন্দিরের গম্বুজ সহ কিছু অংশ ভেঙে যায়। তারপর মন্দির নতুন করে নির্মাণ করা হয়। নির্মাণকাজে মাটি খননের প্রয়োজন পড়ে। মাটি খুড়তে গিয়ে মাটির নীচ থেকে বেরিয়ে আসে বেশ কিছু নিদর্শন এবং একটি অতি প্রাচীন বেদী। সেই বেদীর গায়ে লেখা ছিল ১২৭৮ বঙ্গাব্দ। অর্থাৎ মন্দিরের বয়স দেড়শোর বেশি। তবে, অনেকের মতে মন্দির তার চেয়েও বেশি পুরনো। মন্দিরে ১৩৩০ সাল খোদাই করা একটি খাড়াও পাওয়া গিয়েছে। মনে করা হয়, এককালে সেই খাড়া দিয়েই বলি দেওয়া হত। ১৯৮৩ সালে মন্দির চত্বর খুঁড়ে একটি সিমেন্টের পিলার পাওয়া যায়। ভয়ে সেই পিলার তোলেনি মন্দির কতৃপক্ষ। বর্তমানে সেটিকে প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। পুজোর সময় ছাড়াও সারা বছর মেটেলি কালীবাড়িতে দেশ বিদেশের বহু পর্যটক পুজো দিতে আসেন। 

দেবী মেটেলি কালী অত্যন্ত জাগ্রত বলেই পরিচিত। দূর-দূরান্ত থেকে পুজো দিতে আসেন ভক্তরা। দ্বীপান্বিতা কালীপুজোর রাতে মানুষের ঢল নামে মন্দির চত্বরে। কালীবাড়ির ঠাকুর দালানে প্রতি বছর শারদীয়া দুর্গোৎসবের আয়োজন করা হয়। রয়েছে বহু প্রাচীন জগন্নাথদেব। রথযাত্রা বের হয় মন্দিরে। জগদ্ধাত্রীও আছেন। কয়েক মাস হল মন্দিরে মা শীতলার মূর্তিও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...