১৮২২ সালে কলকাতায় আসেন ফ্রান্সেস স্যুজেনা আরচার। ফ্যানি পার্কস নামে পরিচিতি পান। তাঁর স্বামী ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনস্ত ‘রাইটার’। মানে কেরানী। মিসেস ফ্যানি তাঁর বেড়ানোর গল্প ডায়েরির পাতায় লিখে রেখেছিলেন প্রবাস জীবনের স্মৃতি হিসেবে। ফ্যানি পার্কসের দিনপঞ্জি পরবর্তীকালে বেগমস ঠাগস অ্যান্দ ইংলিশমেন ঃ দ্য জার্নালস অফ ফ্যানি পার্কস’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল।
সেখানে মিসেস ফ্যানি তাঁর চড়ক দেখার গল্প লিখেছেন
চড়কের একাধিক ছবি মিসেস ফ্যানির নজরে পড়েছিল।
এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, “ আরও কয়েকজন সাধু মাথার ওপর হাত তুলে চক্ষু উল্টে বসেছিল। একদল নীচজাতের হিন্দু বাহুর মাংসপেশি এফোঁড়-ওফোঁড় ছিদ্র করে তার ভিতর দিয়ে বাঁশের লাঠি ও লৌহশলাকা ফুঁড়ে ঢোলের বাজনার তালে তালে বীভৎস ভঙ্গিতে তাণ্ডবনৃত্য করছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ লৌহশলাকা দিয়ে জিব ফুঁড়ে বাহাদুরি দেখাচ্ছিল জনতার কাছে। কয়েকগজ দূরে তিনটি বড় বড় কাঠের খুঁটি পোঁতা ছিল। প্রায় তিরিশ ফুট লম্বা এক একটি খুঁটি তার মাথায় আড়ে একটি বা দুটি করে বাঁশ বাঁধা। যে খুঁটির মাথায় একটি বাঁশ বাঁধা তার একদিকে একটা লোক ঝুলে রয়েছে, আর একদিকের লম্বা দড়ি ধরে নিচের লোকজন খুঁটির চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে এবং উপরে ঝুলন্ত লোকটিও ঘুরছে বনবন করে।”
সেই সময় গাজন বা চড়কে অন্য সমস্ত রসকে ছাপিয়ে যেত ভয়াল রস। কালীপ্রসন্ন থেকে ফ্যানি সকলের লেখাতেই সেই গা শিরশিরে ভয়াবহতা উঠে এসেছে। পিঠে, হাতে- পায়ে, জিভে কাঁটা বেঁধা আদুল গা, গাঁজা- আফিম-সোমরসের নেশায় পিশাচের মত চোখমুখ বছর শেষের উৎসবকে ভয়াবহ করে তুলত। দুর্ঘটনাও ঘটত প্রতি বছরই।
আবার বাবু গোত্রীয় লোকজন গাজন সন্ন্যাসীদের টাকা পয়সা দিত চড়ক পীঠে চরকি পাক খাওয়ানোর জন্য। প্রক্সি দিয়ে পুণ্য অর্জনের ব্যাপার আর কী!
চৈত্র সংক্রান্তির দিন বাবু বিলাসের বহর যেত বেড়ে। বাইজী আসত ছ্যাকরা গাড়ি ভর্তি করে। তাদের পোশাক, নাচ-গানের ভঙ্গি অনেকের মতেই রুচিহীন। মধ্যবিত্ত বাঙালি বরদাস্ত করতে পারেনি। কিন্তু বহু হিন্দু ভদ্রলোক ভিড় জমাত সেসব দেখতে।
১৮৩৩ সালের ২৩ এপ্রিল ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকায় চিৎপুরের রাস্তায় এক বিশাল গাজন সং –এর শোভাযাত্রার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। সমকালীন সমাজ-রাজনীতি নিয়ে তামাশা, ধর্ম, শিক্ষাজগতের অনাচার এই সব বিষয়ে ব্যঙ্গ গান গাইতে গাইতে সংযাত্রা শহর পরিক্রমা করত। ঢাক, ঢোল কাঁসর বাজিয়ে উচ্চস্বরে গান হত। গানে অশ্লীলতা দোষ ছিল প্রবল।
হুতুমের জন্মের অনেক আগেই চড়কপুজোর বীভৎস রস নিয়ে সমকালীন পত্রিকায় সমালোচনা উঠে এসেছিল। সাহেব থেকে শুরু করে খ্রিস্টান মিশনারি সকলেই মুখ খুলেছিলেন গাজন সন্ন্যাসীদের এমন রক্তারক্তি কার্যকলাপের বিপক্ষে। তাতে অবশ্য বিশেষ কোন প্রভাব পড়েনি উন্মাদনায়।
১৮৬৫তে (ভিন্ন মত ১৮৬৩)তে ছোটলাট বিডন গাজনের ফোঁড়াফুঁড়ি-কাটাকাটি বন্ধ করতে আইন আনলেন। ইস্তাহার জারি করে চড়কের ভয়াবহ উদযাপনকে দণ্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা করলেন। সেই থেকে বাণফোঁড়া, বড়শি ফোঁড়া, কাঁটা ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায়।
তবে এখন কিছু জেলায়, গ্রামে গঞ্জে চড়ক পুজোয় কৃচ্ছসাধনের সঙ্গে কষ্টসাধন, শরীরপাতের প্রথা চালু আছে। কিন্তু তার ভয়াবহতা কিছুটা কম।
কলকাতা আর আশপাশের অঞ্চলেও ছবিটা পাল্টে গিয়েছে। গাজন এখন রুদ্র রূপ হারিয়ে কিছুটা যেন গোবেচারা গৃহস্থের চেহারা নিয়েছে। হুগলী, বর্ধমান, দক্ষিণ দিনাজপুর, বাঁকুড়া অঞ্চলে গাজনের নানা বিচিত্র রূপ দেখা যায়। পীঠস্থান ভেদে আচারে আলাদা মাত্রা যোগ হয়েছে।
বিডন স্ট্রিট পোস্ট অফিসের পাশেই ছাতুবাবু- লাটুবাবুর বাজারে উত্তরের চড়ক আয়োজন। প্রায় দু’দশক ধরে চলে আসছে। চড়কগাছ পোঁতা হয়। ঝাঁপের ভিড় জমে। দুপুরের রোদ চড়লে শুরু হয় মেলা। ঢাকের বাদ্যি ভেসে আসে। বছরের শেষের বেলায় তখন অন্যরকম গন্ধ। পাশেই সুরধনী। নদীর ঘাটে সন্ন্যাসী মানুষের ভিড়। জলের দাগে ভিজে ওঠে সিঁড়ি। পুণ্যস্নানে উন্মুখ মানুষ। সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে...
তথ্যঋণ ঃ (হুতুমপেঁচার নকশা- কালীপ্রসন্ন সিংহ, কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত- বিনয় ঘোষ)