“ শহরে কান পাতা ভার। রাস্তায় লোকারণ্য, চারদিকে ঢাকের বাদ্যি, ধূনোর ধোঁ, আর মদের দুর্গন্ধ। সন্ন্যাসীরা বাণ, দশলকি, সূতো, শোণ, সাপ, ছিপ ও বাঁশ ফুড়ে একেবারে মরিয়া হয়ে নাচতে নাচতে কালীঘাট থেকে আসচে। বেশ্যালয়ের বারাণ্ডা ইয়ারগোচের ভদ্রলোকে পরিপূর্ণ। সখের দলের পাঁচালি ও হাফআখড়াইয়ের দোহার, ওল্ডগার্ডেনের মেম্বারই অধিক- এরা গাজন দেখবার জন্য ভোরের বেলা এসে জমেছেন।...চিৎপুরের বড় রাস্তায় মেঘ কল্লে কাদা হয়- ধূলোয় ধূলো; তার মধ্যে ঢাকের গটরার সঙ্গে গাজন বেরিয়েছে।
... চড়কগাছ পুকুর থেকে তুলে মোচ বেঁধে মাথায় ঘি কলা দিয়ে খাড়া করা হয়েচে। ক্রমে রোদ্দুরের তেজ পড়ে এলে চড়কতলা লোকারণ্য হয়ে উঠল। ... এদিকে চড়কতলায় টিনের ঘুরঘুরি, টিনের মুহুরি দেওয়া তলতা বাঁশের বাঁশি, হলদে রং করা বাঁখারির চড়কগাছ, ছেঁড়া নেকড়ার তৈরি গুরিয়া পুতুল, শোলার নানা খেলনা, পেল্লাদে পুতুল, চিত্তির করা হাঁড়ি বিক্রি করতে বসেচে। একজন চড়কী পিঠে কাঁটা ফুঁড়ে নাচতে নাচতে এসে চড়কগাছের সঙ্গে কোলাকুলি কল্লে, মইয়ে করে তাকে উপরে তুলে পাক দেওয়া হতে লাগলো। সকলেই আকাশ পানে চড়কীর পিঠের দিকে চেয়ে রইলেন। চড়কী প্রাণপণে ঘুরতে লাগলো। কেবল ‘দে পাক দে পাক’ শব্দ। কারু সর্ব্বনাশ, কারু পৌষ মাস, একজনের পিঠ ফুঁড়ে ঘোরানো হচ্চে, হাজার লোক মজা দেখচেন। ”
(হুতুম পেঁচার নকশা, কালীপ্রসন্ন সিংহ)
হুতুমের লেখনীতে কলকাতার চড়ক চিত্র। হুতুম তাঁর সমকালকে সরস ব্যঙ্গ-শ্লেষে বিদ্ধ করার সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে হুজুগে বাঙালির উৎসবে মেতে ওঠার ধারাবিবরনী দিয়েছেন। সেই নকশার গায়ে যেমন বাবু বাঙালির গিলে পাঞ্জাবী থেকে উড়ে আসা আতরের খোশবাই লেগে আছে তেমনি ধুলো-ঘাম মাখা অন্তজ, মধ্যবিত্ত গায়ের গন্ধটিও প্রবল। তবে তার চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট অন্তজ নিম্নবর্গীয় মানুষের বৃত্তান্ত। তারা যেন সব বুড়ো শিবের সঙ্গী সাথী। ভয়হীন, ভানহীন ভাবে তাদের উদযাপন। নেশা, বাইনাচ, সংযাত্রা, এই সব কিছুই ছাপিয়ে যেত গাজন সন্ন্যাসীদের ভয়াবহ আত্মপীড়নের দৃশ্য।
১৮২২ সালে কলকাতায় আসেন ফ্রান্সেস স্যুজেনা আরচার। ফ্যানি পার্কস নামে পরিচিতি পান। তাঁর স্বামী ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনস্ত ‘রাইটার’। মানে কেরানী। মিসেস ফ্যানি তাঁর বেড়ানোর গল্প ডায়েরির পাতায় লিখে রেখেছিলেন প্রবাস জীবনের স্মৃতি হিসেবে। ফ্যানি পার্কসের দিনপঞ্জি পরবর্তীকালে বেগমস ঠাগস অ্যান্দ ইংলিশমেন ঃ দ্য জার্নালস অফ ফ্যানি পার্কস’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল।
সেখানে মিসেস ফ্যানি তাঁর চড়ক দেখার গল্প লিখেছেন। গল্পটা দক্ষিণ কলকাতার। কালীঘাটের গাজন সন্ন্যাসীরা কীভাবে বচ্ছরের শেষ দিনটায় মেতে উঠতেন তাই তুলে ধরেছেন। ফ্যানি লিখেছেন,
“ চড়কপূজা।। একদিন ঠিক করলাম চৈত্র সংক্রান্তির দিন কালীঘাটের মন্দির ও জাগ্রত কালী দর্শন করতে যেতে হবে। চৌরঙ্গি থেকে প্রায় মাইল দেড়েক দক্ষিণে কালীঘাটের কালী মন্দির। ঘোড়া গাড়ি করে কালীঘাট যাত্রা করলাম সন্ধ্যাবেলা। পথে এক দৃশ্য দেখলাম। উৎসবের দৃশ্য অবিস্মরণীয়। দেখলাম হাজার হাজার লোক রাস্তায় ভিড় করে রয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কীসের ভিড়?’”
উত্তরে ফ্যানি জানলেন চড়ক পুজোর জাঁক বসেছে। তার জন্যই লোকজন রাস্তায়।
কী দেখলেন ফ্যানি?
ওঁর কথায়, “ দীর্ঘ একটা কাষ্ঠদণ্ডের মাথায় হুকবদ্ধ হয়ে ঘুরপাক খাওয়া চড়কের প্রধান বৈশিষ্ট। কত রকমের লোক যে কত বিচিত্র বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে জড়ো হয়েছে সেখানে তার ঠিক নেই। তার মধ্যে সর্বপ্রথম চক্ষে দেখলাম এদেশের বৈরাগী সাধুদের। সর্বাঙ্গে তাদের ভস্ম মাখা, মাথায় লম্বা জটা, পরনে এক টুকরো কাপড় জড়ানো, প্রায় নগ্ন বললেই চলে। একজন বৈরাগী তার শীর্ণ হাত মাথার ওপর তুলে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে রয়েছে।, অসাড় হয়ে গেছে হাত ও দেহ, পাখির মতন আঙ্গুলের ধারালো লম্বা লম্বা নখগুলি হাতের পিছন থেকে বিন্ধে ফুঁড়ে বেরিয়েছে ভিতরের তেলো দিয়ে। ভগবান বিষ্ণুর কাছে মানত করার জন্য সে এই ভয়ঙ্কর ক্লেশ স্বীকার করেছে। নখগুলি প্রথমে বিদ্ধ হবার যন্ত্রণা হয় নিশ্চয়, কিন্তু পরে হাত অসাড় হয়ে গেলে আর যন্ত্রণা থাকে না। এই শ্রেণীর আত্মপীড়নদগ্ধ সকলে খুব পুণ্যবান মনে করে, কারণ ভগবানের প্রিয় পাত্র না হলে এরকম কষ্টস্বীকার করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই দেখলাম সকলে ভক্তি বিন্ত চিত্তে তার সাধুত্বের তারিফ করছে খুব।”
এরকম শুধু মাত্র একজন নয়। চড়কের দিন সন্ন্যাসীরা বিভিন্ন রকমভাবে আত্মপীড়ন করতেন। সবটাই ভোলার চেলা হবার এক রকম প্রতিযোগিতা বলা যায়। প্রসন্ন চিত্তে কে কতটা যন্ত্রণা গ্রহণ করতে পারে।
(ক্ৰমশঃ)…