মায়ের নাম, বিনয়কুমারী। ষোল বছর বয়সে সন্তানের জন্ম দিলেন। কিন্তু, ছেলেকে বুকে নেওয়ার, মুখ দেখার সুযোগ পেলেন না। মারা গেলেন ধনুষ্টঙ্কারে। জন্ম দিয়ে ভগবান বুদ্ধের মা-ও মারা গিয়েছিলেন, তাই বিনয়কুমারীর সন্তানের নাম রাখা হল, ‘বুদ্ধদেব’। মায়ের সঙ্গে ছেলের আলাপ হল না। গল্প তৈরি হল না। সত্তায় স্মৃতি রইলো না। তাই বলে কী প্রশ্ন জাগল না? জাগল, তবে পরিণত বয়সে। কেমন ছিলেন মা?
বহুকাল মায়ের দুটি স্মৃতিচিহ্ন আগলে রেখেছিলেন দিদিমা। এক, ‘মুকুল’ পত্রিকার পাতায় আঁকাবাঁকা হরফে হাতের লেখা, ‘বিনয়কুমারী’। দুই, বাবার সঙ্গে মায়ের ছবি, মা মারা যাবার পর তোলা। কিন্তু, বন্ধ চোখের কিশোরীটির ছবি দেখে বুদ্ধদেবের মনে আবাল্য কোন আলোড়ন ওঠেনি। কারণ, কিশোরীটির কাছ থেকে তিনি তো মায়ের বাৎসল্য পাননি; বরং বাৎসল্যের স্বাদ পেয়েছিলেন দিদিমা স্বর্ণলতার কাছ থেকে। দাদুকে ‘দা’ বলে সম্বোধন করলেও, দিদিমাকে ‘মা’-ই বলতেন তিনি। সেভাবেই তাঁকে চিনেছেন, সেভাবেই তাঁকে পেয়েছেন। আসলে, স্ত্রীর শোকে বাবা ভুদেবচন্দ্র সন্ন্যাস নিয়ে গৃহত্যাগ করেছিলেন। ফলে, জন্মের পর থেকেই বুদ্ধদেবের সব ভার এসে পড়েছিল দাদু ও দিদিমার ওপরেই। তাঁরা অবশ্য বুদ্ধদেবের কোন অভাব রাখতে চাননি। কিন্তু, কোন অভাব কী সত্যিই রইলো না?
বুদ্ধদেব তখন বালক। বিনয়কুমারীর ছবিটি স্থান পেল স্বর্ণলতার ঠাকুর ঘরে। রোজই তা বুদ্ধদেবের চোখে পড়ে। তবু ছবিটির সঙ্গে তাঁর কোন আত্মীয়তা তৈরি হল না। ছবি, কেবলই ছবি হয়ে রইল। ইতিমধ্যে বাবা ঘরে ফিরলেন সন্ন্যাস ছেড়ে। ছেলের সঙ্গে আলাপ হল। কিন্তু, কোন আবেগ তৈরি হল না। আত্মীয়তা হল না। সম্পর্ক তৈরি হল না। চারপাশে বন্ধু-আত্মীয়দের বাপ-ছেলের স্বাভাবিক সম্পর্ক দেখেও বাবাকে ‘বাবা’ বলে ডাকতে ইচ্ছে হল না বুদ্ধদেবের। এমনকি, না-ডাকতে পারাটাকে অস্বাভাবিক বলেও মনে হল না। হয়তো, এর জন্য বাবার নিঃস্পৃহতাও দায়ী। হয়তো প্রব্রজ্যা থেকে সংসারে ফিরে যে এসেছিল, সে 'বাবা' ভুদেবচন্দ্র নয়, 'মনমরা' একটা মানুষ! বাবা ও মায়ের প্রতি বুদ্ধদেবের এই আবেগহীনতার মূলে হয়তো কিছুটা উদাসীনতা আছে, আছে কিছুটা না-পাওয়ার অভিমান। আর এই না-পাওয়ার জন্য তাঁর শিশুমন হয়তো এঁদের দুজনকেই দায়ী করত। হয়তো!
আবর্তিত পৃথিবীর বাতাসে ধীরে ধীরে বুদ্ধদেবের বয়স বাড়ল। ছবিরও। তাতে ধুলো জমল। পোকার কারিকুরিতে ছায়াছবি আবছা হল, হল বিবর্ণ। অনেকবার বাসা-বদল হল। বাসা-বদলের দোলায় অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। ছবিটাও একদিন হারিয়ে গেল। আর হারিয়ে যেতেই বুকের ভেতরটায় যেন একটা শূন্যতা টের পেলেন বুদ্ধদেব! ছবিটা তাহলে শুধুই ছবি ছিল না, একজনের অস্তিত্বও ছিল! বুকের ভেতরে। কিছু না-থাকার মধ্যেও তাহলে অনেক কিছুই ছিল! আশৈশব উদাসীনতাটাও তাহলে সত্যি ছিল না! যেটা ছিল, তা হল, সন্তানের কাছে মাকে পরতে পরতে চিনিয়ে দেওয়ার চেষ্টার অভাব। আসলে, মেয়েকে অকালে হারিয়ে দিদিমা কোনদিনই তাঁর স্মৃতির ঝাঁপি খুলতে পারেননি। বুদ্ধদেবও ক্ষত খুঁড়ে মায়ের কথা জানতে চাননি। কেন চাননি!—এই খেদ যত বয়স বেড়েছে বুদ্ধদেবকে তাড়িত করেছে। তাই বেলাশেষে ‘আমার ছেলেবেলা’ বইটির এক জায়গায় তিনি লিখেছেন—‘...মাঝে মাঝে মনে পড়ে ছবিটিকে, সেটি হারিয়ে গেছে বলে ঈষৎ যেন দুঃখও হয়। আমার কৌতূহল মেটাবার জন্য কেউ যখন আর বেঁচে নেই, তখন আমার জানতে ইচ্ছে করছে সে কেমন ছিল—আমার নাতনীর বয়সী ঐ না-দেখা মেয়েটি; কেমন ছিল সে দেখতে, কেমন পছন্দ-অপছন্দ ছিল তার, বই পড়তে ভালবাসত কিনা, আমার মধ্যে তার কোন-একটি অংশ কি কাজ করে যাচ্ছে? মনে হয়, আমাকে জন্ম দেবার পরিশ্রমে যে-মেয়েটির মৃত্যু হয়েছিল, তার কিছু প্রাপ্য ছিল আমার কাছে, তা দেবার সময় এখনও হয়তো পেরিয়ে যায়নি।’ সত্যি বলতে কি, সময় পেরিয়েই যায়। দেনাপাওনার খতিয়ানও অমীমাংসিত থেকে যায়। কিন্তু, মা-ছেলের সম্পর্কের যে মায়া, সেই 'মায়া' শুধু চিরকাল রয়ে যায়।