শরীরে থাবা বসিয়েছে বয়স। দুই হাঁটু প্রতিস্থাপন হওয়ার পর থেকে লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারে না। বার্ধক্যজনিত ব্যাধিতেও ভুগতে হয় তবু দিনের রুটিন বদল ঘটে না তাঁর।
ঘড়ির কাঁটা ভোর চারটের ঘর ছুঁলেই ঘুম ভেঙে যায় ৯৩ বছরের চিলুকুরি সন্তাম্মার। তার পর থেকে নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। নিজে হাতের দিনের প্রয়োজনীয় কাজ আর প্রাতরাশ সেরেই রওনা হয়ে যান।
লাঠিতে ভর করে ৬০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে পৌঁছে যান সেঞ্চুরিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে। অন্ধ্রপ্রদেশের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ছ’ বছর ধরে তিনি পদার্থবিদ্যার অধ্যাপিকা।
গত সাত দশক ধরে তাঁর অধ্যাপিকার জীবন। আজও বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার আগে ছাত্রছাত্রীদের জন্য নোটস তৈরি করায় কোনওদিন ফাঁক পড়ে না। তারা চিলুকুরি সন্তাম্মার ক্লাসের অপেক্ষায় থাকে প্রতিদিন।
নিজের বাড়ি থেকে সেঞ্চুরিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে দৈনিক প্রায় ৬০ কিলোমিটার পথ পেরোতে হয় অধ্যাপিকাকে। এই দীর্ঘপথের ধকল শারীরিকভাবে ক্লান্ত করলেও তাঁর মন ও মগজকে ক্লান্ত করতে পারেনি কোনওদিন। তাঁর ছাত্রছাত্রীদের ভাষায়, ‘সন্তাম্মা পদার্থবিদ্যার চলমান এনসাইক্লোপেডিয়া’।
সন্তাম্মার জীবন তাদের কাছে অনুপ্রেরণা। নিজের ছাত্রীজীবনে তিনি ছিলেন মেধা উজ্জ্বল প্রতিভা। পড়াশোনা চালিয়ে যেতে অপরিসীম পরিশ্রম করতে হয়েছিল। ১৯২৯ সালের ৮ মার্চ মছলিপত্তনমে জন্ম তাঁর। পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছিলেন। কাকার কাছে মানুষ।
বিশাখাপত্তনমের এভিএন কলেজের পড়াশোনা শেষ করার পর অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় সাম্মানিক-সহ স্নাতক হন। কলেজে পড়ার সময়ই ১৯৪৫ সালে মহারাজা বিক্রম দেও-র হাত থেকে পদার্থবিদ্যায় স্বর্ণপদক সম্মান পেয়েছিলেন।
মাইক্রোওয়েভ স্পেকট্রোস্কপিতে ডিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন সন্তাম্মা। সেই সময় ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক, গবেষকদের কাছে এই ডিগ্রি ছিল পিএইচডি-র সমান।
ডিএসসি ডিগ্রি শেষ করার পর অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় লেকচারার হিসাবে কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯৫৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ অফ সায়েন্সে যোগ দেন তিনি।
বর্ণময় তাঁর কর্মজীবন। লেকচারার, অধ্যাপিকার ভূমিকা যেমন পালন করেছেন তেমনি পকেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দফতরে অনুসন্ধানকারী আধিকারিক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে রিডার হিসাবেও দেখা গিয়েছে তাঁকে।
কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (সিএসআইআর), বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং ডিপার্টমেন্ট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (ডিএসটি)-তে অনুসন্ধানকারী দলের নেতৃত্বও দিয়েছেন সন্তম্মা।
মেধা আর প্রজ্ঞা তাঁকে স্থিতধী করেছে। বাহুল্যবর্জিত সহজ বেঁচে থাকায় তাঁর বিশ্বাস। আজও তিনি থাকেন ভাড়াবাড়িতে। নিজের বসত বাড়িটি বিবেকানন্দ মেডিক্যাল ট্রাস্ট নামে এক সংগঠনকে দান করেছেন। বিশাখাপত্তনমের দরিদ্র মানুষদের যাতে স্বল্প মূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান করে ওই ট্রাস্ট।
সরকারী নিয়ম অনুযায়ী ১৯৮৯ সালে ৬০ বছর বয়সে অধ্যাপিকার চাকরি থেকে অবসর নেন সন্তাম্মা। কিন্তু ক্লাসরুম, ব্ল্যাকবোর্ড আর ছাত্রছাত্রী তাঁর নেশা। খাতায় কলমে তাই অবসর নিতে হলেও অবসর তিনি নেননি। সে সময় থেকে গবেষণার কাজে মনোনিবেশ করেন। এক সময় অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক লেকচারার হিসাবে যোগ দেন। অবসরের পর অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ছ’বছর কাজ করেছিলেন সন্তাম্মা।
তাঁর নিজের কথায়, আজও তিনি প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছ’টা করে ক্লাস নিতে পারেন। ক্লান্তি লাগে না তাঁর।তিনি মনে করেন সময় জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাদানে অফুরান কর্মক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। সেটাই তিনি সবসময় মেনে চলেন’। ছাত্রছাত্রীদের কাছে তিনি নিয়মানুবর্তিতার আদর্শ।
দেশের পাশাপাশি আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা এবং স্পেনের নানা সেমিনারেও অংশ নিয়েছেন সন্তাম্মা। অ্যাটমিক স্পেকট্রোস্কপি এবং মলিকিউলার স্পেকট্রোস্কপি নিয়ে তাঁর বিশ্লেষণ আন্তর্জাতিক সম্মান পেয়েছে।
এই বয়সেও নিজেকে কী ভাবে কর্মক্ষম রেখেছেন সন্তাম্মা?
সন্তাম্মা জানান তাঁর মা বনযক্ষাম্মা ১০৪ বছরে প্রয়াত হন। বয়স আসলে আমাদের মনের ধারণা। আসল ধনের খোঁজ পাওয়া যায় হৃদয়ে। তাই হৃদয়-মনে সুস্থ সতেজ থাকা জরুরী।
যে বয়সে সবাই অবসরযাপন করে সে বয়সেও তিনি অধ্যাপনা করে চলেছেন, কী তার কারণ?- এই প্রশ্নের উত্তরে সন্তাম্মা জানান, ‘নিজেকে তো তিনি কখনই অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে তুলনা করতে পারবেন না, তবে সকলেই পৃথিবীতে আসে কোনও না কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে। তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য, শেষ জীবন পর্যন্ত পড়ানো!’’
পদার্থবিদ্যা ছাড়া তাঁর অন্য আগ্রহের বিষয় বেদ-পুরাণ-উপনিষদ। প্রয়াত স্বামী চিলুকুরি সুব্রক্ষণ্যম শাস্ত্রী ছিলেন তেলেগু ভাষার অধ্যাপক। তাঁর সূত্রেই উপনিষদের প্রতি আগ্রহ জন্মায় সন্তাম্মার। বর্তমানে গীতার শ্লোকের উপর ‘ভগবত গীতা- দ্য ডিভাইন ডিরেকটিভ’ নামের ইংরেজি ভাষায় একটি বই লিখেছেন সন্তাম্মা।