‘পান্ডওয়ানী’র জন্য ছেড়েছিলেন ঘর

 লম্বা চুল তেল দিয়ে টেনে বাঁধা, লাল শাড়ি, বেল্টের মতো ঘুরিয়ে আটকান। কাজল টানা চোখ। পানের রসে ঠোঁট ভিজে লাল । বীণা হাতে যখন মঞ্চে আসেন তখন তিনি দীপ্ত সরস্বতী।  আত্মস্থ ভঙ্গী। মহাভারতের কথা সুরের স্রোতে ভেসে যায় মঞ্চ। ভাসিয়ে নিয়ে যায় দর্শকদের।  

 তিনি তিজন বাঈ।  অনন্য এক মহাকাব্য কথিকা।

te

 ১৯৫৯ সালে ছত্তিশ গড়ের রায়পুরে জন্ম। বাবা চুনুক লাল পারতী। মা সুখবতী।  ‘পারতী’ সম্প্রদায় ছত্তিশগড়ের উপজাতি গোষ্ঠীভুক্ত।    

ছোটবেলা থেকে কানে শুনে শুনে পান্ডওয়ানী শিখে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সমস্যা হল যখন মঞ্চে অর্থাৎ প্রকাশ্য জনতার মাঝে ‘পারফর্ম’ করার সময় এল।  তীব্র প্রতিবাদ এল চারদিক থেকে।  এমনকি তাঁর বাবা-মাও নারাজ ছিলেন। মঞ্চে দেখা গেলে যে বাড়িতে ঠাঁই হবে না সে কথাও খুব স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হল তিজনকে।  

এমন কী ছত্তিশগড়ের গানিওয়ারীতে তাঁকে পাথর ছোঁড়াও হয়েছিল। কিন্তু থেমে গেলেন না ভয়ে।

১৩ বছর বয়স থেকে মঞ্চে পান্ডয়ানী শুরু করেন।

নিজেকে তিজন বলেন, ‘আমি কবি নই।  যখন ছোট ছিলাম প্রত্যেকদিন রাতে দাদু মহাভারতের গান শোনাতেন। সেই গান শুনে শুনে আমি গলায় তুলে নিতাম। গান শুনে দৃশ্যগুলো চোখে ভাসত। কথা আপনি চলে আসত।’

“ পান্ডওয়ানী। ইয়ে কাম লড়কোঁ কা হ্যায়, লড়কীয়োঁ কা নেহি। অ্যায়সা মুঝে বোলা গ্যায়া। মুঝে মানা করতে থে সব লোগ। মা কহতী থি ইয়ে সব গাঁওওয়ালে তানা মারতে থে। ম্যায় লেড়কী হো কর লড়কোঁ কা কাম করতি থি”।

তিজন বুঝতে পারতেন না তাঁর অপরাধটা ঠিক কোথায়! কেন মেয়েরা মঞ্চে আসতে পারবে না?  নানা রকম চাপ আসতে থাকে তাঁর ওপর। পরিবারকে এক ঘরে করার হুমকি আসতে থাকে।   কেউ তাঁকে বিয়ে করবে না। বিপদে পড়বে ভাই-বোনেরাও।

গ্রাম থেকে বলা হল যে সব মেয়েরা ‘ভাল’ নয় তারাই এভাবে ভরা হাটের মাঝে গান গাইতে যায়।

কিন্তু তাঁর মনে হয়েছিল ‘ ভগওয়ান কী কথা বতানে সে কিঁউ কাতরানা?’ তাই গান বন্ধ করলেন না তিজন।

তাঁর মা এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেন নি। তিজনকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়।  রাতারাতি ঘরছাড়া যাযাবর হয়ে গেলেন। কী করে খাবার বানাতে হয় তাও জানতেন না।  শুধু জানতেন জীবন তাঁর থেকে সব কেড়ে নিলেও গানকে ছাড়বেন না তিনি। ‘মহাভারত-কথা’কে সুরে সুরে বাঁচিয়ে রাখার যে উত্তরাধিকার তিনি পেয়েছিলেন সেই স্রোতেই ভেসে গেল তিজনের জীবন।

‘প্রথম ভর পেট ভাত পেয়েছিলাম গান গেয়ে। ঘরের ওপর ছাদ কিনতে পেরেছিলাম গান থেকেই’

তিনবার বিয়ের বাঁধনে বাঁধা পড়েছিলেন। কিন্তু শিল্পীর জীবন শিকলে বাঁধা পড়লে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা কেবল কষ্ট যাপন।  শ্বশুরবাড়ি থেকে বলা হল, ‘ হামে গানা গানেওয়ালি নেহি,  খানা বনানেওয়ালি বহু চাহিয়ে”

বারবার ঘর ছেড়েছেন তিনি। আসলে কোনও ঘরই ঠিক আশ্রয় হয়ে উঠতে পারেনি। কেবল গান ছাড়া।  মহাকাব্যের কথা, কাহিনী, সুর তাঁকে ঘর দিয়েছে। সেই তাঁর আশ্রয়।

ব্যাধি, বেদনা, শোক কাতরতা ম্লান হয়ে গিয়েছে তাঁর কাছে।

te1

বহু সম্মান পেয়েছেন জীবনে। সম্প্রতি পেয়েছেন পদ্ম সম্মানও।  আগেই পেয়েছিলেন সঙ্গীত নাটক একাদেমি পুরস্কার। বিদেশেও সম্মানিত হয়েছেন একাধিকবার।  যে শিল্পের জন্য একদিন ঘরছাড়া হতে হয়েছিল সেই শিল্পকে তাঁর জন্য সারা পৃথিবীর দরজা খুলে দিয়েছে।   কিন্তু পুরস্কারের গুরুত্ব, মর্যাদা ঠিক কোথায় সে নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবেন না।  

বিলাসপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.লিট উপাধি দিতে চেয়েছিল। তিনি নেননি।  কর্তৃপক্ষকে বলেছিলেন একবার তিনি পেয়েছেন। রায়পুর  বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। একজনকে দুটো ডিগ্রি দেওয়ার বদলে যেন অন্য কাউকে দেওয়া হয়।

চার- চারটি ডি.লিট পেয়েছেন। অথচ আক্ষরিক অর্থেই কোনওদিন স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাননি তিনি।

প্রয়াত প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সামনে ‘পান্ডওয়ানী’ প্রদর্শন করেছিলেন।  তিনি বলেন, ‘ছত্তিশগড় মেঁ মহাভারত করওয়াতি হো কেয়া?’

তিজনের চটপট উত্তর ছিল, ‘মহাভারত করওয়াতি নেহি, সুনাতি হুঁ।’

 তিজনের কাহিনি উঠে আসতে চলেছে পর্দায়। নওয়াজউদ্দীন সিদ্দিকি এবং তাঁর স্ত্রী আলিয়া সিদ্দিকি তাঁর জীবন নিয়ে বায়োপিক বানাতে উৎসাহী।

পর্দায় তিজন বাঈ- এর ‘নানা’র চরিত্রে প্রথম পছন্দ অমিতাভ বচ্চন। আর তিজনের ভূমিকায় কাকে দেখা যাবে তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। উঠে আসছে বিদ্যা বালান, রানী মুখার্জী এবং প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার নাম।  

বয়স এখন তিয়াত্তর ছাড়িয়েছে। শরীরে ভাঙনের টান। আজকাল একটানা দম ধরে রাখতে কষ্ট হয়। তবু  টানে মঞ্চ। টানে দর্শক। তাদের মাঝেই তাঁর আসল তৃপ্তি। অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহ,ভরা দর্শক। বীণার রাগিনিতে ঝংকার। মগ্ন মীরার  মত মহাভারতের কথা বলে চলেছেন তিনি। গানে, গল্পে জীবন্ত হয়ে উঠছে মহাকাব্যের চরিত্ররা। 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...