নির্ভীকতা আর মানবতার অপর নাম 'দীপিকা'

 

জীবনের লহরে কত কিছুই না ভেসে যায়... প্রাত্যহিক বেশ কিছু খবর, মুহুর্ত, মানুষ, ঘটনা আমাদের কাছে 'বিশেষ' হয়ে ওঠে যেমনভাবে ঠিক তেমনভাবেই নিয়মমতো সে সবকিছুই হয়ে পড়ে ফিকে, ঝাপসা। যেমন ধরা যাক গতবছর ঘটে যাওয়া চরম নৃশংস-ভয়াবহ কাঠুয়া শিশু গণধর্ষণের কথা। সারা দেশ রীতিমত উত্তাল হয়ে উঠেছিল এই খবরে।   সোশ্যাল মিডিয়া, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া ছেয়ে গিয়েছিল আট বছরের ছোট্ট আসিফার ক্ষতবিক্ষত ছবি আর 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস ফর আসিফা' শ্লোগানে। তারপর?......তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিকে হয়ে গিয়েছিল আসিফা বানো'র মুখ, সেইসব শ্লোগান আর যাবতীয় উদ্বেগ। কিন্তু পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষও রয়েছেন যাঁরা সম্পূর্ণ অন্য স্নায়ুর মানুষ। যাঁরা ভুলে যান না সহজে, 'বিশেষ' কিছুকে মনে রাখেন দায়িত্ব সহকারে, জরুরি কিছুকে ফিকে হতে দেন না কিছুতেই। শক্ত হাতে হাল ধরে রাখার মন্ত্র জানেন তাঁরা। সেরকমই এক 'অন্য স্নায়ুর মানুষ'কে ঘিরেই এই প্রতিবেদন। তিনি বাস্তবিক জীবনের 'সুপারহিরো' - দীপিকা সিংহ রাজাওয়াত।

 

ঠিক যেমনভাবে ১৭ জানুয়ারি ২০১৮ জম্মু-কাশ্মীরের কাঠুয়াতে ঘটে যাওয়া সেই নির্মম পাশবিক ঘটনা দেশকে উত্তাল করেছিল, তেমনভাবেই গত দু'দিন থেকে দীপিকা সিংহ রাজাওয়াতকে ঘিরেও উত্তাল হয়ে উঠেছে সারা দেশ। কী এমন করেছেন তিনি যার জন্য তাঁকে ঘিরে এত উত্তেজনা?

 

কালো ফ্রেমের চশমা, কালো কোট সঙ্গে সাদা শালোয়ার কামিজ ওড়না। মুখের সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে ঝলসে উঠেছে অদমনীয় দৃঢ়তা। তাঁকে যাঁরা দেখেছেন, এভাবেই দেখে থাকবেন কারণ, ঠিক এটাই তাঁর 'আইডেন্টিটি'। তিনি স্রোতের বিপরীতে হাঁটা জম্মু-কাশ্মীর হাইকোর্টের একজন আইনজীবী। ১৯৮০ সালে জম্মু-কাশ্মীরের কারিহানা গ্রামে এক কাশ্মীরী পণ্ডিত পরিবারে জন্ম নেন এই বিশিষ্ট আইনজীবী। যোধপুরের ‘ন্যাশনাল ল ইউনিভার্সিটি’ থেকে আইনে স্নাতক হয়ে বর্তমানে জম্মু-কাশ্মীরের আদালতে আইনজীবী হিসেবে কর্মরত। মানবাধিকার এবং শিশুকল্যাণের জন্য কাজ করা এনজিও ‘ভয়েস অব রাইট’-এর ও চেয়ারপার্সন তিনি।

 

কাঠুয়ার ঘটনার পর দেশজুড়ে শুরু হয় প্রবল আলোড়ন। মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক সাঞ্জী রাম, তিন পুলিশ কর্মী-সহ মত আট জন অভিযুক্ত হয়। অভিযুক্তদের সমর্থনে বিক্ষোভ দেখায় 'হিন্দু একতা মঞ্চ' নামে এক সংগঠন। মন্দিরের তত্ত্বাবধায়কও অভিযুক্তদের সমর্থনে বিক্ষোভ দেখান। ঠিক সেই সময়ে নিজের বিপদের তোয়াক্কা না করে আট বছরের মৃত গণধর্ষিত শিশুটির হয়ে মামলা লড়ার গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন দীপিকা। গণ্ডগোলের সুত্রপাত ঠিক তার পরেই। দেশজুড়ে বাড়তে থাকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চাপানউতোর। কিন্তু জম্মু-কাশ্মীর হাইকোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনের বিরোধিতা, ক্রমাগত ধর্ষণের হুমকি, তাঁর নয় বছরের মেয়েকে প্রাণে মারার শাসানি, 'দেশদ্রোহী' তকমা-কিছুই দমাতে পারেনি তাঁকে তাঁর দৃঢ়তাকে।

 

অবশেষে গত ৩ জুন, ২০১৯-এ নৈতিক জয় পেয়েছেন এই লড়াকু মানুষটি। দোষী সাব্যস্ত হয়ে উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে কাঠুয়া কাণ্ডে অভিযুক্তরা। তাঁর এই অসামান্য সাহসিকতার জন্য ১১ জুন ২০১৮ ‘ইন্ডিয়ান মার্চেন্ট চেম্বার’-এর মহিলা শাখা তাঁকে ‘উম্যান অফ দ্য ইয়ার’ শিরোপায় ভূষিত করে। ‘লাডলি অ্যাওয়ার্ড ,‘চরখা অ্যাওয়ার্ড’ ইত্যাদি নানান পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। অনেকেরই জানা নেই কাঠুয়া কাণ্ডে তিনিই প্রথম ‘রিট পিটিশন’ দায়ের করেছিলেন যে কারণে বাতিল হয়ে যায় তাঁর জম্মু- কাশ্মীর বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যপদও।

 

সবাই ভুলে যাব। একদিন হয়তো ফিকে হয়ে যাবেন দীপিকাও। কিন্তু তাঁর মত মানুষেরা থেকে যাবেন ইতিহাসে...গল্প নয় 'সত্যি' কথায়, আর

নির্ভীকতা-মানবতার অপর নাম হিসেবে উচ্চারিত হবে তাঁদের নাম।

 

 

 

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...