প্রেমের মৈমনসিংহ

প্রেমের মৈমনসিংহ

নয়া বাড়ী লইয়া রে বাইদ্যা, লাগাইল বাইঙ্গন/সেই বাইঙ্গন তুইলতে কইন্যা জুড়িল কাইন্দন গো,জুড়িল কাইন্দন…

মনে পড়ে মহীনের ঘোড়াগুলি রচিত ও সুরারোপিত সেই মন ভোলানো গান!

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের কথা’ গ্রন্থে বলেছিলেন-‘… -র সাহিত্যিক মূল্য বিদেশী সাহিত্য রসিকেরা কী দিয়াছেন, তাহা জানিলে বোধ হয় আমরা আমাদের ঘরের জিনিসকে একটু বেশি আদর করিব’

মৈমনসিংহ গীতিকা।বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলা এবং নেত্রকোনা জেলার কিছু অংশ।সেখানেই আত্মপ্রকাশ গীতিকার। বাঙালি হয়ত সত্যিই আদর করতে ভুলে যাচ্ছে।

 মৈমনসিংহ ছিল  ইংরাজ শাসিত ভারতের সবচেয়ে বড় জেলা। বিস্তৃতি ছিল উত্তরে গারো পাহাড় থেকে দক্ষিনে বঙ্গোপসাগর অবধি। কালে কালে  জেলা ভেঙ্গে নতুন নতুন জেলা তৈরি হয়েছে।

এই গীতিকা মূলত প্রণয়মুলক। গ্রাম আর রোমান্টিকতা এক ফ্রেমে সংসার বেধেছে। কাজল রেখা, মহুয়া, মলুয়া, লীলা, চন্দ্রাবতী - গীতিকার নায়িকাদের প্রেম ও ত্যাগের গভীরতা মনে অকাল বৃষ্টিপাত ডেকে আনে।

হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির মিলনের সুর এর ছত্রে ছত্রে সুরভিত করে সম্প্রীতি। বাঙালি চিরন্তন সাম্প্রদায়িক প্রীতি ও চেতনার বাহক। গ্রাম্য মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দু:খ, প্রেম-বিরহের আখর গ্রন্থ মৈমনসিংহ গীতিকা।

গ্রামীন সরল ও মুক্ত পরিবেশ, অতিথি পরায়নতা, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের এক অকৃত্রিম রূপ এই গীতিকার উপজীব্য।আবার সাহিত্য মূল্যও অসীম। প্রধানত নায়িকা প্রধান এই উপাখ্যান।

ইংরেজী ভাষায় অনূদীত হয়ে প্রকাশের পর বিদেশের এক ঝাঁক সাহিত্যিকরাও এর প্রেমে পড়তে বাধ্য হন। বিশেষ করে রোমা রোলাঁ, ড. সিলভা লেভি, স্যার জর্জ গ্রীয়ারসন, উইলিয়াম রদেনস্টাইন, ফ্রান্সিস. এইচ. স্ক্রাইন, ই.এফ. ওটেন গীতিকা সম্পর্কে উচ্ছসিত প্রশংসা করেন।

 শহুরে সংস্কৃতিতে এই গীতিকা আজও এক বড় গৌরবের জায়গা দখল করে রেখেছে।গ্রামের অঁজ পাড়া গার মানুষেরাও যে কত সুন্দর শিল্প সৃষ্টি করতে পারেন, এই দৃষ্টিপাত শহুরে সভ্যতায় ভাবনারও অতীত।

 মৈমনসিংহ গীতিকায় ১০টি গীতিকা স্থান পেয়েছে। গীতিকায় রচয়িতার নাম থাকলেও তাঁদের স্বতন্ত্র কবিত্বের চিহ্ন নেই। বিষয়বস্তু, শিল্পাঙ্গিক, ভাষাভঙ্গি ও পরিবেশনা রীতিতে অনন্যতা বর্তমান।

মূলকথা লোকসমাজ থেকেই গৃহীত । ধর্ম নয়, পার্থিব জীবনকথা এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। নরনারীর লৌকিক প্রেম বেঁচে থাকার সঞ্জীবনী রস। প্রেমের পরিণতি?কোনওটি মিলনাত্মক, কোনওটি বিয়োগান্তক।

 নায়িকার নামানুসারে একেকটি অধ্যায়ের নামকরণ হয়েছে।  পুরুষ চরিত্রের তুলনায় নারী চরিত্রের ভূমিকা উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত। প্রেমের প্রতিষ্ঠায় তারাই বেশি সংগ্রাম ও ত্যাগ স্বীকার করেছে।

নারীদের একনিষ্ঠ প্রেম ও বলিষ্ঠ চরিত্র একটি মাতৃতান্ত্রিক সমাজের ছবি তুলে ধরে। অন্যান্য গীতিকাগুলি সামন্ত  সমাজচেতনার ও মূল্যবোধের ছায়ায় স্তিমিত। রাজা, জমিদার, দেওয়ান, কাজী প্রভৃতি চরিত্র মধ্যযুগের মুসলিম শাসন-ব্যবস্থাকেই সূচিত করে।

 সামন্তসমাজের মূল্যবোধ ধারণ করেও মানবপ্রেমের মহিমা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, ইহজাগতিকতা এবং নৈতিকতা মৈমনসিংহ গীতিকাকে এমন সাহিত্যিক মূল্য ও মর্যাদা দান করেছে, যা আধুনিক যুগের উপন্যাসের সঙ্গে তুলনীয়।

 ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দীনেশ চন্দ্র সেন “মৈমনসিংহ গীতিকা’’ গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। এ ভাষায় রঙরস আছে, কারুকাজ আছে কিন্তু কৃত্রিমতা নেই।

FotoJet - 2020-02-28T195124.847

 অতি সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনা, জীবনবোধ, আবেগ অনুভূতির ছড়া মৈমনসিংহের আকাশ জুড়ে।  কাহিনীগুলোর কথা গ্রাম্য কবিরা পয়ারে গেঁথে রেখেছেন  যাতে খুঁজে পাওয়া যায় অফুরন্ত কারুণ্য ও কবিত্যের সন্ধান।

 সেই কবিরা আজ নেই। তাদের অশ্রু ফুরিয়েছে ।কিন্তু শ্রোতাদের অশ্রু কখনও ফুরোবার নয়। সরলভাবে জীবন ও যৌবনের গান গেয়েছেন। চরিত্র-চিত্রণের নৈপুণ্যে আর  প্রেম বিশুদ্ধ অনুভূতির স্তর অতিক্রম করে স্পষ্ট বাস্তবতায় উত্তীর্ণ সকল গাথা।

জীবন বিরোধী সবকিছু কেই হেলায় ঠেলে ফেলা হয়েছে এই কাব্যমালায়। এখানে বাস্তব হোক বা কল্পনা- সবই জীবন নির্ভর।

বলা যায়, মৈমনসিংহ গীতিকা মূলতই স্বাধীন প্রেমের জয়গান। পছন্দের জীবন সঙ্গী বেছে নেবার স্বীকৃতি আছে এখানে। এই গীতিকার নারীরা কখনও ধর্মীয় কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিন্ন করেছে। কখনও বা অভিভাবকের অভিমতের বিরুদ্ধে পছন্দের মানুষটিকে কাছে পেতে ছেড়েছে ঘর।

 অলৌকিক, অসম্ভব বা অবাস্তব নয়। এটাই নারীর শক্তি, উদারতা ও ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক মূল্যবোধের জয়গান।

প্রেমের মাস শেষ হতে আর কয়েক প্রহরের অপেক্ষা। তবুও বাংলার আকাশে বাতাসে গন্ধে প্রেমের বাস। তার সুবাসেই প্রকৃতি নেচে ওঠে। বর্তমান পাঠকের দায় বর্তায় কীভাবে এই উপাখ্যান কে আরও জোরালো স্বরে পৃথিবীর কাছে মেলে ধরা যায়।

সর্বোপরি,গোটা দেশ জুড়ে আজ যে সাম্প্রদায়িক বিভেদের সুর দানা বাঁধতে শুরু করেছে, সেই প্রসঙ্গেও সকলেরই কর্তব্য মিলনের এই গাথাকে বুকে আগলে এগিয়ে আসা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...