একদিন ক্লাস চলছে। ইংরাজী। মাস্টার মশাই পড়াচ্ছেন বিখ্যাত কবিতা দ্য ফেবল। কবি, রাল্ফ ওয়ালডো এমারসন। বিরাট পাহাড় আর পুঁচকে কাঠবেড়ালির কথোপকথন। হাদারাম এর মাথায় কিছুতেই ঢুকলো না যে কীভাবে এরা কথা বলতে পারে। মানুষের ধারণা তারাই এই পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী। বাকিরা যতটুকু যা করে থাকে বা করতে পারে, তারা ততটুকু করার জন্যই অবগত। এরকমই এক পতঙ্গ কে ধরা যেতে পারে। মৌমাছি। বহু মানুষেরই এদের নিয়ে অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার খুব একটা মন্দ নেই।
মানুষের সেই একই ধারণা, এরা যেন রোবট বই আর কিছুই নয়। প্রকৃতি ঠিক যতটুকু কর্ম ক্ষমতা তাদের উপহার দিয়েছে, সেটুকুতেই তারা পরিতৃপ্ত ও সীমাবদ্ধ। বহু শতাব্দী ধরে এই ধারণাই ছিল বর্তমান। ছবিটা পাল্টে গেল একজনের দৌলতে। এক শতাব্দী আগেরই ঘটনা। অস্ট্রিয়া। কার্ল ভন ফ্রিশ এক আজব শিশু। ছেলেবেলা থেকেই মানুষ ব্যতীত অন্যান্য প্রাণীকুল তাঁকে বড্ড টানতো। সেইসব প্রাণীদের কাছে কেমন ভাবে ধরা দেয় বাকিরা, এই কথা জানার বড় সাধ তাঁর। তাঁকে ঘরের ভিতরে খুঁজে পাওয়া যায়না। পাওয়া যায় হয়ত কাছের জলাশয়ে। মাছেদের নিয়ে ব্যস্ত।
আচ্ছা, মাছেরা কি রঙ বা গন্ধ চিনতে পারে? এইরকম প্রশ্ন তাঁকে ভাবায়। চলতো নানান নিরীক্ষা। ক্যামেরা বন্দীও হতো সেইসব মুহূর্ত। একবার মৌমাছি দখল করলো তাঁর আকর্ষণের কেন্দ্র। তারা সবসময় নড়ছে অথবা লাফাচ্ছে। কারণ কী এর? অর্থহীন তাদের এই শৈলী। সম্ভব নয়! প্রকৃতিতে ঘটে চলা সবকিছুরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও কারণ বর্তমান। যেই না ভাবা, সেই শুরু পরীক্ষা নিরীক্ষা। তাদের গুনগুন যদি হয় গানের সুর, তবে লম্ফঝম্প কে বলা চলে নাচের ভঙ্গিমা! একদিন ধরে আনলেন এক মৌমাছি। একটা চিনি মেশানো পাত্রের জলে ছেড়ে দিলেন। চিনির জলে খানিকক্ষণ ভেসে থেকে, কিছু পরিমাণ খেয়ে উরে গেলো নিজের চাকে।
কেটে গেলো কিছুটা সময়। কার্ল লক্ষ্য করলেন কিছুক্ষণ পরেই আরও মৌমাছি আসতে শুরু করেছে সেই পাত্রের দিকে। বুঝতে দেরি হলনা যে সেই প্রথম মৌমাছিই ডেকে এনেছে বাকিদের। কারণ সেই মৌমাছির গায়ে আগেই তিনি একটা রঙের দাগ টেনে দিয়েছিলেন। কিন্তু ভাববার বিষয় এই যে এরা সকলেই একই চাকের বাসিন্দা। অন্যান্য চাক থেকে এলোনা কেউই।
আসলে অন্যেরা আসবেই বা কী করে! চিনি কি আর তাদের খাবার! কার্ল এবারে নিজের পরীক্ষার জায়গাটা বদলালেন। সেখানেও ফলাফল একই। তাহলে আগের একটা প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া গেলো না। আর তা হল এই যে মৌমাছিরা চিনির খোঁজে এলো, তারা বুঝলো কীভাবে যে সেখানে কিছু খাওয়ারের উৎস বর্তমান! এর উত্তর নিহিত মৌমাছির সেই শারীরিক ছন্দে, তাদের নাচে। তাদের সেই লাফালাফি শুধুই লাফালাফি নয় যে। বরং জটিল এক সাংকেতিক তত্ত্বে ঠাসা। সেই সংকেত তৈরি হয়েছে গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান আর সময়ের হিসাব মিলিয়ে।
সূর্যের অবস্থান বুঝে তারা ঠিকানা সন্ধান করে খাদ্যের। সূর্য যেদিক বরাবর অবস্থান করে, সেদিক বরাবর লাফালাফি চলতে থাকে এদের। যদি সুয্যি মামা থাকেন কৌণিক দূরত্বে, তাহলে নাচের অবস্থানও বদলায় কৌণিক দিক বরাবর। ঠিক যতক্ষণ চলে এদের লাফালাফি, বুঝে নিতে হবে খাওয়ারের উৎসের দূরত্বও ঠিক ততটাই। আসলে এই পৃথিবীতে কেউই ফেলনা নয়। প্রত্যেকের অবস্থার প্রেক্ষিতে তাদের মধ্যে গুরত্ব বর্তমান। প্রত্যেকেরই গ্রহণ যোগ্যতা আছে, তাদের মত করে।
"Talents differ; all is well and wisely put..."