এগারো বছরের ছোট্ট মেয়েটিকে বাবা মা বিয়ে দিয়ে দিলেন পঞ্চাশ বছরেরও বেশি বয়সী একজন মানুষের সঙ্গে। নাম তার ত্রিলোচন হাজরা। মেদিনীপুরের তমলুকের গরীব চাষির ঘরে জন্ম নেওয়া মেয়েটিকে পড়ানোর সামর্থ্য ছিলো না দরিদ্র কৃষিজীবী পিতা ঠাকুরদাস মাইতির। দশ বছরের মেয়েকে "পার" করে দিলেন চারগুনেরও বেশি বয়সী একজন বিপত্নীক মানুষের ঘরে। কিছু বোঝার আগেই পাশের গ্ৰাম আলিনানে শ্বশুরবাড়িতে চলে গেল বালিকাটি। ইস্কুলে বা পাঠশালায় যাওয়ার আর সুযোগই পেলো না সে।
আঠারো বছর বয়সে বিধবা হল সেই মেয়ে। নিঃসন্তান মেয়েটির স্বামীর সংসারে আর জায়গা হল না। শ্বশুরঘরের পাশেই একটা ছোট গোলাঘরে স্থান হলো সদ্য বিধবা মেয়েটির... তরুণী সেই বিধবা মেয়েটির নাম মাতঙ্গিনী। ভেবেছিল বাঙালি বিধবার কঠোর কৃচ্ছসাধনের জীবন যাপন করবে। কিন্তু মেয়েটার হৃদয় ছিলো অনেক বড়। গ্ৰামে সকলের বিপদে আপদে পাশে গিয়ে দাঁড়াত সে। অসুখ বিসুখে সেবা করত। খুব সাধারণ গ্ৰাম্য এই মেয়েটির জীবনের গতি পাল্টে গেলো ১৯০৫ সালে.... বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়। মেয়েটি আর ছোট নেই। তাঁর পঁয়ত্রিশ বছর বয়স তখন। এইরকম সময়ের আগে পরে স্বামী বিবেকানন্দর একটি বক্তৃতার বিষয়ে তিনি অবগত হলেন....
...."এখন থেকে আগামী পঞ্চাশ বছর তোমাদের একমাত্র উপাস্য দেবতা হবেন - জননী-জন্মভূমি। তাঁর পুজো করো সকলে।"...
সেই মহিলা... যার নাম মাতঙ্গিনী.... তিনি স্বামী বিবেকানন্দের সেই বক্তৃতায় এতটাই উদ্বুদ্ধ হলেন যে ঠিক করে ফেললেন এখন থেকে দেশই হবে তাঁর উপাস্য একমাত্র দেবতা। দেশের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনই হবে তাঁর দেবতার "আরাধনা"....।
মহাত্মা গান্ধীর অনুগামী মাতঙ্গিনী চরকা কেটে কাপড় তৈরি করা শুরু করলেন। প্রতিবেশীরা আদর করে নাম দিলো "গান্ধীবুড়ি"। তিনি বিশ্বাস করতেন যে দেশকে বিদেশি শাসকদের হাত থেকে মুক্ত করে দেশবাসীর মুখে হাসি ফোটানোর থেকে বড় ধর্ম আর কোনো কিছু হয় না। তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে গান্ধীর আদর্শ প্রচার করতেন এবং আর্ত পীড়িতের পাশে গিয়ে সেবার কাজ করতেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বর্তমানের বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী, তমলুকেরই সন্তান ড. মণি ভৌমিক তখন বারো বছরের এক গ্রাম্য বালক। সেদিনের সেই অতি সহজ সরল কপর্দকশূণ্য বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা হয়ে উঠেছিলেন মণি ভৌমিকের শৈশবের বন্ধু। তাঁর নিজের বর্ণনায়, “তাঁর বাবার বাড়ির অবস্থা ভালো ছিল না। তিনি আঠারো বছর বয়সে বিধবা হওয়ার পরে ধান ভাঙার কাজ করে, একটি ঝুপড়ির মধ্যে থেকে তাঁর জীবন ধারণ করতেন। আমি তখন হাড় জিরজিরে নিঃসঙ্গ গরীব এক বালকমাত্র। কিন্তু স্নেহমমতার দৃপ্ততায় এবং দীপ্ততায় মাতঙ্গিনী হাজরা হয়ে উঠেছিলেন আমার বন্ধু এবং উপদেষ্টা".....
১৯৩০ সাল... ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তখন তীব্র আকার নিয়েছে। শুরু হলো গান্ধীজীর লবণ সত্যাগ্ৰহ ...আইন অমান্য আন্দোলন। ঝাঁপিয়ে পড়লেন মাতঙ্গিনী। আইন অমান্য করার জন্য পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে এবং ছ'মাসের কারাদণ্ডও ভোগ করতে হয় তাঁকে। তখনও তিনি বলেছিলেন.. "দেশের জন্য দেশকে ভালোবাসার জন্য দণ্ডভোগ করার চেয়ে বড় গৌরব আর কী আছে?'
১৯৪২... গান্ধীজী "ভারতছাড়ো" আন্দোলনের ডাক দেন। ধ্বনি তোলেন "করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে".. সারা ভারত উত্তাল হয়ে ওঠে। সেই আন্দোলনের ঢেউ পৌঁছায় পশ্চিমবাংলার মেদিনীপুরের তমলুকে। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে যে মেদিনীপুর বরাবরই স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিল। মেদিনীপুরের আরেক উজ্জ্বল সন্তান ছিলেন বিপ্লবী শহীদ ক্ষুদিরাম বসু।
ফিরে আসা যাক ১৯৪২এ। বিপ্লবের জোয়ার আছড়ে পড়েছে মেদিনীপুরে। বিপ্লবীরা ঠিক করলেন একসঙ্গে তমলুক, মহিষাদল, সুতাহাটা এবং নন্দীগ্রাম থানার দখল নেওয়া হবে। বিপ্লবীদের পুরোভাগে ছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা। তিনি অন্যান্য বিপ্লবীদের বোঝালেন গাছ কেটে পথে ফেলে সব রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিতে হবে। টেলিফোনের তার কেটে দেওয়া হলো, বন্ধ করে দেওয়া হলো বিদ্যুৎ সরবরাহ। পাঁচ দিক থেকে পাঁচটি মিছিল নিয়ে গিয়ে তমলুক থানা এবং অন্যান্য সরকারি কার্য্যালয় দখল করে নিতে হবে।
এলো সেই ২৯শে সেপ্টেম্বর। মেদিনীপুরের তমলুক শহরের উত্তর দিকের গ্রামগুলো থেকে ছ হাজার মানুষ মিছিল করে রূপনারায়ণ নদের পাড় ধরে হেঁটে আসছে স্লোগান দিতে দিতে। বছরের পর বছর ব্রিটিশ শাসকদের অমানবিক অত্যাচার আর সহ্য করা যাচ্ছে না। নিজের দেশেই পরাধীন থাকবে না তারা। সারা শরীরের রক্ত ফুটতে শুরু করেছে জনতার। সবার মুখে একটাই শ্লোগান "বন্দেমাতরম"..."ইংরেজ..ভারত ছাড়ো".. দেওয়ানি কোর্টের পেছনে বিশাল ব্রিটিশ সেনাবাহিনী অহিংস জনতার মিছিলের পথ আটকে দাঁড়ালো। আর এগোলেই গুলি করা হবে । সঙ্গে চলল অকথ্য আর অশ্রাব্য গালি। উদ্যত বন্দুকের সামনে তখন উদ্বেলিত জনতা। হঠাৎই একটি ১৩ বছরের ছোট্ট রোগা বালক লক্ষ্মীনারায়ণ দাস ছুটে গিয়ে এক ব্রিটিশ পুলিশের হাত থেকে উত্তেজিত হয়ে ছিনিয়ে নিতে গেল বন্দুক। সেই ছোট্ট বালককে পুলিশের বীরপুরুষরা বন্দুকের বাঁট আর বেয়োনেট দিয়ে থেঁতলে থেঁতলে খোঁচা মেরে খুন করে ফেলল। মৃত্যুযন্ত্রণায় বুকচেরা সেই বালকের আর্তনাদ কিছুটা হতচকিত করে ফেললো জনতাকে। ঠিক তখনই সেই মিছিলের মধ্যে থেকে লোকজন ঠেলে এগিয়ে এলেন ৭৩ বছরের এক বৃদ্ধা - মাতঙ্গিনী হাজরা। সামনের একজনের হাত থেকে একটা ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা নিজের হাতে নিয়ে নিলেন। অপর হাতে শঙ্খ। সামনের একটা বাড়ির দালানে উঠে হতচকিত জনতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন------“হয় জয়, না হয় মরণ। হয় এগিয়ে যাবো, নয় মরবো। আমি সকলের আগে থাকবো। কেউ পিছিয়ে যেও না। এসো। আর যদি কেউ না আসো তবে আমি একাই এই পতাকা নিয়ে এগিয়ে যাব। তাতে যদি মরতে হয় মরব। এসো আমার সঙ্গে।”
সেই মহীয়সী বৃদ্ধা পতাকা নিয়ে শুরু করলেন হাঁটা। দেশমুক্তির এক অদম্য জেদ এই বৃদ্ধার অন্তরে। সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ শাসকের পুলিশের হুমকি, “খবরদার, এক পা এগোলেই গুলি করব।” সেই হুমকি কখনো টলাতে পারে এই অগ্নিময়ী তেজস্বিনী বৃদ্ধার গতিপথ! তাঁর লক্ষ্য পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করা, দেশের স্বাধীনতা... একমাত্র স্বাধীনতা। অকুতোভয় সেই নারী ‘বন্দেমাতরম’ বলতে বলতে এগিয়ে চললেন। হঠাৎ পুলিশের একটি গুলি ছুটে এসে লাগলো বৃদ্ধার বাঁ হাতে। তাঁর হাতের শাঁখটি পড়ে গেলো। তবু এগিয়ে চলতে লাগলেন বৃদ্ধা, অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যেও পতাকাটিকে ডান হাতে আঁকড়ে ধরে।
ব্রিটিশের পুলিশ আবার গুলি চালালো বৃদ্ধার শরীর লক্ষ্য করে এবং বৃদ্ধার ডান হাতে গিয়ে লাগলো হল সেই গুলি। রক্তের নদী বয়ে যাচ্ছে সেই বীরাঙ্গনার শরীরে। সেই গুলিবিদ্ধ জখম দুটি হাত দিয়ে বুকের মাঝে পতাকাদণ্ডটি সন্তানকে যেমন তার মা আঁকড়ে ধরে রাখে ঠিক সেইভাবে সজোরে ধরে রেখে বৃদ্ধা এগিয়ে চলেছেন, মুখে ‘বন্দেমাতরম’। কপালে, মুখে, ঘামের বিন্দুগুলো যেন হীরের টুকরোর মতো আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। রক্তের স্রোত বইছে সারা শরীরে, লাল রক্তের ফোঁটায় ফোঁটায় ভিজে যাচ্ছে দেশের মাটি। বৃদ্ধার কণ্ঠে তখনো ‘বন্দেমাতরম’, ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’। রক্তাক্ত গুলিবিদ্ধ শরীর নিয়ে দু’হাতে দেশের পতাকাটি বুকে আঁকড়ে ধরে বীর দর্পে পরাধীন ভারতবর্ষের অগ্নিকন্যা এগিয়ে চলেছেন। ব্রিটিশ শাসকের অমানবিক পুলিশকর্মীরা বিস্মিত, ভীত। ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীতে কর্মরত ভারতীয়দের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন তিনি..."ব্রিটিশের গোলামী ছাড়ো তোমরা। গুলি ছোঁড়া বন্ধ করে স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে হাত মেলাও"....
কিন্তু তাদের কানে গেলো না সেই আহ্বান... তাই তারা আরো ন্যক্কারজনক ঘৃণ্য হিংস্রতার পরিচয় দিল। আবার চালালো গুলি। সেই গুলি গিয়ে বিদ্ধ হল সেই অহিংসার প্রতীক গান্ধী-অনুগামী মহীয়সী মাতঙ্গিনীর কপালের কাছে বাঁ চোখের নীচে। গুলিটা তাঁর মাথার খুলি ফাটিয়ে বেরিয়ে গেল। আগ্নেয়গিরির মতো সহস্রধারায় ছিটকে পড়ল রক্তের বন্যা। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। তখনও তাঁর বুকে চেপে ধরা সেই পতাকাটি। রক্তে ভিজে উঠেছে ত্রিবর্ণ পতাকা। ক্ষীণ কণ্ঠে বলে উঠলেন "বন্দে মাতরম".. নিথর হয়ে পড়ে রইলেন ‘গান্ধীবুড়ি’, ‘বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী হাজরা।’ তাঁর রক্তে ভিজে উঠল পরাধীন ভারতবর্ষের মাটি। আজ সেই পুণ্য দিন....২৯শে সেপ্টেম্বর।
ধন্য আমার বঙ্গদেশ.. ধন্য আমরা... বাঙালিরা... যে বঙ্গভূমিতে জন্মেছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরার মতো মহিয়সী নারী। সেদিনের সেই জীবন দান ব্যর্থ হয় নি তাঁর। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছিল আমাদের দেশ। কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা এসেছিলো আর কয়েক বছরের মধ্যেই। আর সেই স্বাধীন ভারতে কলকাতায় প্রথম যে নারীর মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিলো.. তিনি বাংলা মায়ের মহান কন্যা বীরাঙ্গনা শহীদ মাতঙ্গিনী হাজরা।