গুজরাটের সর্বপ্রাচীন শিল্পকলা-"মাতা নি পছেড়ি"

গুজরাট, আমাদের দেশের সমৃদ্ধ একটি অংশ। এই রাজ্য যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে পরিপূর্ণ তেমনি এখানে রয়েছে শিল্প-কারুকার্যের সম্ভার। আর এই শিল্প কলার মধ্যে গুজরাটের সবচেয়ে প্রাচীন এবং অনবদ্য একটি শিল্পকলা হল "মাতা নি পছেড়ি" বা “দেবী কা পর্দা” যা মূলত এক ধরণের কলমকারি শিল্প। মাতা অর্থাৎ মা, নি অর্থাৎ এর এবং পছেড়ি অর্থাৎ পিছনে- এই কলার প্রদর্শন এখানকার দেবীপূজক সমাজ দ্বারা হয়ে থাকে। এই শিল্পের একটি ধর্মীয় আঙ্গিক রয়েছে, এটি কিন্তু মাতার পূজার ক্ষেত্রেই মূলত ব্যবহৃত হয়ে থাকে। দেবীপূজক সমাজের লোকেরা এটিকে সম্মানপূর্বক মন্দিরে রাখেন এবং তার পূজাও করেন। এই "মাতা নি পছেড়ি"র পূজা বিশেষত নবরাত্রির দিন হয়ে থাকে। বলা হয় যে এটি বহুকাল আগে ভাগারি সম্প্রদায় শুরু করে যাদের নিম্ন-সম্প্রদায় বলে পূর্বে মন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া হত না।

        এই পছেড়ি-র মধ্যে সাত থেকে নয়টি ভাগ থাকে, প্রতিটি ভাগে দেবীর নানান কাহিনী বর্ণনা করা হয়। আর এটি শুধুমাত্র পূজা করার জন্যই তৈরী করা হয়। দেবীপূজক সমাজের এই তিনশো বছরের পুরানো ঐতিহ্যকে এখনো শিল্পীরা ধরে রেখেছেন, এদের মধ্যে এক উল্লেখযোগ্য নাম হল সঞ্জয় চিতারা। একাধারে দেবীপূজক ও অন্যদিকে কলমকারি শিল্পী এই সঞ্জয় চিতারা তাঁর কলমের টানে ফুটিয়ে তোলেন দেবীকাহিনীর নানান ইতিবৃত্ত১৯৭৮ সালে মাত্র পনেরো বছর বয়সে শুরু হয় তাঁর যাত্রা। তিনি তাঁর এই শিল্পকলার শিক্ষা পান তাঁরই পিতা মনুভাই চুনিলাল চিতারার থেকে, যিনি এই শিল্প জগতের আর এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ২০০৪ সালে তিনি ভারতের পূর্বরাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী তাঁর হাতে জাতীয় পুরস্কার তুলে দেন এবং ২০০৯ সালে শিল্প গুরু অ্যাওয়ার্ড-এ সম্মানিত করা হয় তাঁকে। সঞ্জয় চিতারাও জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন।

        এই শিল্পের জন্য প্রাকৃতিক দ্রব্যাদির ব্যবহার হয় সবচেয়ে বেশী, কলম হিসাবে বাঁশের কাঠি, একটি সাদা পরিষ্কার কাপড় ও প্রাকৃতিক রং এর সাহায্যে তৈরী হয় এই পছেড়ি। সাথে অবশ্যই থাকে শিল্পীর ভাবনা যা কলম ও রঙের মাধ্যমে ফুটে ওঠে। প্রথমে সাদা কাপড়টিকে ধুয়ে পরিষ্কার করে নেওয়া হয় এবং তারপর তাকে হলুদ জলে ভিজিয়ে হালকা রঙিন করে নেওয়া হয়। শুকানোর জন্য এটিকে মেলে রাখা হয় বেশ কয়েকদিন, তারপর এটি প্রস্তুত হয়ে গেলে শুরু হয় রঙের কাজ। শুরুতে কালো ও লাল রং এর সাহায্যে দেবীর আকৃতি বানানো শুরু হয়। এই কালো রং আয়রন অক্সাইডগুড় থেকে এবং লাল রংটি তেঁতুলের দানা থেকে পাওয়া যায়। আকৃতি বানানোর পর এটিকে প্রবহমান নদীর জলে রাখা হয় যাতে বাড়তি রং নদীর জলে ধুয়ে যায়। অবশেষে এটিকে ফোটানো ফুলের নির্যাস ও রঙের মিশ্রনে ভেজানো হয় যাতে দুয়ের রং এটিতে ভালো করে লেগে যায়| এভাবেই প্রস্তুত করা হয় "মাতা নি পছেড়ি"|

       কলমকারি শিল্পের এই নিদর্শন সত্যিই বিরল কারণ ভারতের এই কোণে আজও এটিকে শুধুমাত্র ধর্মীয় ক্ষত্রেই ব্যবহার করা হচ্ছে, পূজা করা হচ্ছে দেবীর তথা শিল্পের-ও। এটিকে এখনো ব্যবসার আঙ্গিকে ফেলে দেওয়া হয়নি, তাই লাভের জন্য নয় ভক্তির জন্য এর খ্যাতি বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছে। এখানেই শিল্পের সার্থকতা। কলমকারী শিল্পকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন অভিধেয় বস্ত্র বা অন্যান্য সামগ্রী তৈরী ও বিক্রয় কিন্তু হয়েই থাকে বর্তমানে, এর চাহিদাও বেড়েছে অনেক। কিন্তু গুজরাটের এই শিল্পের ধরণ এক ও অদ্বিতীয়।

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...