'মাস্টারদা'র জন্মদিনে কিছু কথা

এখন প্রত্যেকেরই একটি করে ‘প্রাইভেট’ অর্থাৎ ‘ব্যক্তিগত’ দেশ রয়েছে। সে দেশে ‘আমরা সবাই রাজা’ নয়, ‘আমি একাই রাজা’। এ প্রজন্মের ইন্টারনেটীয়’ পৃথিবীতে 'আমরা', 'একসাথে', 'সবাই মিলে' এই শব্দগুলো সোশ্যাল মিডিয়ার 'wall'-এই ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় মাঝে মধ্যে, বাস্তবের সঙ্গে এই শব্দগুলির আর তেমন কোনও সম্পর্ক নেই বলাই সমীচীন হবে। না, প্রজন্ম নিয়ে কোনও তুলনামূলক গবেষনাপত্র আমি লিখতে বসিনি। বিভিন্ন প্রজন্ম বিভিন্ন ধরনের কথা বলবে এটাই তো রীতি। সময়ের এগিয়ে চলা, অথবা পিছিয়ে পড়া। অনেকদিনই হল আমরা 'নিউক্লিয়ার' হয়ে গেছি। দাঙ্গা-যুদ্ধ-মন্বন্তর-মহামারি-ভাগাভাগি দেখে বেঁচে আছেন এমন মানুষেরা আদমশুমারি থেকে বিলীন হচ্ছেন ক্রমাগত। তবে ইদানিং 'দেশ', 'দেশপ্রেম', 'দেশোদ্ধার', 'দেশদ্রোহী' এই শব্দগুলো বেশ শোনা যাচ্ছে, জোরালো চর্চাও শোনা যাচ্ছে এই নিয়ে।

হ্যাঁ, একটা সময় ছিল যখন লক্ষ লক্ষ মানুষের একটাই 'দেশ' ছিল, 'দেশ চেতনা' ছিল, একত্রে ভালবাসা ছিল, একত্রে গান শোনা ছিল, একত্রে কথা বলা ছিল, একত্রে বেঁচে থাকা ছিল।  কারণ সেসময়, সে প্রজন্মের কাছে সেটাই ছিল স্বাভাবিক, সবটাই ছিল একান্নবর্তী। বর্ণবিদ্বেষী-বৈদেশিক-আত্মঅহংকারী-স্বৈরাচারী শক্তির উৎখাতে একযোগে প্রতিবাদ ছিল, কারণ তখন তা ছিল জরুরী, কারণ পরাধীনতার অসহ্য শরশয্যায় বিদ্ধ হতে হয়েছিল তাঁদেরকেই। শুধুমাত্র নিজের নয়- লাখ লাখ দেশবাসীকে স্বাধীনতার স্বাদ বোঝানোর জন্য লড়াই করে বুলেট-বোমা-ফাঁসি'তে  একত্রে আত্মসমর্পনের বিশ্বাস ছিল প্রত্যেকেরই স্নায়ুতে স্নায়ুতে। সেই প্রত্যেকের মধ্যেই অন্যতম একজন ছিলেন সূর্যকুমার সেন, ওরফে কালু, ওরফে 'মাস্টারদা সূর্য সেন' বাংলার চট্টগ্রামে ১৮৯৪ সালে জন্ম তাঁর, আজ ২২ মার্চ, তাঁর জন্মদিন।

শিক্ষকতার পেশা এবং ছাত্র পড়ানোর সুবাদেই তাঁর নামের পাশে 'মাস্টারদা' তকমা পড়ে। তিনি ছিলেন সেই ধরনের শিক্ষক, যিনি ছাত্রদেরকে অঙ্ক শেখানোর পাশাপাশি জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতনতার কথা শেখাতেন। তিনি যে ধরনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিতেন তা মোটামুটি সকলেরই জানা। শুধু তাঁদের এই বিশেষ দিনে তাঁদের মত মহাপ্রানদেরকে স্মরণে রাখার প্রয়োজন রয়েছে কারণ-

এক বছর জেলহাজতে অমানুষিক নির্যাতন শেষে ব্রিটিশ সরকার তার ফাঁসির সময় নির্ধারণ করে ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি গভীর রাতে। মৃত্যুর পর তাঁর দেহটা দেশের মাটিতে সৎকার করাবারও সাহস পায়নি ব্রিটিশ সরকার। তার মরদেহ ফেলে আসে গভীর সমুদ্রে। যে দেশের মাটি ও মানুষকে মুক্ত করার জন্য লড়েছিলেন তিনি, সে দেশের মাটিতে ও জনগণের সামনে সূর্য সেনের নির্যাতিত মরদেহ রাখতে ভয় পেয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। মৃত্যুর আগে সূর্য সেনের শেষ কথা তাই শোষণ লুণ্ঠনবিরোধী আন্দোলনের সমসাময়িক হয়ে থাকবে। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে বন্ধুদের উদ্দেশে সূর্য সেন লিখে গিয়েছিলেন, ‘আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার একটি সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীনতার স্বপ্ন। প্রিয় কমরেডস, এগিয়ে চলো। সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত। যদি লক্ষ্যে পৌঁছাবার আগে মৃত্যুর শীতল হাত তোমাকেও স্পর্শ করে তবে আরব্ধ কাজের দায়িত্ব তোমার উত্তরসুরীদের হাতে অর্পণ করো’। তারপরই তাঁর লাশ বস্তাবন্দী করে দূরসমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়। বাংলার মাটিতে কোথাও যেন তাঁর চিহ্ন না থাকে। কিন্তু তখন বিরোধী ক্ষমতালোভী শাসকরা জানতেন না 'বিপ্লবী' আত্মার মৃত্যু নেই।

অতীতের সেইসব 'বিপ্লবী' প্রান হাসিমুখে তাঁদের আত্মহুতি দিয়েছিলেন ভাবী প্রজন্মকে 'স্বাধীনতা' উপহার দেবেন বলেই। আমরা আজ 'স্বাধীন', তবু যুদ্ধ-বুলেট-বোমা এখনও জারী রয়েছে এবং যতদিন থাকবে, ততদিন বিপ্লবীদের মনেপ্রানে বেঁচে থাকবেন 'মাস্টারদা' সূর্য সেনেরা।     

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...