“বরফি” সিনেমার সেই দৃশ্যটি নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে, যেখানে রণবীর কাপুর মুখে একটি মুখোশ পরে প্রিয়াঙ্কা চোপড়াকে নিয়ে রিক্সা টানছে। গানটিতে যে মুখোশটি দেখা গিয়েছে সেটি একটি নৃত্যের সঙ্গে যুক্ত । নৃত্যটি সমগ্র ভারতে সেভাবে পরিচিত না হলেও এটি বাংলার লোকসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। নাম ছৌ নৃত্য।
পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার সঙ্গে নৃত্যটি সম্পৃক্ত। বর্তমানে ছৌ নৃত্যটি পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম্য পরিবেশের সীমানা ছাড়িয়ে নিজের পরিচিত তৈরি করে নিয়েছে। দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ছৌ শিল্পীরা তাঁদের নৃত্য পরিবেশনের জন্য নিমন্ত্রিত হচ্ছেন। সিনেমার পাশাপাশি বিভিন্ন মিডিয়ামে ছৌ নৃত্যের ফর্মকে ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে।
পুরুলিয়ার ছৌ নৃত্য আমাদের কাছে বহুল পরিচিত হলেও পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া উড়িশা এবং ঝাড়খন্ডের ছৌ নাচও একই রকমভাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন উড়িষ্যা ও ঝাড়খন্ডের অন্তর্গত বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত ঐতিহ্য অনুযায়ী ধর্মীয় আচারনিষ্ঠ লোকনৃত্যনাট্যের নাম ছৌ নৃত্যনাট্য ।
“ছো”, “ছ”, “ছট”, “ছাউ” অঞ্চলভেদে বিভিন্ন আঞ্চলিক উচ্চারণ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হলেও এর সর্বজনবোধ্য সুপরিচিত নাম “ছৌ”। “ছৌ” নামটি বিভিন্ন আঞ্চলিক নামের সর্বজনসম্মত সাধুরূপ হিসাবে পরিগণিত হয়ে থাকে। বুৎপত্তিগতভাবে “ছৌ” নামটি অন্যান্য আঞ্চলিক নামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
“ছৌ” শব্দের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন মুনির বিভিন্ন মতামত রয়েছে। “ছদ্ম” ( সংস্কৃত শব্দ) , “ছায়া” , “ছাউনী”, “সঙ”, “ছাম” (তিব্বতীয় শব্দ), “ছক্” (মুন্ডারী শব্দ) প্রভৃতি শব্দ থেকে “ছৌ” শব্দের উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করেন। বাংলার পুরুলিয়া ও মেদিনীপুরে ছৌ -এর অর্থ হল “ঢঙ” করা। আবার অনেকের মতে ছৌ নৃত্য ‘ছয় নাচের সমাহার’। প্রচলিত উড়িষ্যা ভাষায় ছৌ শব্দের অর্থ দাঁড়ায় ‘গোপনে শিকারের অনুসরণ করা’। ডাক্তার সুকুমার সেনের মতানুসারে “শৌভিক” বা “মুখোশ” থেকে নৃত্যটির নাম হয়েছে ছৌ৷ কুর্মালী ও ওড়িয়া ভাষায় “ছুয়া” বা “ছেলে” থেকে এই নৃত্যটির নামকরণ হতে পারে বলেও অনেকে মনে করেন।
পূর্বভারতের সেরাইকেলা (ঝাড়খন্ড), ময়ূরভঞ্জ (উড়িষ্যা), পুরুলিয়া (বাংলা) ছৌ নৃত্যের এই তিনধারার মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে কিছু কিছু পার্থক্য রয়েছে। পুরুলিয়া আর ঝাড়খন্ডে মুখোশ ব্যবহৃত হলেও উড়িষ্যার ছৌ নৃত্যে কিন্তু মুখোশ ব্যবহার হয় না। তা সত্ত্বেও তিন ধারার মধ্যে এক গভীর আন্তসম্পর্ক বর্তমান।
বাংলা, ঝাড়খন্ড এবং ওড়িষ্যার রাজনৈতিক সীমানার দিকে লক্ষ্য রেখে বলা যায় যে, ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বিহার এবং উড়িষ্যা, বেঙ্গল প্রেসি়ডেন্সির সঙ্গে যুক্ত ছিল। ১৯৪৮ খ্রীষ্টাব্দের মে মাসে সেরাইকেলা উড়িষ্যা থেকে পৃথক হয়ে যায় এবং বিহারের সঙ্গে যুক্ত হয়। এর আগে পর্যন্ত ময়ূরভঞ্জ ও সেরাইকেলা এই দুই ছৌ অঞ্চল উড়িষ্যার সিংভূম জেলার মধ্যে ছিল। ১৯৫৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা হিসেবে পরিগণিত হয়। এই তিন অঞ্চলের অবস্থানগত নৈকট্য, প্রাকৃতিক পরিবেশ, সংস্কৃতিগত আদান-প্রদান এবং ঝুমুরের বিভিন্ন সুর ও তাল ছৌ নৃত্যকে এক সামগ্রিক তাৎপর্য দিয়েছে।
বিভিন্ন ছৌ অঞ্চলগুলির সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট সংখ্যা অধিকার করে রয়েছে ভূমিজ, হো, সাঁওতাল, মুন্ডা, কুর্মী, ওরাঁও প্রভৃতি বিভিন্ন আদিম অধিবাসী। এঁদের মধ্যে শিকার করার কৌশল রপ্ত করবার জন্য নৃত্যের মহড়া চলত। খরার হাত থেকে রক্ষা পেতে বৃষ্টির জন্যও এই আদিবাসীরা নৃত্য করত। আবার যুদ্ধের কৌশল রপ্ত করার জন্যও এই নাচের মহড়া চলত। ফলে ছৌ নৃত্যের পিছনে এইগুলো প্রেরণা ছিল বলে মনে করা হয়।
আদিবাসীদের মধ্যে ছৌ নৃত্য প্রচলিত ছিল তাদের জীবনধারণের অঙ্গ হিসাবে। পরবর্তীকালে সামন্ত হিন্দু রাজাদের প্রভাবে ছৌ-নৃত্য একটি সুসংবদ্ধ নৃত্যনাট্যের রূপ পায়। রামায়ণ, মহাভারত, কৃষ্ণকথা ছাড়াও রোজকার জীবনের সঙ্গে এই নৃত্য নিবিড় ভাবে যুক্ত। উপজাতিদের বৈশিষ্ট্য, শাস্ত্রীয় রীতির অনুসরণ, গ্রাম্যনৃত্যের সরলতা, যুদ্ধনৃত্যের উদ্দীপনা, মুখোশশিল্পের অনন্যতা এইসব গুণগত বৈশিষ্ট্য ছৌ-নৃত্যকে অভিনবত্ব প্রদান করেছে। নিজের দেশের গন্ডী ছাড়িয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
ছৌ নৃত্যের ত্রিধারার মধ্যে পুরুলিয়া ও সেরাইকেলার নৃত্যশিল্পীরা মুখোশ পরিধান করেন। মাটি, খবরের কাগজ, পুরানো কাপড় প্রভৃতি উপকরণের সাহায্যে মুখোশ নির্মিত হয়। রঙ ও বিভিন্ন উজ্জ্ব সাজে, মুকুটের চাকচিক্যে মুখোশগুলি এক একটি চরিত্র হয়ে ওঠে। সেরাইকেলার নৃত্যের মুখোশগুলি টানা টানা মাধুর্যমন্ডিত, স্বপ্নালু। অন্যদিকে পুরুলিয়ার মুখোশগুলি বীরত্বব্যঞ্জক , দৃপ্ত। পুরুলিয়া জেলার “চড়িদা গ্রামে” অসংখ্যা বর্ণহিন্দু শিল্পীরা মুখোশ নির্মাণ করেন। মুখোশ নির্মাণের ক্ষেত্রে শিল্পীদের ব্যক্তিগত রুচি পছন্দ গুরুত্ব পায় না। এগুলি মূলত পুরাণানুসারী।
ময়ূরভঞ্জের ছৌ নৃত্যের মুখোশের ব্যবহার নেই। ময়ূরভঞ্জের ছৌ নৃত্যকে বলা হয় “রুখ” বা “মার” নাচ। ঢাল ও তলোয়ার সহযোগে আক্রমণ ও প্রতিরোধের অনুশীলন করা হয় এই নৃত্যের মধ্যে দিয়ে। যুদ্ধের অনুশীলন ময়ূরভঞ্জের ছৌ-নৃত্যের মধ্যে প্রাধান্য লাভ করেছে বলে মুখোশের ব্যবহার সেখানে গৌণ হয়ে পড়েছে। মুখোশের ব্যবহার না থাকলেও ময়ূরভ়ঞ্জের ছৌ নৃত্যে মুখাভিনয় নেই।
ছৌ নৃত্যের ত্রিধারার মধ্যে পুরুলিয়ার ছৌনৃত্য সবচেয়ে বেশি সংরক্ষণশীল। এই নৃত্য কোন রাজপরিবারের ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা লাভ না করেও বেঁচে আছে লোকজীবনের বিশ্বাস, ধর্ম ও সংস্কৃতি চেতনায়। ছৌ নৃত্যের বন্য-আদি রূপটি পুরুলিয়ার ছৌ নৃত্যের মধ্যে এখনও বেঁচে আছে।
চৈত্র্য সংক্রান্তিতে শিবের গাজন উৎসবের মধ্যে দিয়েই প্রতি বছর ছৌ-নৃত্যের উদ্বোধন হয় পুরুলিয়া জেলায়। বিভিন্ন গ্রামের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে নৃত্য চলতে থাকে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসব্যাপী। জ্যৈষ্ঠমাসের ১৩ তারিখে রহিন উৎসব হয় । সেইদিন ছৌ নৃত্য পরিবেশিত হয়। তার আগে থেকেই ছৌ নৃত্য করা শুরু হয়ে যায়। চৈত্র-সংক্রান্তির দিন থেকে শুরু করে সারা বৈশাখ মাস এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এই নৃত্য চলে। অবশ্য তার প্রস্তুতি অনেক আগেই শুরু হয়ে যায়। গোটা চৈত্র মাস ধরে চলে ছৌ নৃত্যের অনুশীলন।
পুরুলিয়া জেলার বাঘমুন্ডি থানার চড়িদা গ্রামের চল্লিশটি সূত্রধর পরিবার এবং জয়পুর থানার ডুমুরডি গ্রামের পাঁচটি পরিবার ছৌ নৃত্যের মুখোশ এখনও তৈরি করে চলেছেন।এছাড়া পুরুলিয়ার বিভিন্ন থানার অন্তর্গত গ্রামে বিভিন্নভাবে মুখোশ তৈরি করা হয়ে থাকে।
ছৌ নৃত্যে কেবলমাত্র পুরুষ শিল্পীরা অংশগ্রহণ করতে পারেন। ছৌ নৃত্যের শিল্পীরা কোন সংলাপ উচ্চারণ করেন না। কন্ঠসংঙ্গীতের স্থান ছৌ নৃত্যে নগণ্য। পায়ের সূক্ষ্ম কাজ, শরীরের বিভিন্ন অংশের সুচারু অভিব্যক্তি ছৌনৃত্যের লক্ষ্য করা যায়।দেহভঙ্গিতে আক্রমণ, প্রতিরোধ ও যুদ্ধের প্রস্তুতি লক্ষণীয়।
লাফ দিয়ে শূন্য থেকে এক হাঁটু বা দুই হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসে পড়া, শূন্যে ঘোড়া, বাঘ, সিংহ, হনুমানের অনুকরণে লাফ দেওয়া প্রভৃতি বিভিন্ন প্রক্রিয়া ছৌ নৃত্যে দেখা যায়।ছৌনৃত্যের মধ্যে নৃত্য ও নাট্যের উপাদান একসঙ্গে রয়েছে। লোকধর্মী ও নাট্যধর্মী এই দুই অভিনয়রীতি ছৌনৃত্যের অনুসৃত হয়। এই নৃত্যে পর্যায়ক্রমে, বিলম্বিত, মধ্য, দ্রুত তাল বা লয়কে অনুসরণ করা হয়।
লোকনৃত্য হল অতীত ও বর্তমানের যোগসূত্র। অতীতের ফেলে আসা সংস্কার, বিশ্বাস, স্মৃতি সে নিজের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বয়ে চলেছে। পুরনো সংস্কারের সঙ্গে নতুনের মেলবন্ধন ঘটিয়ে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরে তার গৌরবময় ইতিহাস। ছৌ-নৃত্য হল বাংলা, উড়িষ্যা এবং ঝাড়খন্ডের লুপ্তপ্রায় ইতিহাসের স্বাক্ষর।