"যে দেশেতে তরুলতা সকল দেশের চাইতে শ্যামল" সেই দেশের মানুষের মনও যে সবুজ হবে তা খুবই স্বাভাবিক, আর সেই কারণেই সরল মন খুব ছোটোখাটো খুঁটিনাটি বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে চায়। এই বাংলার আনাচে কানাচে মিশে থাকা সরল লোকবিশ্বাস এর হাজারো রূপ রং গন্ধ, সেই বিশ্বাসের জোরেই কখনো নদী কখনো বনের পশু বা গাছপালা হয়ে ওঠে দেবদেবী অথবা কখনো একটা আস্ত গ্রাম নিজেই এক দেবতায় পরিনত হয়। আজ সেইরকম এক গ্রামদেবতার কথাই বলছি।
গ্রামের নাম ফুলবাড়ি আর দেবস্থানের নাম মাশানপাট, এই মাশানপাটেই দেবতা রূপে বিরাজ করেন মাশান ঠাকুর।মাশান ঠাকুরের প্রতিমাটি মাটির, গায়ের বর্ণ নীল, এক হাতে গদা ধারণ করে মাশান ঠাকুর বসে থাকেন। গ্রামের মানুষ ঠাকুরের থানে নানান মূর্তি উৎসর্গ করেন, তাছাড়াও অনেক রকমের মূর্তির দেখা মেলে এই থানে, মূর্তি গুলি নানান রঙেরও বটে, নীল, লাল, সাদা। কিছু কিছু দেবমূর্তি দেখা যায় যেগুলির বাহন শুকর, আবার কিছু মূর্তি শোলমাছের পাশে অবস্থান করছে, বলাই বাহুল্য যে এই মূর্তি গুলিও মাশান ঠাকুরেরই। কোচবিহার জেলার দিনহাটার খুব কাছেই এই ফুলবাড়ি গ্রাম। গ্রামদেবতা মাশান ঠাকুরের নিত্য পুজো হয়, প্রতি মঙ্গল শনিবার করে আয়োজন করা হয় বিশেষ পুজোর। গোটা গ্রাম ভিড় করে ঠাকুরের থানে। বছরের প্রথম মাস বৈশাখের প্রতি দিনই খুব ধুমধাম হয়, গোটা গ্রাম গমগম করে ওঠে, পাশাপাশি গ্রাম গুলি থেকেও অনেক স্ত্রী পুরুষ এসে ভিড় জমায় মাশান ঠাকুরের থানে।
এই সময়ই দেবতাকে উৎসর্গ করে শূকর, ছাগ ও পায়রা বলি দেওয়া হয়, ঠাকুরের নৈবেদ্য সাজানো হয় ফল, মিষ্টি, পোড়ানো আস্ত শোলমাছ এবং হাঁসের ডিম দিয়ে। সমগ্র কোচবিহার জেলার বিভিন্ন গ্রামে এই বৈশাখ মাসেই গ্রামের পুরুষেরা কালীর মুখোশ পরে নৃত্য করে, স্থানীয় ভাষায় কালীনাচ নামেই পরিচিত হয় এই কার্য্যকলাপ, ফুলবাড়ির পুরুষেরাও বৈশাখ মাসে মাশান ঠাকুরের থানে কালীনাচ দেখায়। ঠাকুরের মন্দিরটি ইঁটের তৈরী, টিন দিয়ে চাল দেওয়া হয়েছে। মন্দিরের পাশেই আছে একটি আটচালা, সেখানে বিশ্রাম নেন পুজো দিতে আসা ভক্তের দল। মন্দির চত্বরের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে ছোট্ট নদী গড়কাটা। গ্রামের কৃষিজীবি মানুষের সংখ্যাই বেশি, তারা ভালো ফসলের জন্য, পর্যাপ্ত বৃষ্টির জন্য, সুস্থ শরীরের জন্য সরল বিশ্বাসে গ্রামদেবতা মাশান ঠাকুরের পুজো দেন। দিনের শুরুতেই দেবতার মুখদর্শন করে তবেই যান চাষের কাজে, এমনকি গ্রাম ছেড়ে কোথাও যাবার আগেও দেবতাকে পুজো দিয়ে তুষ্ট করেন যাতে কোনো বিপদ আপদ না ঘটে। গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষদের লোকবিশ্বাস এতটা সরল হয় বলেই হয়তো তারা মাটির খুব কাছাকাছি থাকতে পারেন।