পুরুলিয়ার বিরহড় উপজাতির বিয়ে-সাদির বিচিত্র রীতি ও বিয়ের গান : পর্ব : দুই

বিয়ের কয়েকদিন আগে থেকেই বিরহড় বসতিতে উৎসবের রঙ লেগে যায়।  বিয়ের দিন সকালে বর ও কনের বাড়ির উঠোনের একপাশে, মাটি সামান্য উঁচু করে চৌকো বেদির আকার দিয়ে, চাদ্দিকে তার চারটি শালের খুঁটি পুঁতে,  ডালপাতার ছাউনি দিয়ে, তৈরি হয় ছাদনা। ‘ছাদনা’কে এরা বলে ‘ছামড়া’। ছামড়াতলায় পুঁতে রাখা হয় আম আর মহুলের ডাল। মহুল ডালের চাদ্দিকে বিচুলির মোটা দড়ি দিয়ে বেড় দেওয়া হয়। পাশে রাখা হয় তিরধনুক, গাড়ু, কুঠার, আর মাটির ছোট ছোট দুটো কলসি। কুঠার আর কলসি দুটি, জল সইতে লাগে।

বরের বাড়িতে জল সইতে কলসি দুটি কাঁখে নেয় বরের দুই বোন। তাদের মাথায় দেওয়া হয় একখানা হলুদ কাপড়ের ঘোমটা,  আর এই কাপড়েরই দুদিকের দুই আঁচল দিয়ে ঢাকা হয় দুই কলসির মুখ। ‘জল সওয়া’–কে এরা বলে ‘দাঃ মামা’। এতে নেচে গেয়ে সঙ্গ দেয় বাড়ির সব এয়ো আর মেয়েরা। তবে, বরের মা থাকেন সবার আগে, তাঁর হাতে থাকে কুঠার। তিনি এই জলের পাত্র আর জল, সমস্ত অশুভ আত্মার দৃষ্টি থেকে রক্ষা করতে পাহারা দেন। জল নেবার আগে, পুকুরে নেমে, ঘাটের দিকে মুখ ফিরিয়ে পিছনের জল কুঠার দিয়ে তিনবার কাটেন। এদের বহুদিনের বিশ্বাস, এতেই নাকি কেটে যায় জলের সব দোষ, অশুভ শক্তির বাধা। এই শুভ জল ছামড়াতলায় রেখে দেওয়া হয় বিয়ের কদিন। তারপর নতুন বউ এলে পরে, নবদম্পতির জীবনে সুখ কামনা করে, একদিন কলসিশুদ্ধ জল পুকুরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

বরের বাড়িতে সকাল সকাল ‘সুনুম সাসাং’, মানে, গায়ে-হলুদের পর্ব সেরে ফেলতে হয়।  তা নইলে, কনের বাড়িতে গায়ে-হলুদের তত্ত্ব পাঠানো যায় না। তত্ত্বে, পাঠানো হয় খানিকটা সরষের তেল আর খানিকটা হলুদ বাটা। সেটা দিয়েই কনের বাড়িতে কনের গায়ে-হলুদের অনুষ্ঠান করতে হয়।

যাই হোক, ফিরে আসি আবার বরের বাড়িতে। সেখানে গায়ে-হলুদ হলে পরে, স্নানটান সেরে বর সাদা ধুতি পরে, গায়ে দেয় সাদা পাঞ্জাবি আর মাথায় বাঁধে সাদা কাপড়ের পাগড়ি। এই হল গিয়ে তার বিয়ের সাজ। তবে এখনই সে বিয়ে করতে যাচ্ছে না, তার আগে রয়েছে 'আম্লাদাঃ নুঃ', মানে 'অম্লজল' খাওয়ার আচার।

অম্লজল আচারে তিন বা পাঁচজন আত্মীয়ের প্রয়োজন হয়। মা-বাবা ছাড়াও মামা-মামি, জেঠা-জেঠি কাকা-কাকি প্রভৃতি গুরুজনেরা এতে অংশ নেন। তবে, প্রথমে এই আচার হয় মায়ের সঙ্গে। মা পা ছড়িয়ে বসেন, ছেলে বসে তাঁর কোলে। অম্ল বা টক আমপাতার বোঁটা ছেলের মুখে তিনি তিনবার দেন। ছেলে সেটা তিনবার চিবিয়ে মায়ের হাতে তিনবার থুক দিয়ে ফেলে। মা তাতে তিনবার জিভ ঠেকান। এই হল অম্লজল খাওয়া। এবার মা ছেলেকে সেই সনাতন প্রশ্নটি করেন, যেটা আপনি হিন্দু বিয়ের পরম্পরায় হামেশাই শুনে থাকেন [হিন্দু পরিবারের ছেলেরা মায়ের কাছে 'দাসী' আনতে যাবার কথা বলে, বিরহড়পুত্র বলে 'কামিন' আনতে যাওয়ার কথা। প্রথমটি অন্তঃপুরের কাজের মেয়ে, দ্বিতীয়টি বাহিরমহল ও ক্ষেতখামারের কাজের মেয়ে। এই যে নারীকে নিছক কাজের প্রয়োজনে বিয়ে করে আনা ও কাজের মেয়ের মতো করে রাখার ঘোষণা; এটি বিরহড় সমাজের নিজস্ব ভাবনা, নাকি পরবর্তীকালে প্রতিবেশী হিন্দু সমাজের প্রভাব থেকে এসেছে; এটা আমার কাছে এখনও স্পষ্ট নয়। যাই হোক: বিরহড় জিজ্ঞেস করেন]—

মা ।। কাহাঁ যাবে, বেটা?

ছেলে ।। কামিন আনত্যে যাব, মা।

মা তিনবার ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন, ছেলে তিনবার একই উত্তর দেয়। এই প্রশ্নোত্তরের পর ছেলে মায়ের বাঁ হাতে আমপাতার তাগা বা ‘কাঁকনা’ বেঁধে দেয়। যেসব গুরুজনেরা অম্লজলে অংশ নেন তাঁরা এই মঙ্গল-চিহ্ন, পুরুষ হলে ডান হাতে আর মহিলা হলে বাঁ হাতে ধারণ করেন।

অম্লজল খাওয়া হয়ে গেলে বর আর ঘরে থাকতে পারে না, তাকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হয়। বিয়ে করে বউ নিয়ে এসে, তবেই সে আবার ঘরে ঢুকবে। প্রথা মতো, যতক্ষণ পর্যন্ত না-বিয়ে করতে যাচ্ছে, ততক্ষণ বাড়ির কাছাকাছি একটি গাছের তলায় সে থাকতে পারে। সারাদিন উপোষের পর এবার সে চাট্টি চিঁড়ে-মুড়ি খেতে পায়। বরযাত্রী ও আত্মীয়েরা তাকে সেখানে সঙ্গ দেয়।

তারপর একসময় বিয়ের জন্য রওনা হবার শুভক্ষণ আসে। নায়া এসে রওনা দেবার ইঙ্গিত দিতেই বরযাত্রীদের গানবাজনা আর হৈ-হল্লায় পুরো মহল্লা মেতে ওঠে। বাবা, মা আর অন্য  গুরুজনদের আশীর্বাদ নিয়ে বর রওনা দেয় কনের বাড়ির উদ্দেশ্যে। ঠিক এই সময়, মায়ের মন যেন কেমন করে ওঠে, ছেলে বুঝি এবার পর হল! তিনি তো জানেন, তাঁদের সমাজে ছেলেরা বিয়ের পর  আলাদা সংসার গড়ে, বেশিদিন মা-বাপের সংসারে থাকে না!...তা হোক...তাঁরই তো ছেলে! তার যে আজ জীবনসঙ্গী বরণ করে নেবার দিন, একী কম সুখের কথা, কম আনন্দের কথা! হে বুরু ঠাকুর, ওদের মঙ্গল করো, ওরা যেন সুখী হয়...যাত্রাপথের মঙ্গল কামনা করে মা আদিম দেবতার উদ্দেশ্যে গলবস্ত্র হয়ে নতজানু হন।

ওদিকে বর ও বরযাত্রী বেলাবেলি কনের বাড়ি পৌছেও ঘরে ঢুকতে পায় না। আসলে, বিরহড় সমাজে বিয়ের লগ্ন যতক্ষণ না লাগে, ততক্ষণ বর আর বরযাত্রীরা কনের বাড়িতে ঢোকার বিধান নেই। তাই এ-সময়টুকু, তাদের আপ্যায়ন করে বসানো হয় ‘বরডেরা’তে। ‘বরডেরা’ বলতে বোঝানো হয়, কনের বাড়ির কাছাকাছি নিকনো কোন গাছেরতলা। এর চার দিকে চারটি আম কিম্বা শালের ডাল রাখা হয়। বর আর বরযাত্রীরা এখানে বসে জিরিয়ে নেয়। তাদের খেতে দেওয়া হয় হাঁড়ি ভরা হাঁড়িয়া।  এরা একে বলে, ‘কাটালা না লাগা’। বিরহড় ভাষায় ‘কাটা’ মানে ‘পা’, ‘আলা’ মানে ‘ক্লান্ত’। আগেকার দিনে বর তো এখনকার মতো মোটরে চেপে বিয়ে করতে আসতো না, আসতো বরযাত্রীদের সঙ্গে পায়ে হেঁটে। অনেকটা পথ হেঁটে সকলেই বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ত। তা, সেই ক্লান্তি দূর করতে তখন এই পানীয় দেওয়া হত, এখনও হয়। আর তাই, তার নামের মধ্যে রয়ে গেছে, সেই আদ্যিকালের স্মৃতি। এই পানীয় দিয়ে আপ্যায়নের  সময় ধামসা-মাদল বাজিয়ে গান গেয়ে কোনেপক্ষের লোকেরা কিন্তু রসিকতা করতে ছাড়ে না।  তারা গাইতে থাকে:

'বাটি বাটি নুয়ালে

দুলারিয়া মায়ে তালে

আলে পেনুর...।'

[এর অর্থ:- হাঁড়িয়া খাচ্ছ খাও, কিন্তু ডালায় করে বের করানোর সময় আমাদের মেয়েকে আবার যেন ফেলে দিওনা।]

বরের বাড়ি থেকে কনের জন্য, কনের মায়ের জন্য একটি ডালায় বেশ কিছু উপহার পাঠানো হয়। তাতে থাকে শাড়ি, জামা, আলতা, সিঁদুর, কাজল, চুড়ি ও নানান রকম গয়না। কনের জন্য পাঠানো হয় সেই হলুদ শাড়িটি, যেটা মাথায় দিয়ে বরের বোনেরা জল সইতে গিয়েছিল। কনের বোনেরাও এই শাড়ি নিয়ে এবার জল সইতে যাবে।

তাই, বর এলে, ও-বাড়ি থেকে হলুদ শাড়িটি এলে, তখন  কনের জন্য জল সইতে যাওয়া হয়। অশুভ আত্মার দৃষ্টি যাতে শুভ কলসির ওপর না-পড়ে, তার জন্য কলসির মুখ আঁচল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। সমস্ত অশুভ শক্তিকে দূরে রাখতে কনের মা কুঠার নিয়ে পাহারা দেন, থাকেন সবার আগে। সঙ্গের এয়ো আর মেয়েরা চলেন গান গেয়ে, নাচতে নাচতে। যে-পুকুর থেকে জল নেওয়া হবে, কনের মা তার জলে নেমে, ঘাটের দিকে মুখ ফিরিয়ে বরের মায়ের মতোই কুঠার দিয়ে পিছনের জল তিনবার কাটেন। এইভাবে জলের শুদ্ধিকরণ করা হয়, তার দোষ কাটানো হয়। কনের বোনেরা কলসিতে জল ভরে, কলসির মুখ ঢেকে সাবধানে উঠে আসে পুকুর থেকে। জল সইতে যায় সমবেতভাবে মেয়েরা গান গাইতে গাইতে, ফিরেও আসে সেভাবেই। এই সময় তারা গায়:

'গাড়া বেড়া দোক্তা রোয়া লিডায়িং,

দোক্তা দো পাণ্ডু-আনা,

পাণ্ডু বুড়ি হন্তে কুড়ি

সিঁদুর বাতি কিয়ায়িং।'

[বাংলা অর্থঃ- নদীর ধার থেকে দোক্তা পাতা তুলে আনলাম। সেও তো শুকিয়ে সাদা হল। পাকা চুলের এক বুড়ির মেয়েকে ধরে নিয়ে এসেছি, সিঁথায় সিঁদুর ঘষে।]

গানে থাকে রঙ্গরস আর অশুভকে দূরে রাখার নিদান। জল সওয়ার শুভ জল এনে রাখা হয় ছামড়াতলায়। সেখানেই থাকে বিবাহের সময় ও তার পরের কয়েকদিন।

কনের বাড়ির 'অম্লজল' আচারটিও করতে হয় বর আসার পর। কনের বাবা-মা ছাড়াও মামা-মামি, কাকা-কাকি, জেঠা-জেঠি এই আচারে যোগ দেন। তবে নিয়ম মতো, তিন বা পাঁচ জনের বেশি কেউ এতে অংশ নিতে পারেন না। আচার শুরু করেন, মা। মার কোলে বসে মেয়ে। একটি আমের বোঁটা তিনি তুলে দেন মেয়ের মুখে, মেয়ে সেটা তিনবার দাঁতে কেটে, তিনবার চিবিয়ে, মায়ের হাতে তিনবার থুক দিয়ে ফেলে। আর মা তাতে তিনবার জিভ ঠেকান। তারপর মেয়েকে তিনি জিজ্ঞেস করেন...

মা ।। কাহাঁ যাবে বিটি?

মেয়ে ।। কামিন খাটতে যাব।

মা তিনবার একই প্রশ্ন করেন, মেয়ে তিনবার একই উত্তর দেয়। এরপর মেয়ে থালা থেকে একটি আমপাতা বাঁধা তাগা তুলে নিয়ে মায়ের হাতে বেঁধে দেয়। যে-সব গুরুজনেরা অম্লজলে অংশ নেন বরের বাড়ির মতোই তাঁরাও এটি ধারণ করেন।  মেয়ের বিয়ের পর তাকে বিদায় দিয়ে, তবে এই তাগা তাঁরা হাত থেকে খুলতে পারেন।

মাহেন্দ্রক্ষণে, বরকে বরডেরা থেকে কাঁধে চড়িয়ে নিয়ে আসা হয় ছামড়াতলায়। সঙ্গে আসে ‘বাগাল’, মানে ‘নিতবর’। ‘বাগাল’ সাজে বরের বন্ধু। এ-সময় বরের সঙ্গে সঙ্গে তাকে থাকতে হয়। এদের বরণ করতে আসেন পাঁচ জন এয়ো—কনের মা, মাসি, পিসি, কাকি, জেঠি—এঁরা। কনের মা থাকেন সবার আগে। তাঁর হাতে থাকে একটি নতুন কুলো, তাতে থাকে হলুদ বাটা, আতপ চাল আর চালের গুঁড়ো। তাঁর পিছনের এয়োদের একজনের হাতে থাকে বেনিয়া গাছের ডাল দিয়ে বানানো একটি মশাল। গাইতে গাইতে তাঁরা বর আর বাগালকে প্রদক্ষিণ করেন তিনবার। প্রতিবার বর-বাগালের গালে মাখিয়ে দেন হলুদ বাটা, বর-বাগালও তাঁদের মাখায়।  বরণ শেষে এখানেই চাটাই পেতে বর আর বাগালকে বসতে দেওয়া হয়।

ছাদনাতলায় বরকে বরণ করার সঙ্গে সঙ্গে একঝাঁক প্রজাপতির মতো মেয়ে-বউ আনন্দ কলরবে মুখর হয়ে হাসির হররা তুলে হৈ হৈ করে ছুটে আসে সেখানে। শুরু হয়ে বিবাহ-পূর্ব আর-এক রঙিন আচারের সূচনা। সেই মনোজ্ঞ আচার ও বিবাহ-পর্বের অনেক অজানা এবং আকর্ষণীয় রীতিনীতির বিস্তারিত বিবরণ জানাবো আগামি তথা শেষ পর্বে। ততক্ষণ ভালো থাকুন, সঙ্গে থাকুন...

 

ছবিঃ প্রতীকী

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...