পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে পুরুলিয়া একমাত্র জেলা, যেখানে সংখ্যালঘু বিরহড় উপজাতির মানুষের বাস। এই উপজাতি সম্পর্কে যেখানে পুরুলিয়ার অধিকাংশ মানুষেরই সম্যক ধারণা নেই; সেখানে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গবাসীর পক্ষে তো তাঁদের সম্পর্কে না-জানাই স্বাভাবিক। গত শনিবারের পর্বে এঁদের সঙ্গে আপনাদের আলাপ করিয়েছি। আজ বলব এই উপজাতির মানুষের বিবাহের রীতিনীতি ও এঁদের বিয়ের গান সম্পর্কে অনেক অজানা কথা। আসুন, শুরু করা যাকঃ
‘বিয়ের ফুল’ বলে যে একটা কথা আছে না, সেটা এই কিছুকাল আগেও, বিরহড় ছেলেমেয়েদের জীবনে যৌবন আসতে না আসতেই ফুটবার সুযোগ পেত। এই যে কম বয়সে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেবার চল, এটা পুরুলিয়ার এই উপজাতি সমাজের একটি বেশ পুরনো রীতি। তবে, এখন তো দিন বদলেছে, ধীরে ধীরে সরকারি নিয়ম মেনে একটু বেশি বয়সে বিয়ে দেবার প্রথাও তৈরি হচ্ছে।
যাই হোক, সাঁওতালদের মতো বিরহড়েরাও বিয়েকে ‘বাপলা’ বলে। একসময় বিরহড় সমাজে বেশ কয়েক রকমের বিয়ের চল ছিল। কিন্তু, এখন মূলত তিন ধরনের বিধি-ব্যবস্থাই বেশি চোখে পড়ে, যথাঃ
এক, ‘বেরিয়াত বাপলা’ বা সম্বন্ধ করে বিয়ে; দুই, ‘সাঙ্গা বাপলা’ বা বিধবা, বিপত্নীক, বিবাহ বিচ্ছিন্নের বিয়ে; আর, তিন, ‘মন-পোষাপুষি বাপলা’ বা ভালবাসার বিয়ে। এই ধরনের বিয়েতে কোন অনুষ্ঠান হয় না। ‘বেরিয়াত বাপলা’ই হল সমাজে প্রচলিত সাধারণ বিয়ে। ‘বেরিয়াত’ মানে, ‘বরযাত্রী’। এই ধরনের বিয়ে সম্বন্ধ করে, সব আত্মীয়স্বজনকে পাশে নিয়ে, সমস্ত সামাজিক আচার-প্রথা মেনে, ধুমধাম করে অনুষ্ঠিত হয়।
বিয়েতে ঘটকালির জন্য আলাদা করে কোন ঘটকের প্রয়োজন হয় না। নিজের গরজে ছেলের বাবাকেই এ-কাজটি করতে হয়। ছেলে ও মেয়ের এক গোত্র হলে বিয়ে হয় না। তাই ভেন্ন গোত্রের পছন্দসই মেয়ের খোঁজ পেলে, ছেলের বাবাকেই সম্বন্ধের প্রস্তাব নিয়ে, প্রথমে মেয়ের বাবার কাছে যেতে হয়। এটাই সমাজের নিয়ম।
ছেলের বাবার দেওয়া প্রস্তাব যদি মেয়ের বাবার মনের মতো না-হয়, যদি তিনি সেই প্রস্তাবে রাজি না-হন, তখন আবার অন্য মেয়ের খোঁজ করতে হয়। আর, যদি রাজি হয়ে যান, তখন দুই হবু বেয়াই আনন্দে কোলাকুলি করে একেবারে আত্মীয়স্বজন নিয়ে—মেয়ে দেখা, কনেপণ দিয়ে তাকে আশীর্বাদ করা, যাকে এঁরা বলেন ‘টাকাচাল’, সেই সব অনুষ্ঠানের দিনক্ষণ একদম ঠিক করে ফেলেন।
‘টাকাচাল’-এর দিন কনের বাড়িতে বরের বাবার সঙ্গে আসেন ‘পাঁচকুটুম’। গাঁয়ের পুরুত-‘নায়া’, পুরুতের সহকারী-‘গডেথ’, দু’এক জন পড়শি আর দু’চারজন আত্মীয় মিলে যে দলটি হয়, তাঁরাই হলেন গিয়ে, ‘পাঁচকুটুম’। কনের বাবা, কনের দাদা তাঁদের সাদরে আপ্যায়ন করে সদর থেকে উঠোনে নিয়ে আসেন। উঠোনে, কনে নিজের হাতে প্রথমে হবু শ্বশুরমশাই, তারপর পাঁচ কুটুমের পা ধুইয়ে দেয়, গড় করে, আশীর্বাদ নেয়। দেখে মনে হয়, এ-যেন হারিয়ে যাওয়া আর্য ঐতিহ্যের ‘পাদ্য-অর্ঘ্য’ শিষ্টাচার।
শুকনো চালের গুঁড়ো দিয়ে, উঠোনে সুন্দর করে একটুখানি আলপনা দেওয়া হয়। আঁকা হয় চৌকো ঘর, ভেতরে ঢ্যারা, বাইরে তার চারকোণে চার ফুল। এর ওপর বিছিয়ে রাখা হয় শালপাতা, কনে এসে বসবে এখানে। আর তার পাশে বিছানো থাকে আর-একটি শালপাতা, এতে বসেন বরের বাবা। পাঁচকুটুম এসে বসেন ঠিক সামনে, খরগোস ধরার জালের ওপর। আচার বলুন, অনুষ্ঠান বলুন, সব এই উঠোনেই করতে হয়। বিয়ে না-হওয়া অব্দি ঘরের ভেতর নতুন কুটুমের ঠাঁই হয় না।
বাইরে যখন সবাই আচার-আতিথেয়তায় ব্যস্ত, তখন, ঘরের ভেতর বাড়ির মেয়েরা কনেকে তাদের মনের মতো করে সাজিয়ে দিতে থাকেন।
পাঁচকুটুমের সামনে কনেকে আনা হয় কোলে তুলে, আনেন কনের বউদি। সামনে রাখা হয় মঙ্গলপাত্র। তাতে থাকে ধানদুব্বো, প্রদীপ আর একখান বিড়ি। কনেপণ দিতে হলে, সে কিন্তু হাতে হাতে সরাসরি দেওয়া যায় না, দিতে হয় এই মঙ্গলপাত্রে।
পণের টাকা বরের বাবা নিজের হাতে দেন না, তিনি এই ভার দেন আর-কাউকে। প্রায়শ এই দায়িত্ব পান বরের মামা। টাকার অঙ্ক কিন্তু সমাজ থেকে বেঁধে দেওয়া, গুনে গুনে তেরো টাকা। টাকা কটি পেয়ে কনের বাড়ির লোক খুশি কিনা, প্রথা মতো, মামা একটু বাজিয়ে দেখে নেন। তিনি পাঁচ কুটুমের মধ্য থেকে উঠে এসে মঙ্গলপাত্রের কাছে বসেন। পকেট থেকে তেরো টাকার কয়েন বের করে একটি একটি করে রাখেন সেই পাত্রের ওপরে।
মঙ্গলপাত্রে সাড়ে তেরো টাকার কয়েন রেখে বরের মামা উঠে দাঁড়িয়ে কনের ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন—
মামা ।। আস্য রে, তুমার বহিনকে তো বিকলে, টাকা দিলম, ইবারে তুমরা গুন্যে লাও কেনে।
তখন কনের ভাই এসে মঙ্গলপাত্রের সামনে বসে। থালা থেকে বিড়িটি তুলে তাতে আগুন ধরিয়ে বাঁ-হাতে আঙুলের ফাঁকে চেপে ধরে। ডান হাত দিয়ে এক একটি কয়েন তুলে বলে-
ভাই ।। এক হাজার, দুই হাজার...
এভাবে তেরো হাজার টাকা পর্যন্ত গোনে আর থালায় রাখে। তখন মামা জিজ্ঞেশ করেনঃ
মামা ।। কত হল্য হে? তুমার বহিনকে কতয় বিকলে?
ভাই ।। বাবু, তেরো হাজার টাকায় বিকলম আমার বহিনকে।
মামা ।। তুমার বহিনকে কি বেশি টাকায় অন্য লোকের কাছে তুমি বিকতে চাও?
ভাই ।। না, আমি যাকে বিকছি তাকেই বিকব, অন্য লোককে বিকব নাই।
উপস্থিত সকলেই এই কথা শুনে খুশি হয়। তখন আনন্দের আবহে শুরু হয়, আশীর্বাদ অনুষ্ঠান। বরের বাবা কনেকে পরিয়ে দেন রূপোর হার। তবে এ তো শুধু হার না, মেয়েটিকে যে কেনা হল, সম্বন্ধ পাকা হল, তারই নিশান। সঙ্গে দেন শাড়ি-জামা। কনে, হবু শ্বশুরমশাইকে প্রণাম করার পর উঠোনে বয়স্ক যারা রয়েছেন, তাঁদের তো প্রণাম করেই, এমনকি যারা তার থেকে বয়সে ছোট তাদেরও এমন দিনে প্রনাম করতে বাধ্য হয়। তবে, নিয়মখানা এমনই মজার যে, এ-নিয়ে উঠোন জুড়ে বেশ আমোদ হয়।
শুভ কাজের শেষে থাকে একটু আনন্দের আয়োজন। বিরহড়দের জীবনে আনন্দ, নাচে আর গানে। আতিথেয়তা, গেলাস ভরা হাঁড়িয়ায়। আর তার প্রতিটি চুমুক মনে রঙ ধরায়। মাদলের বোলে, নাচের তালে তালে, শরীরের বিভঙ্গে সেই রঙ ছড়িয়ে পড়ে আকাশে বাতাসে।
বিদায় নেবার সময় বরের বাবা জেনে নেন, পাঁচকুটুম সঙ্গে নিয়ে কনের বাবা কবে নাগাদ তাঁর বাড়িতে পায়ের ধুলো দেবেন; ঘরদোর দেখবেন আর ছেলেকে আশীর্বাদ করবেন।
বরের বাড়িতে যে অনুষ্ঠান হয়, তার আচার ঠিক ঐ ‘টাকাচালের’ মতন, নামটি আলাদা, এঁরা বলেন—‘দুলহা নেনেন সিনু আবু’। বর ছেলেটি হবু শ্বশুরের পা, পাঁচকুটুমের পা একে একে ধুইয়ে দেয়, প্রণাম করে, আশীর্বাদ নেয়। আপ্যায়ন করে পাঁচকুটুমকে জালের ওপর বসিয়ে, কনের বাবাকে শালপাতায় বসিয়ে, ঘরের ভেতর থেকে বরকে উঠোনে আনা হয়। বরের বোনাই কোলে করে তাকে নিয়ে আসেন। বসিয়ে দেন শালপাতায়।
পাঁচকুটুমের সঙ্গে আসেন কনের দাদুরা। তাঁরা প্রায়শই বেশ রসিক প্রকৃতির লোক হন। এই অনুষ্ঠানে তাঁদের একটু সুযোগ দেওয়া হয় হবু নাতজামাইয়ের সঙ্গে একটু মজা করার, একটু তামাশা করার। আর সেই সুযোগটা দেন বরের দাদু।...
বরের বাড়ির লোকজনের ভিড় থেকে বরের দাদু সামনে এগিয়ে আসেন। খরগোস ধরা জালে বসা পাঁচ কুটুমের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন—
বরের দাদু ।। দেখ হে, আমাদের ছেল্যা কানা, না ঠুঁটো, না ল্যাংড়া! দেখ্যে লাও! আমরা ত ঠিকই জন্মাইছি...
এ-কথা শুনে কনের দাদু/দাদুরা মুচকি হেসে, খরগোসের জাল থেকে উঠে বরের সামনে আসেন।
কনের দাদু ।। এ-ভাই, দেখি, দেখি, দাঁতটা বার করাও ন রে!
বর দুপাটি দাঁত বার করে। কনের দাদু মজা করে সেই দাঁত গোনেন।
কনের দাদু ।। এক দাঁত..দু দাঁত.. হ ভাই, চার দাঁতই আছে।
কনের দাদুর কথা শুনে সবাই হাসে।
কনের দাদু ।। ইবারে ভাই, হাত দুটা দেখাও ন রে!
বর দুহাত তুলে দেখায়। কনের দাদু আঙুল গোনেন।
কনের দাদু ।। এক...দুই... তিন...এই ত ভাই দশ আঙুল, একটাও কম নাই... ই বারে কি দেখি?
বর মজা করে বলে—
বর ।। দাদু হে, দেখ দেখি আমার শরীরটা, তুমার নাতনিকে পুষতে পারব কি নাই!
কনের দাদু তখন মাথা নেড়ে হেলে-দুলে মজা করে বরের দু’হাতের পেশিতে চাপ দিতে দিতে বলেন—
কনের দাদু ।। বা রে দাদু, বাহ, বাঃ...বাঃ...বাঃ...
এই সময় কনের দাদুর ভাবভঙ্গি দেখে সবাই হো হো করে হাসতে থাকে।
এরকম এক প্রস্থ ঠাট্টা-তামাশার পর শুরু হয় আশীর্বাদ অনুষ্ঠান। কনের বাবা হবু জামাইকে ঘড়ি দেন, ধুতি দেন আর দেন গেঞ্জি। হবু জামাই উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে প্রনাম করে সম্মান জানায়, আশীর্বাদ নেয়। এখন, বাকি থাকে শুধু একটাই কাজ, বিয়ের দিনটি ঠিক করে ফেলা।
সেই কাজে যাতে দেরি না হয়, তাই, মুরুব্বিরা এ-দিনই বসে পড়েন পাঁজি-পুঁথি খুলে একটা শুভ দিন, শুভ লগ্ন খুঁজে নিতে। আর সেই লগ্নের সঙ্গে যদি পূর্ণিমা তিথির মিল ঘটে যায়, তবে তো কথাই নেই। কিন্তু, এসব করতে গিয়ে একটা কথা তাঁদের খেয়াল রাখতেই হয়, দিনটা যেন ছেলে বা মেয়ের জন্মদিনে না-পড়ে। তেমন দিনে বিয়ে নিষেধ। বিয়ে করতে যাবার আগে ছেলেকে, আর বিয়ে হলে পরে মেয়েকে বাপ-মা যে বিদায় দেন, সে তো আর জন্মদিনে দিতে পারেন না। তাই, সব দিক বজায় রেখে নায়া বিয়ের দিন ঘোষণা করেন।
তারপরই শুরু হয় বিবাহের দিন ঠিক হওয়ার আনন্দ উদযাপনের প্রস্তুতি। রাত হলে কয়েকটা বড় বড় মশাল জ্বালানো হয়। জ্বালানো হয় কাঠের কুণ্ড। তার মোহিনী আলোয় দেখা যায়, একদিকে অফুরান হাঁড়িয়ার ফোয়ারা ছুটতে; অন্যদিকে একদল পুরুষকে দেখা যায় ধামসা, মাদল, কেসিও বাজিয়ে গান ধরতেঃ
‘শিকার রাজ দ শিকার রাজ
হিজুতে সিনুতে চিউয়া লেদেই
ল লুন্ডিতে যখা লেদেই...’
[গানের বাংলা অর্থঃ ছেলে বলে—আসা যাওয়ার পথে আমি মেয়েটিকে দেখেছিলাম, তখন এতটুকু লাঠিতে তাকে মেপেছিলাম।]
তারই সামনে একদল নারীপুরুষকে হাত ধরাধরি করে, পায়ের তালে তাল মিলিয়ে নাচতে দেখা যায়। এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকা বাকিদের কাউকে গল্পগুজব করতে দেখা যায়, কাউকে কাউকে হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠতে দেখা যায়; আর তারই মধ্যে সবকিছু ছাপিয়ে অপেক্ষার অযুত রঙ পেরিয়ে সপ্তকে বেজে শুভবিবাহের শুভ দিনটির আগমনি সুর...
[আগামি পর্বে আপনাদের শোনাবো বিরহড়দের মজাদার বিবাহরীতির খুঁটিনাটি ও গানের কথা]