পুহান বিয়া উৎসব। অসমের গুয়াহাটিতে কামাখ্যা মন্দিরে দেবী কামেশ্বরীর সঙ্গে কামেশ্বর দেবের বিবাহ অনুষ্ঠান।প্রতি ডিসেম্বরে ধুমধাম করে অনুষ্ঠিত হয় এই বিবাহ অনুষ্ঠান। একান্ন পীঠের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অষ্টাদশ শক্তিপীঠ কামাখ্যাতীর্থ।
দশমহাবিদ্যার অন্যতমা মা কামাখ্যা। ত্রিপুরাসুন্দরী, কালী, সিদ্ধা কুব্জিকা একাধিক নামে তিনি পূজিতা। শক্তির আধার। প্রতি পৌষে কামেশ্বর শিবের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে বাঁধা পড়েন তিনি। অহমীয়ায় কামেশ্বর-কামেশ্বরীর বিবাহ অনুষ্ঠান ‘পুহান বিয়া’ নামে পরিচিত।
যদিও বাংলা পঞ্জিকাতে এই উৎসবের তারিখের উল্লেখ পাওয়া যাওয়া না, কিন্তু পুহান বিয়া অসমের খুব গুরুত্বপূর্ণ উৎসবে। পৌষ মাসে কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতীয়া অথবা তৃতীয়া তিথিতে উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়। পূষ্যা নক্ষত্র যোগে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে বহু মানুষ মন্দির দর্শনে আসেন এই উৎসব উপলক্ষে।
কামেম্বর-কামেশ্বরীর বিবাহের উল্লেখ পাওয়া যায় ব্রহ্মাণ্ডপুরাণের ললিতোপাখ্যানে। কার্তিকেয়র জন্মকাহিনির মধ্যেই এই কাহিনির সূত্রপাত।
মহাদেবের ক্রোধআগুনে ভস্মীভূত কামদেবের ভস্ম থেকে জন্ম হয় ভণ্ডাসুরের। অমিতশক্তি সেই অসুরের তাণ্ডবে ভীত পীড়িত দেবকুল পরাশক্তি জগন্মাতাকে তুষ্ট করতে আয়োজন করেন এক মহাযজ্ঞের। চিৎ-অগ্নি প্রজ্জ্বলিত সেই যজ্ঞকুণ্ড থেকে আবির্ভূতা হন ললিতা-পরমেশ্বরী। শ্রীচক্ররূপ মহারথে তাঁর আগমন।
ব্রহ্মার নির্দেশে সুমেরুশিখরে বিশ্বকর্মা তাঁর জন্য নির্মাণ করেন শ্রীপুর-নগর, যেখানে অনন্তকোটি ব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র অধীশ্বরী রূপে বিরাজ করেন দেবী। তিনি একাকিনী। অবিবাহিতা। ব্রহ্মা তাঁকে অনুরোধ করেন, দেবী যেন পতিবরণ করে যুগলমূর্তিতে দর্শন দেন। কিন্তু তার প্রেক্ষিতে দেবী এক শর্ত দেন। তিনি বলেন, “আমি সদা স্বতন্ত্রা ও আপন স্বাধীন ইচ্ছায় চলি। আমার স্বভাবের অনুরূপ যদি পতি পাওয়া যায়, তাহলেই আমি বিবাহ করব।"
এমন কথায় ব্রহ্মা বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কারণ এমন পতি পাওয়া সহজ নয়। তিনি তখন দেবীকে বলেন “মা, সৃষ্টির আদিতে ব্রহ্ম থেকে প্রকৃতি নির্গত হন। সেই ব্রহ্মও তুমি, প্রকৃতিও তুমি। সব কার্য তুমি। কারণ তুমি একাই। তাই তোমার জন্য পতির সন্ধান আমাদের পক্ষে অসম্ভব, যেহেতু তুমি অদ্বৈতা। তুমি নিজেই কোনও ব্যবস্থা করো।”
তবে দেবীর পতি হিসেবে দেবী পরমেশ্বরীর-ই অভিন্ন স্বরূপ শিব শংকরের কথা ব্রহ্মার মনে হয়েছিল। কিন্তু অতুল ঐশ্বর্যের রাজরাজেশ্বরী এই ভস্মলিপ্ত, শ্মশানচারী ভিখারিকে কি গ্রহণ করবেন! ব্রহ্মার মনের ভাব বুঝতে পেরে শিব তৎক্ষণাৎ তাঁর ভস্মলিপ্ত শ্মশানবাসীরূপ ত্যাগ ক’রে ধারণ করেন দেবীর অনুরূপ পূর্ণশৃঙ্গারময় অনিন্দ্যকান্তি কামেশ্বর রূপ। সেই রূপ দেখে মুগ্ধ হন দেবীও। তিনি হাতে বরমাল্য গ্রহণ করেন তা শূন্যে নিক্ষেপ করেন। সেই মালা এসে কামেশ্বররূপী শিবের কণ্ঠসংলগ্ন হয়। সেই দেবী পরিচিতা কামেশ্বরী নামে। কামাখ্যায় তাঁর বাস।
বছরের পর বছর ধরে দেবী কামেশ্বরীর বিবাহ উৎসব প্রতিপালিত হয়ে আসছে দেবীতীর্থ কামাখ্যা সতীপীঠে। পূষ্যা নক্ষত্রে হয় বলে উৎসবটি কামাখ্যাধামে পূষ্যাভিষেক নামে খ্যাত। কামাখ্যা মন্দিরতীর্থ সেজে ওঠে কামেশ্বর-কামেশ্বরীর বিয়ে উপলক্ষে। ফুল, আলোকমালায় রঙিন হয়ে ওঠে কামাখ্যা পাহাড়।
কামাখ্যা মন্দিরের একটি অংশে স্থাপিত আছে দেবী কামাখ্যার চলন্তা বিগ্রহ। কামাখ্যা পাহাড়ে কোনও মন্দিরেই কোনও বিগ্রহ নেই। যে সব মন্দিরে যে বিগ্রহ দেখা যায় তা কল্পিত দেব বা দেবী বিগ্রহ। দেবস্থানের এই বিগ্রহকে বলা হয় চলন্তামূর্তি।
পাত্রীর অতুল ঐশ্বর্য। তাঁর বিশাল মন্দির ‘কাম’ বাড়ি। মন্দিরের প্রথম অংশে পাথরে খোদিত পঞ্চরত্নের সিংহাসন। তার উপরে অষ্ট ধাতুতে নির্মিত দেবী দুর্গার দশভুজা বিগ্রহ। এটি দেবী কামাখ্যার প্রতিনিধি মূর্তি। দেবী কামেশ্বরী নামে এঁর প্রসিদ্ধি। দেবীর সমস্ত পুজোর অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন করা হয় এখানে।
কামেশ্বর মন্দিরে চলে মহাদেবের বিবাহ আয়োজন। মাঝারি আকারের গোলাকার মন্দির। কামাখ্যায় অন্যান্য মন্দিরের মতোই এর গঠনশৈলী। মন্দিরের চূড়োয় বসানো তিনটি ত্রিশূল। এতটুকু কারুকার্য নেই এর দেওয়ালে। একেবারে সাদামাটা অনাড়ম্বর মন্দির। চেহারা দেখলে বেশ বোঝা যায় পাত্রের আর্থিক ও অন্যান্য অবস্থা মোটেই ভালো না।
পাত্র কামদেব শিব কামাখ্যা পাহাড়ে প্রসিদ্ধি পেয়েছে কামেশ্বর নামে। মন্দিরে নাটমন্দির বলে কিছু নেই। অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে গর্ভমন্দিরের নীচে নামলে একটা চৌবাচ্চার মতো। এরই মধ্যে পীঠ। এখানে সবসময় চুঁইয়ে উঠছে জলধারা। এটি কামকুণ্ড। পবিত্র এই কুণ্ডস্থিত শিলাপীঠে পুজো হয় কামেশ্বর মহাদেবের।
এই উৎসবের দিন সন্ধের মধ্যে সেরে ফেলা হয় মা কামেশ্বরী তথা কামাখ্যা মায়ের সমস্ত পুজোর কাজ ও দর্শনার্থীদের দেবী দর্শন। এবার চলন্তা দেবী মূর্তিকে তোলা হয় ডুলি বা পালকিতে। নানান ফুলে সাজানো হয় ডুলি। অধিবাস বা তিলক উৎসব উপলক্ষে কামাখ্যা মন্দির থেকে যাত্রা শুরু হয় মা কামাখ্যার— গন্তব্য কামেশ্বর মহাদেব মন্দির। ঢাকি ঢুলি, নানান ধরনের বাদ্য বাজনা বাঁশির সঙ্গে ভক্তদের নাচ-গানে গমগমে হয়ে ওঠে পথ। পথের দু’পাশে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মানুষ।
কামেশ্বর মন্দিরে হয় চলন্তা কামেশ্বরের অধিবাস-পর্ব। মঙ্গল দ্রব্যাদি দিয়ে শুভকর্মের পূর্ববর্তী অনুষ্ঠান। তার আগে কামাখ্যা মন্দিরে হয় দেবীর অধিবাস পর্ব।
তারপর কামেশ্বর মন্দির থেকে কামাখ্যা মন্দিরে ফিরে আসে ভক্তেরা। হয় জলযোগ পর্ব। সেই পর্ব মিটলে অধিবাসের ভোজ। কামাখ্যা মন্দির অঙ্গন জুড়ে ম্যারাপ বাঁধা হয়। অগুণিত তীর্থযাত্রী কুপন নিয়ে লাইন দিয়ে খাবার খান।
দ্বিতীয় দিন, বিয়ে। সকালে শুভ মুহুর্ত দেখে দুটো খালি পালকি চলল কামাখ্যা মায়ের ‘সাজন কি ঘরের’ উদ্দেশ্যে। মেয়ে-জামাইকে আনতে সঙ্গে চলে শত শত মানুষ। সঙ্গে ঢাক-ঢোল, তাল বাদ্য, সানাই বাঁশি, কাঁড়া-নাকাড়া।
যথা বিধি মেনে মা কামাখ্যারূপী দেবী কামেশ্বরী, শিবরূপী কামেশ্বর মহাদেবকে পালকিতে আনা হয় ভগবতীর পঞ্চরত্ন মন্দিরে, যেখানে অবস্থান করেন চলন্তা কামেশ্বরী বিগ্রহ। কামাখ্যায় পাণ্ডা পূজারিরা দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। পাত্রপক্ষ আর পাত্রীপক্ষ। সন্ধ্যায় বসে বিয়ের আসর। উভয় পক্ষের পুরোহিতরা বিবাহের মন্ত্রোচ্চারণে শালগ্রামশিলাকে অগ্নিসাক্ষী করে বিবাহ সুসম্পন্ন করা হয়।
বিবাহ ও যজ্ঞাদি অনুষ্ঠান শেষ হয় শাস্ত্রমতে। এবার কামেশ্বর ও কামেশ্বরীর তথা দেবী কামাখ্যার চলন্তামূর্তিকে নিয়ে যাওয়া হয় বলি অঙ্গনে। এখানে সাত পাকে ঘোরানো হয় পাত্র-পাত্রীকে। তারপর উভয়ের মাথা ঢেকে দেওয়া হয় লম্বা কাপড়ে। পান দিয়ে হয় শুভদৃষ্টি বিনিময় অনুষ্ঠান। তারপর বর-কনেকে এনে বসানো হয় পঞ্চরত্ন মন্দিরে। এই অনুষ্ঠানের প্রতিটা কাজ সুসম্পন্ন করা হয় দেশাচার ও শাস্ত্রমতে।
তৃতীয় দিন হয় বধূবরণ মানে বউভাত অনুষ্ঠান। ভোজের এলাহি আয়োজন চলে। ঐতিহ্যবাহী অসমীয়া খাবার ছাড়ায় উত্তর ভারতীয় এবং দক্ষিণ ভারতীয় খাবারের আয়োজন চলে।
কামেশ্বর-কামেশ্বরী বিবাহ বাসর উপলক্ষে বদলে যায় অসমের ছবি। তিন দিন ব্যাপি উৎসবে মেতে ওঠে অসম। রাজ্যবাসী তো বটেই সারা পৃথিবী থেকে পর্যটকরা আসেন বছর শেষের এই সময়ে। কামাখ্যা মন্দিরের নিজস্ব ওয়েবসাইটে এই উৎসবের উল্লেখ আছে। তিথি অনুযায়ী হয় উৎসব।
প্রতি বছর পৌষ মাসের কৃষ্ণা দ্বিতীয়ায় কামেশ্বর-কামেশ্বরীর এই বিবাহ অনুষ্ঠানে বিপুল ব্যয় হয়। সেই ব্যয়ভার বহন করে থাকে রাজ্য সরকার।