১৯৯৪ সাল। বিশ্বকাপ চলছে আমেরিকায়। গ্রিসের বিরুদ্ধে খেলা আর্জেন্টিনার। ফুটবলারের চেহারাটা একটু ভারি হয়ে গিয়েছে। ছোট ছোট চুল। কিন্তু পায়ের কাজ যেন ভ্যান গঘের তুলি। পেনাল্টি বক্সের সামনে ডান পায়ে একটা গড়ানো ক্রস ধরল। সামনে পাঁচ জন প্লেয়ার প্রায় দুর্ভেদ্য মানব প্রাচীর গড়ে তুলেছে। কিন্তু তাতে কী? তিনি তো মারাদোনা। ডান থেকে বাঁ পায়ে নিয়েই একটি শট। নিখুঁত তুলির আঁচড়।
গোটা বিশ্ব মুগ্ধ হয়ে দেখল পাখির মতো ডানা ঝাপটে বল গিয়ে নিশ্চিন্তে আশ্রয় নিয়েছে জালে। কে জানত পরমুহূর্তেই নেমে আসবে সবচেয়ে বড় বিতর্ক। মারাদোনাকে ড্রাগ নেওয়ার অপরাধে বিশ্বকাপ থেকে নির্বাসিত করা হয়েছে। মারাদোনা হাউহাউ করে কাঁদছে আর বোঝাতে চাইছে তাকে ফাঁসানো হয়েছে। সেদিন সারা বিশ্ব নিশ্চিত কেঁদেছিল। কেঁদেছিল এই পৃথিবীর প্রতিটি মাঠের প্রতি ঘাস। প্রতিটি গোলপোস্ট। এভাবেই বিতর্ক এবং দুরন্ত ফুটবল নিয়ে মানুষের হৃদয়ে থেকে গিয়েছেন ফুটবলের রাজপুত্র। না হলে কেউ নিজেকে নিজেই সেরা ঘোষণা করতে পারে না।
আদ্যন্ত বামপন্থী এই মানুষটি চিরকাল অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে এসেছেন। চিরটাকাল ঠোঁট কাটা মানুষ হিসেবেই পরিচয় পেয়েছেন। আর সেই কারণেই পেয়েছে দুর্বিনীত আখ্যা। নাপোলিতে খেলার সময় হঠাৎই মনে হয়েছিল 'আমি কেন বেশি টাকা পাব! বাকি প্লেয়াররা কেন আমার সমান টাকা পাবে না!' সেই দাবিতে ক্লাবে বিক্ষোভ শুরু করে ছিল। কেউ একজন বলেছিল 'পেলেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সাথে বসিয়ে দিলে পৃথিবীর আর্থ - সামাজিক - রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ১৫ মিনিট আলোচনা করে নিতে পারবে। আর মারাদোনা হয়তো ৫ মিনিট বাদে এক চড়ই বসিয়ে দেবে'।
সেই মানুষটা বারংবার আমেরিকার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে, বিদ্রোহের ফুল ফুটিয়েছে, নির্দ্বিধায় বলতে পেরেছে "I hate everything that comes from the United States. I hate it with all my strength." তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ আমেরিকা ছেড়ে দেবে এটা বিশ্বাস হয় না। কোথাও হয়তো ফিদেল কাস্ত্রোর এই শিষ্যটির বিরুদ্ধে গোপন রাগটি অন্যভাবেই পুষিয়ে নিয়েছিল। এই ঘটনার পর কেউ একজন বলেছিল 'আমি যে কোনও প্লেয়ারকে ড্রাগ খাইয়ে মাঠে নামাচ্ছি। মারাদোনার মতো খেলে দেখাক'।
১৯৭৮ -এ মারিও কেম্পেসের নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ ফুটবল জেতার পর ৮২ সালে ছোট্ট মারাদোনাকে নিয়ে প্রবল আবেগ তৈরী হয়েছিল আর্জেন্টিনার জনমানসে। কিন্তু মারাদোনা ৮২'তে তুমুল ব্যর্থ হয়। ছোটখাটো চেহারা এবং কমবয়সী মারাদোনাকে মাঠে প্রবল ট্যাকলের সামনে প্রায় দাঁড়াতেই দেয়নি। সারা দেশ জুড়ে এই প্রতিভার বিরুদ্ধে লেখা হতে থাকে বহু কথা। বরাবরের আবেগী মানুষটা রাগে দুঃখে বুয়েনস এয়ারস ছেড়ে দূরে গ্রামে চলে যায়।
সেখানে তার কাজ তখন সারাদিন মাছ ধরা। সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন যে ফুটবল আর খেলবেন না। কিন্তু কোচ কার্লোস বিলার্দো বুঝেছিলেন এই আবেগী ছেলেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বোঝাতে হবে সমালোচনাও খেলার একটা অংশ। সেটিকে পজিটিভ ভাবে গ্রহণ করতে হবে। এই প্রতিভাকে এত সহজে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। বিলার্দো খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে যান সেই গ্রামের বাড়িতে। মারাদোনা কাঁদতে কাঁদতে বললো 'ওরা খেলতেই দেয় না মাঠে। খালি মারে। দেশের মানুষও বোঝে না। আমি কি ইচ্ছে করে এমন করেছি। আমি আর ফুটবল খেলব না'। বিলার্দো বুঝিয়ে মাঠে ফেরালেন মারাদোনাকে৷ বাকিটা ইতিহাসের পাতায় উঠে গেল চিরকালের জন্য।
পৃথিবীর ফুটবল পাগল মানুষদের একটি চিরকালীন প্রশ্ন, ফুটবলার হিসেবে কে বড়, পেলে না মারাদোনা? এই প্রশ্নে আড়াআড়ি দু'ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে ফুটবল সমাজ। কিন্তু এই প্রশ্নের সোজাসাপটা জবাব মারাদোনার মুখ দিয়ে বেরিয়েছে "There would be no debate about who was the best footballer the world had ever seen - me or Pele. Everyone would say me" নিজের যোগ্যতা এবং দক্ষতা সম্পর্কে কতটা আত্মবিশ্বাস থাকলে এ কথা বলা যায় স্পষ্ট ভাবে৷ আর বাস্তবিকই, পেলের বিশ্বকাপ জয়গুলির সময় তার পাশে ছিল ভাভা, ডিডি, গ্যারিঞ্চা সহ বিশ্বের আরো সব শ্রেষ্ঠ। নামকরা প্লেয়ার।
কিন্তু মারাদোনার সময়ে? মনে করতে পারেন পাঠক আর ঠিক কে ছিল সেই ৮৬ কিংবা ৯০-এর টিমে একটা বুরুচাগা কিংবা একটা ক্যানিজিয়া ছাড়া। নাপোলির মতো একটা ছোট্ট ক্লাবকে একার পায়ে সেরি-আ জিতিয়ে দিতে পারে যে লোকটা তাকে শ্রেষ্ঠত্বের তকমা দিতে বাধা কোথায়! পেলে সম্ভবত একবার বলে ছিল 'ওকে আগে তিনবার বিশ্বকাপ জিততে বলো, তারপর আমার সাথে নিজের তুলনা করতে আসবে'। মারাদোনার দ্রুত প্রত্যুত্তর ছিল 'ওকে আগে নাপোলিতে এসে সেরি-আ জিততে বলো, তারপর আমার সাথে নিজের তুলনা করতে আসবে।'
ফুটবলার জীবনের শুরুতেই মারাদোনার একটা বিশ্রী অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তখন তাঁর বয়স তেরো চৌদ্দ। দেশের হয়ে উরুগুয়েতে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে গেছেন। কর্তারা প্লেয়ারদের হোটেলে না রেখে একেক জনকে একেক পরিবারের সঙ্গে রেখে ছিলেন সেখানে। সব প্লেয়ার ভালো ভালো পরিবারের সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু মারাদোনা বস্তির ছেলে। তাই ঠাই পান কালো চামড়ার এক বেকার যুবকের ঘরে। মারাদোনা খুব দুঃখ পেয়ে ছিলেন এই অবহেলায়। বাড়ি ফিরে মাকে জিজ্ঞেস করে ছিলেন, "ওরা আমার সঙ্গে এই রকম ব্যবহার করল কেন মা?" তোতা বলেন, "মন খারাপ করিস না। ভাল খেলে তুই উত্তর দিয়ে এসেছিস।"
মারাদোনার সারা জীবন জুড়ে ছিলেন তাঁর মা তোতা। পরিবারের প্রতি তাঁর অদ্ভূত টান। বিরাশির বিশ্বকাপের আগে জার্মানির সঙ্গে প্রীতি ম্যাচ রিভারপ্লেটের মাঠে। লোথার ম্যাথেউজ খেলতেই দিলেন না তাঁকে। গ্যালারি থেকে বিদ্রুপ ভেসে আসতে লাগল। সেই সঙ্গে মা বাপ তুলে অকথ্য গালিগালাজ। মারাদোনা সহ্য করতে না পেরে এক দর্শককে মেরে বসলেন। ব্যাস পরদিন তাঁর তুমুল সমালোচনা হল।
রেগে মারাদোনা চলে গেলেন তাঁর পৈতৃক ভিটেতে| Buenos Aires থেকে অনেক দূরে এস্কিনো বলে এক জায়গায়। সেবার বিশ্বকাপ টিমের কোচ লুই সিজার মেনোত্তি। বারবার তিনি লোক পাঠানো সত্ত্বেও মারাদোনা বসে রইলেন সেখানে। বলে পাঠালেন, তিনি মাছ ধরায় ব্যস্ত। পাল্টা প্রশ্ন করলেন তিনি, "একটা ম্যাচ বাজে খেললেই কেন লোকে গালি দেবে মা তুলে? আমার মা হলেন পৃথিবীর সেরা মা। ওঁর জন্য আমি সব কিছু ত্যাগ করতে পারি।"
পেলের মতোই হতদরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছেন মারাদোনা। শ্রমিক বাবা চিতোরো আর পরিচারিকা মা তোতার সঙ্গে তিনি থাকতেন ভিসা ফিওরিতার এক বস্তিতে। সেখানকার নালাতে তিনি ডুবে যাচ্ছিলেন দু বছর বয়সে। কাকা দেখতে পেয়ে তাঁকে তুলে আনেন। শুনেছি, তোতার যেদিন প্রসব বেদনা ওঠে সেদিন বড় ফুটবল ম্যাচ ছিল। রেডিওতে ধারা বিবরণী চলছিল।
যখন পৃথিবীর মুখ দেখবেন সেই সময়ে না কি তোতা প্রচণ্ড চিৎকার করে ওঠেন গোওওওওলল বলে। সেদিন ওই হাসপাতালে জন্ম নেওয়া সব কন্যা সন্তানের মধ্যে একমাত্র মারাদোনাই ছিলেন পুত্র। সবাই তোতাকে বলে ছিলেন, "দেখো তোমার এই ছেলে একদিন নামী ফুটবলার হবে।" শুনে আনন্দে তোতা কেঁদে ফেলেন। সেদিন তিনি ভাবতেও পারেননি এই ছেলে নিঃস্ব থেকে একদিন বিশ্ব জয় করবে।
পশ্চিমবঙ্গে এসে মানুষটি একজনের সাথেই ব্যক্তিগত আলাপচারিতার ইচ্ছা প্রকাশ করে ছিল। তার নাম জ্যোতি বসু। মানুষের প্রবল উন্মাদনায় বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল 'আমি ভাবতেই পারিনি ভারতে আমার এত ফ্যান আছে।' সাক্ষাৎ ফুটবল ভগবানের দর্শন পাওয়ার আবেগে ব্যাকুল হয়ে পড়ে ছিল আমাদের বঙ্গদেশ।
একটি প্রজন্ম ফুটবলপ্রেমী হয়ে উঠছে কোনও একজন মানুষের জন্য এরকম দৃষ্টান্ত ফুটবলের ইতিহাসে আর নেই। এখনও কত প্রৌঢ়ের ট্রাঙ্ক খুললে দেখা যাবে তাতে ন্যাপথালিন দিয়ে রাখা রয়েছে একটা ফিকে হয়ে যাওয়া নীল সাদা ১০ নং জার্সি। তার ভেতরে মুড়ে রাখা কিছু না ফুরনো আবেগ, কিছু নিখাদ ভালোবাসা আর অমর হয়ে যাওয়া একটা উক্তি "I am Maradona, who makes goals, who makes mistakes. I can take it all, I have shoulders big enough to fight with everybody."