মানিকতলা ক্রিস্টিয়ান সেমেট্রি। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে এই সেমেট্রিটি মানিকতলায় রয়েছে। পার্ক স্ট্রিট সেমেট্রি যতটা পরিচিত মানিকতলা সেমেট্রির পরিচিতি সেভাবে নেই বললেই চলে। পার্ক স্ট্রিটে যদি অধিকাংশই ব্রিটিশদের নিদ্রাস্থল হয় তাহলে মানিকতলা হল বাঙালি খ্রিষ্টানদের শয়নস্থান। মানিকতলা ক্রসিং আর সুকিয়াস স্ট্রিট থেকে কিছুটা এগিয়ে লেপ্রসি হসপিটালের পাশেই আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোডের উপরে রয়েছে এই সেমেট্রি।
আগেই লিখেছি এখানে চির বিশ্রাম নিচ্ছেন বাঙালি খ্রিষ্টান কৃতি মানুষ। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন কবি তরু দত্ত। তিনি প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষায় কবিতা লিখেছেন। শুধু তাই নয়, বিদ্যালয়ের প্রথাগত শিক্ষাও তাঁর ছিল না। সেদিক থেকে তিনি এবং তাঁর দুই ভাই-বোন অরু দত্ত এবং অবজু দত্ত প্রথম গৃহশিক্ষক দ্বারা প্রাপ্ত শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। বাড়িতে ইংরেজি গৃহশিক্ষক রেখে বাবা গোবিন চন্দ্র তাঁদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। ভাই-বোন এবং বাবা গোবিন চন্দ্র এবং মা ক্ষেত্রমণিকে নিয়ে মানিকতলা সেমেট্রিতে চির নিদ্রায় রয়েছেন কবি তরু দত্ত। কেউ তাঁদের খোঁজ রাখে না। কদাচিৎ কেউ কেউ সেখানে এসে তাঁদের দেখে যান। চারিদিকে গাছপালা আর প্রায় অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় শায়িত আছেন বাংলার নবজাগরণ এবং ভারতের ইন্দো-অ্যালো সাহিত্যের পথিকৃৎ কবি তরু দত্ত ও তাঁর পরিবার।
মানিকতলা সেমেট্রিতে ঢুকে উত্তর পূর্ব কোণ বরাবর এগিয়ে গেলে একটি আয়তাকার জায়গা দেওয়াল দিয়ে ঘেরা অবস্থায় দেখা যাবে। সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে প্রথমে চোখে পড়বে কবি তরু দত্তের দাদা অবজু দত্তের সমাধি। চোখ একটু ঘোরালেই তরু দত্তের স্মৃতিফলক। তারপর একে একে সমাধিস্থ রয়েছেন গোবিন চন্দ্র দত্ত, অরু দত্ত, তরু দত্ত এবং তাঁদের মা ক্ষেত্রমণি দেবী।
১৮৫৬ সালের ৪ মার্চ রামবাগানের দত্ত পরিবারে কবি তরু দত্তের জন্ম। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, উপন্যাসিক, প্রবন্ধকার এবং অনুবাদক। তাঁকে ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্য জগতের পথিকৃৎ বলা যায়। ইন্দো-অ্যাংলো সাহিত্যের জগতে ডিরোজিও, মনমোহন ঘোষ এঁদের সঙ্গে এক আসনে তাঁকে বসানো হয়।
রামবাগান দত্ত পরিবার তৎকালীন কলকাতায় পরিচিত ছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতির জগতে তাঁদের অবদানের জন্য। ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণ দ্বারা প্রভাবিত ছিল গোবিন চন্দ্র দত্তের পরিবার। গোবিন্দ চন্দ্র দত্তের পিতা ছিলেন রমসয় দত্ত। তিনি ছিলেন আদালতের বিচারক এবং হিন্দু স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এই স্কুল সেই সময় নবজাগরণ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
কবি তরু দত্তের ছ'বছর বয়সে অর্থাৎ ১৮৬২ সালে গোবিন চন্দ্র দত্ত খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। এর তিন বছর পর তরু দত্তের দাদা অবজু দত্ত মাত্র ১৪ বছর বয়সে মারা যান। ছেলে মারা যাওয়ার পর গোবিন চন্দ্র দত্ত দুই মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে ১৮৬৯ সালে ইউরোপে চলে যান। যে ক'জন ভারতীয় মহিলা সমুদ্র পথে ইউরোপে পাড়ি দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে পুরোধা ছিলেন কবি তরু দত্ত এবং তাঁর দিদি অরু দত্ত।
ফ্রান্সে গিয়ে ফরাসি ভাষার চর্চা শুরু করেন। ফরাসি সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন। দু'বছর পর ফ্রান্স থেকে তাঁরা কেমব্রিজে চলে যান। ১৮৭২ সালে কবি তরু দত্ত এবং তাঁর দিদি অরু দত্ত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারাবাহিক বক্তৃতা সভায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান। সে সময় কেমব্রিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচনা সভায় মেয়েদের অংশগ্রহণ করার সুযোগ ছিল না। সেখানে কবি তরু ও তাঁর দিদি কেমব্রিজের বক্তৃতা সভায় অংশগ্রহণ করেন। ১৮৭৩ সালে বড়ো মেয়ে অরু দত্তের অসুস্থতার জন্য একপ্রকার বাধ্য হয়ে দত্ত পরিবার কলকাতায় ফিরে আসে। ১৮৭৪ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে মারা যান অরু দত্ত।
এরপর তরু দত্ত সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন। পরবর্তী তিন বছর ১৮৭৪ মার্চ থেকে ১৮৭৭ সালের মার্চ পর্যন্ত "বেঙ্গল ম্যাগাজিন" এবং "ক্যালকাটা রিভিউ" পত্রিকায় কবি তরু দত্তের ইংরেজি গদ্য ও পদ্যের অনুবাদ একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকে। ১৮৭৪ সালে "বেঙ্গল ম্যাগাজিন" পত্রিকায় প্রকাশিত হয় "অ্যান ইউরোসিয়ান পয়েট" এবং ফরাসি রোমান্টিক কবি নিকোল দি লিসেল আর জোসেফিন সোলারির দুটি প্রবন্ধ। ঐ একই পত্রিকায় ১৮৭৫ সালের জুন-জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ভিক্টোরিয়া হুগো এবং এম ডলফিনের দুটো রাজনৈতিক প্রবন্ধের অনুবাদ।
ফরাসি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ শুরু করেছিলেন তরু দত্ত ও তাঁর দিদি অরু দত্ত। অরু দত্ত মারা যাওয়ার পরও তিনি অনুবাদের কাজ চালিয়ে যান। সেই অনুবাদ ১৮৭৬ সালে " A Sheaf Gleanad in French Fields" নামে ভবানীপুরের একটি ছোট্ট প্রকাশনা সংস্থা "সাপ্তাহিক সম্বাদ প্রেস" থেকে প্রকাশিত হয়। একমাত্র এই বইটি তিনি জীবিত অবস্থায় দেখে যেতে পেরেছিলেন। তবে প্রথম প্রকাশের সময় বইটিতে কোন ভূমিকা ছিল না। তাঁর মৃত্যুর পর দ্বিতীয় বার বইটি পুনঃ মুদ্রিত হয় এবং তার ভূমিকায় বাবা গোবিন চন্দ্র দত্ত মেয়ের স্মৃতি তর্পণ করেছিলেন। তৃতীয় বার বইটি মুদ্রণের সময় প্রায় দু'শোটি কবিতা একত্রিত করা হয় এবং লন্ডন থেকে ১৮৮০ সালে প্রকাশ করেন মেসার্স কেগান পল।
তরু দত্তের লেখা ইংরেজি উপন্যাস "Bianca" জীবিত অবস্থায় তিনি প্রকাশিত হতে দেখে যেতে পারেন নি। "বেঙ্গল ম্যাগাজিনে" ১৮৭৮ সালে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে এটি প্রকাশিত হয়েছিল। তরু দত্তের ফরাসি উপন্যাস " Le Journal de Mademoiselle d' Arvers" ফ্রান্স থেকে প্রকাশিত হয় ১৮৭৯ সালে। "Ancient Ballads and Legends of Hindustan" প্রকাশ করেন মেসার্স কেগান পল ১৮৮২ সালে লন্ডন থেকে। সংস্কৃত সাহিত্য রামায়ন, মহাভারত এবং বিষ্ণু পুরাণের গল্পকে তিনি নিজের মনের ছন্দে রাঙিয়ে তুলেছিলেন।
No weariness, O Death, I feel
And how should I, when by the side of Satyavan? In woe and weal
To be a helpmate swears the bride
This is my place; by solemn oath
Whereve thou conducted him
I tool must go, to keep my troth........
সাবিত্রির মুখ দিয়ে ব্যালাডে এই কথাগুলো বলিয়ে ছিলেন কবি তরু দত্ত।
ফ্রান্সে থাকাকালীন ম্যারি মার্টিনের সঙ্গে তরু দত্তের পরিচয়। পরে তা গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হয়। তাঁকে লেখা একটি চিঠিতে তরু দত্ত নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। দিদি অরু দত্তের মৃত্যুর পর তাঁর মন এবং শরীর যে খুব একটা ভালো নেই সে কথা তিনি মার্টিনকে জানিয়েছিলেন। নিজের মৃত্যু নিয়েও বেশ চিন্তিত ছিলেন। তাঁর এই চিন্তা সত্যি প্রমাণিত হয়। ১৮৭৭ সালের ৩০ আগস্ট মাত্র ২১ বছর বয়সে টিউবারকিউলিসে আক্রান্ত হয়ে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান।
ঊনিশ শতকের ফরাসি সমালোচক জেমস দ্রামেস্ত্রার কবিকে নিয়ে লিখেছিলেন- বাংলার কন্যা, যিনি জাতিতে ভারতীয়, শিক্ষায় ইংরেজ, মনের দিক থেকে ফরাসি। যাঁর হৃদয়ে তিনটে সংস্কৃতির পরম্পরা মিশেছিল। অল্প বয়সেই যাঁর প্রতিভা সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হয়েছিল। তিনি মাত্র ২১ বছর বয়সে মারা গেলেন। এইরকম প্রতিভার অধিকারিকে বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাস মনে রাখবে। দুঃখের বিষয় এই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারিণী আজ মানিকতলা ক্রিস্টিয়ান সেমেট্রিতে অবহেলায় শায়িত রয়েছেন।