কালীকথা: মানিকোড়ার ডাকাতে কালী

ডাকাত আর কালী পুজো, এই দুই জিনিসই এ বাংলায় মানিকজোড় হয়ে গিয়েছি। ডাকাতদের আরাধ্যা দেবী হলেন কালী। ডাকাতে কালী! কারণ কালীর আরাধনা করেই ডাকাতরা ডাকাতি করতে যেত। তেমনই এক ডাকাতে কালী হলেন মালদহের মানিকোড়া কালী। একসময়ে ডাকাতদের করা কালী পুজোই আজ সর্বজনীন। একদা ডাকাতদের হাতে পূজিতা দেবীই এখন মানিকোড়া কালী নামে পরিচিত।

 

স্থানীয় লোককথা অনুযায়ী, আজ থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগে, গভীর রাতে, অন্ধকারে পুনর্ভবা নদী পেরিয়ে জঙ্গলে ঘেরা মানিকোড়ায় এই দেবীর পুজো দিতে আসত একদল ডাকাত। শোনা যায় মশাল জ্বালিয়ে তারা মাতৃ আরাধনা করত এবং সূর্যোদয়ের আগেই কালী পুজো শেষ করে, আবার ডেরায় ফিরে যেত। সেই কালী আজও পূজিত হয়ে আসছেন। ব্রিটিশ আমলে স্থানীয় এক জমিদার ভৈরবেন্দ্র নারায়ণ রায় জঙ্গলে ঘেরা ঐ জায়গায় বহুদিনের পরিত্যক্ত পুজোর বেদি খুঁজে পান।

 

তারপর থেকে তারাই বংশপরম্পরায় এই পুজো করে আসছেন। জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ার পরেও মালদহের হবিবপুর থানা এলাকায় গ্রামবাসীদের উদ্যোগে এই ডাকাতে কালীর পুজো হয়ে আসছে। গ্রামের যে কোনও শুভ অনুষ্ঠান হওয়ার আগে, আজও দেবীর পুজো দেওয়ার রেওয়াজ রয়ে গিয়েছে। প্রতি সপ্তাহে শনি মঙ্গলবার ছাড়াও আষাঢ়, কার্তিক, অগ্রহায়ণ মাসে দেবীর বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। এখনও এখানে সাড়ে সাত-হাতের দেবী মূর্তি তৈরি হয়। দেবীর মাহাত্ম্যের নানা কাহিনী এখনও মানুষের মুখে ঘোরে ফেরে।

 

manikora1

 

এই পুজো নিয়ে নানা কথা প্রচলিত রয়েছে, হাড় হিম করা সেসব গপ্পো! যা রক্তস্রোত ঠাণ্ডা করে দিতে পারে নিমেষে। যেহেতু ডাকাতেরা গভীর রাতে এই পুজো করত, তাই নিশব্দে মায়ের আরাধনা করা হত। তাই প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, এই মা কালি নাকি কোনরকম আওয়াজ শুনতে পছন্দও করত না। ডাকাতেরা পুজোর পরে দেবীর উদ্দেশ্যে বলি দিত। শোনা যায় নরবলিও নাকি দিত ডাকাতরা। জনশ্রুতি অনুযায়ী, বলির সময় মা কালী নড়ে উঠত। তাই মায়ের পায়ে শিকল বেঁধে রাখা হত। জনশ্রুতি অনুযায়ী, আজও কালী পুজোর গভীর রাতে এই দেবীমূর্তি কেঁপে ওঠে। বলির সময় মায়ের মূর্তি সামনের দিকে ঝুঁকে পড়তে চায়। মূর্তি যাতে পড়ে না যায়, সে জন্য দেবী মূর্তিকে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার প্রচলন ছিল। এখন চক্ষুদান ও বলির সময় দেবীর মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। যাতে দেবী বলি না দেখতে পান। আজও বলি দেওয়ার প্রচলন রয়েছে এখানে, আজও মায়ের পুজোয় প্রায় হাজার খানেক ছাগ বলি হয় এখানে। এই পুজো নিয়ে নানান গল্প প্রচলিত রয়েছে।

 

শোনা যায়; একদা কোনও এক সময় ওই গ্রামে শাখা ফেরি করতে গিয়েছিলেন জনৈক এক শাঁখারি। গ্রামের রাস্তায় এক বালিকা তার কাছে শাঁখা পরতে চায়, শাঁখারিও মেয়েটির হাতে শাঁখা পরিয়ে দেন। কিন্তু দাম চাইতেই ওই বালিকা বলে ওঠেন, তার কাছে কোনও টাকা পয়সা নেই। তার বাবা কালী মন্দিরের পুরোহিত, তিনিই দাম দিয়ে দেবেন। সেই মতো ঐ শাঁখারি কালী মন্দিরে  গিয়ে পুরোহিতের কাছে শাঁখার দাম চান। অবাক হয়ে যান ওই পুরোহিত। তিনি বলেন, তাঁর কোন মেয়ে নেই। কে শাখা পরেছে? তাঁর দাম তিনি কেন দেবে? এই কথাবার্তা চলতে চলতে হঠাৎই তাঁর নজর যায় মন্দিরের পাশের পুকুরের দিকে। তিনি দেখতে পান জলের উপরে একটি মেয়ে দুই হাত উঁচু করে রয়েছে। দুটি হাতেই রয়েছে একজোড়া নতুন শাঁখা। তিনি বুঝে যান, ওই মেয়ে আর অন্য কেউ নন, স্বয়ং মা কালী। শাখার দাম মিটিয়ে দেন তিনি।

 

এছাড়াও এই মন্দির ঘিরে আরেকটি কাহিনি প্রচলিত রয়েছে, ওই গ্রামে বেশ কিছু পরিবার এসে বসবাস শুরু করে। যাঁদের জীবিকা ছিল চিড়ে তৈরী করে বিক্রি করা। কথিত রয়েছে, মা কালি নাকি রাতে আওয়াজ করা পছন্দ করে না। কিন্তু ওই গ্রামবাসীরা রাতেই চিড়ে বানাত, যার ফলে আওয়াজ হত। কথিত আছে, মা বেশ কয়েকবার ওই চিড়ে বিক্রেতাদের স্বপ্নাদেশও দেন। কিন্তু তবুও তারা না শোনায় গ্রামে কলেরা রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। বেশ কিছু লোক মারাও যায়, গ্রাম উজাড় হতে শুরু হয়। এরপরেই তারা রাতে চিড়ে তৈরী করা বন্ধ করে দেয়, রোগও নিরাময় হয়ে যায়। এইভাবেই গল্প কথা, জনশ্রুতি, লৌকিক ইতিহাস আর মানুষের বিশ্বাস মিলে মিশে এক হয়েগিয়েছে। এই কালী পুজোতে আজও এখানে ভক্তদের উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। সাতদিন ধরে চলে কালি পুজোর মেলা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...