বাংলা সাহিত্যে বন্দ্যোপাধ্যায়দের বড্ড ছড়াছড়ি। এও এক ব্যানার্জী! এক্কেবারে খাঁটি মানিক। চার ভাইবোনের পর ব্যানার্জীবাড়িতে জন্ম নিল ঘুটঘুটে এক কালো ছেলে, গায়ের রং দেখেই আঁতুড়ঘরে নাম দিয়ে দেওয়া হল কালোমানিক। পরে এ ছেলেও নিজের নাম জগৎ বিখ্যাত করে তুলেছিল।
বামুনের ছেলে, তাই প্রথা মতো গণক ডেকে ঠিকুজি কুষ্টি তৈরি করা হল। ঠিকুজিতে নাম রাখা হল অধরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই নামে তাঁকে কেউই কোনওদিন ডাকেনি।
এমন কী বাবা হরিহর সাধ করে ছেলের নাম রাখলেন প্রবোধকুমার। সেই নামও আড়ালে রয়ে গেল। ভালবেসে কালোমানিক বলেই ডাকত সকলে।
তারপর যা হয়, বয়স বাড়তে বাড়তে কালোমানিক থেকে কালো অবলুপ্ত হয়ে পড়ে রইল শুধুই মানিক। ওই নামেই জীবনের প্রথম গল্প 'অতসী মামী' ছাপা হয়েছিল। সেও আরেক গপ্পো।
স্নাতকস্তরে গণিত নিয়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেন মানিক। একদিন কলেজ ক্যান্টিনে বন্ধুদের সঙ্গে তুমুল তর্ক। এক বন্ধুর লেখা গল্প কোনও এক নামি পত্রিকা থেকে মনোনীত না হয়েই ফেরত এসেছে। সেই বন্ধু রেগে মেগে বললে, বড় পত্রিকাগুলি নামী লেখকদের লেখা ছাড়া ছাপায় না।
সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদে গর্জে উঠলেন মানিক। বললেন, 'এটা হতেই পারে না। তুমি ভুল বলছ। তোমার গল্প ভাল হয়নি বলেই তারা ছাপেনি। পছন্দ হলে নিশ্চয়ই ছাপত।'
বন্ধুও পাল্টা নিলেন, 'প্রমাণ করে দেখাতে পারবে?' চ্যালেঞ্জটা নিলেন মানিক। বললেন,'বেশ, আমি আগামী তিন মাসের মধ্যে একটা গল্প লিখে কোনও নামী পত্রিকায় ছাপিয়ে দেখাব।'
তিন মাস নয়, তিনদিনের মধ্যে একটা গল্প লিখে ফেললেন। গল্পকারের নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখতে গিয়েও লিখলেন না, থমকালেন।
জীবনের প্রথম গল্প। সম্পাদকের পছন্দ হবেই সে বিষয়ে নিশ্চিত। কিন্তু বারো তেরো বছর বয়সের বাংলার সাহিত্যগুলো যে গুলে খেয়েছে সে মানিক বুঝেছিলেন 'অতসী মামী' আসলে 'অবাস্তব রোম্যান্টিকতায় ভরা'। তাই ঐ নাম নেহি চালেগা। কতকটা সংকোচ থেকেই প্রবোধকুমারের বদলে লেখলকের নাম লিখলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর সেই গল্প নিয়ে নিজেই সটান হাজির 'বিচিত্রা' পত্রিকার দপ্তরে। সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ সেই সময় দপ্তরে ছিলেন না।
তার জায়গায় বসেছিলেন আরেক দিকপাল সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। স্মৃতিকথায় অচিন্ত্যকুমার লিখছেন, 'একদিন বিচিত্রার দফতরে কালোপানা একটি লম্বা ছেলে এল। বলল গল্প এনেছি। বললাম, দিয়ে যান। সেই ছেলে লম্বা হাত বাড়িয়ে গল্পের পাণ্ডুলিপি দিয়ে বলল, এই যে রাখুন। এমন ভাব যেন এখুনি ছাপতে দিয়ে দিলে ভাল হয়। চোখে মুখে আত্মবিশ্বাস চুঁইয়ে পড়ছে। গল্প জমা দিয়ে সে চলে গেল। আমি তারপর এমনিই গল্পে একবার চোখ বোলাতে গিয়ে চমকে উঠলাম। এ যে রীতিমতো দুর্দান্ত গল্প!'
সেই গল্প ছাপা হল! বাংলা সাহিত্য নতুন এক ব্যানার্জী পেল, আর বাংলার পাঠকমহলে হইহই রব উঠে গেল। বিচিত্রার সম্পাদক খোঁজখবর নিয়ে ছুটে এলেন মানিকের সঙ্গে দেখা করতে। লেখার সাম্মানিক কুড়িটা টাকা হাতে দিয়ে অনুরোধ করলেন, 'আপনি আবার গল্প দিন আমাদের।'
ইচ্ছে ছিল ত্রিশ বছরের আগে কোনও দিন গল্প লিখবেন না, কিন্তু কুড়ি বছর বয়েসেই বাজি রেখে গল্প লিখে এমনই বিখ্যাত হয়ে গেলেন যে সেদিন আবার গল্প লিখতে রাজি হতে হল, আর সেদিনই ঠিক হয়ে গিয়েছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিয়তি। সাহিত্যিকই হবেন তিনি।
ভাল ছাত্র তাই পরীক্ষায় বরাবর ভাল রেজাল্ট হত তাঁর। কিন্তু কলেজে পড়ার সময়েই জড়িয়ে পড়লেন সক্রিয় বাম রাজনীতিতে। তার সঙ্গে দিনরাত সাহিত্য চর্চা। কলেজের লেখাপড়া শিকেয়। ফলে বিএসসিতে পরপর দুবার ফেল।
তাঁর পড়াশোনার যাবতীয় খরচ চালাতেন বড়দা। ভাইয়ের রাজনীতি করার খবর পেয়ে চিঠিতে লিখে জানালেন, ফেল করার কারণ জানতে চাইলেন।
উত্তরে মানিক লিখলেন, গল্প উপন্যাস পড়া, লেখা এবং রাজনীতি ছেড়ে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। রেগে গিয়ে দাদা বললেন, 'তোমার সাহিত্য চর্চার জন্য খরচ পাঠানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।' টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলেন দাদা।
উত্তরে মানিক লিখলেন, 'আপনি দেখে নেবেন, কালে কালে লেখার মাধ্যমেই আমি বাংলার লেখকদের মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে স্থান করে নেব। রবীন্দ্রনাথ- শরৎচন্দ্রের সমপর্যায়ে আমার নাম ঘোষিত হবে।' কতটা আত্ম প্রত্যয় থাকলে এমন বলা যায়!
এবার দাদা টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেওয়ায় শুরু হল অভাব, দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই। চলে এলেন আমহার্স্ট স্ট্রিটের একটি মেসে। দিনরাত এক করে মানিক শুধু লিখে চলেছেন, প্রকাশকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
অমানুষিক পরিশ্রমের সহ্য হল না, মানিকের শরীর ভেঙে যেতে থাকল।
১৯৩৩ সালে কলকাতায় এসেছিল এক বিখ্যাত পুতুল নাচের দল। সেই দলের নাচ দেখেই মুগ্ধ হয়ে, পুতুলদের সঙ্গে মানুষের জীবনকে নিয়ে লিখতে শুরু করলেন 'পুতুলনাচের ইতিকথা'। আরও চাপ বাড়ল শরীরের, আক্রান্ত হলেন দূরারোগ্য মৃগীরোগে। শরীর আর দিচ্ছে না। তার মধ্যেই চলছে লেখক হওয়ার লড়াই। নিজের রোগের সঙ্গে, চরম দারিদ্রের সঙ্গে।
এর মধ্যেই চিকিৎসক বিধান রায়ের পরামর্শে বিয়ে করেছেন, ছেলে মেয়ে হয়েছে। বাবাকে নিয়ে এসেছেন নিজের কাছে বরাহনগরে গোপাললাল ঠাকুর স্ট্রিটে, একের পর এক যুগান্তকারী রচনা সৃষ্টি হতে থাকল। এত লেখালেখি করেও সংসার যেন আর চলে না। বাধ্য হলেন চাকরি নিতে। কিন্তু কিছু দিন পরেই সে চাকরিতে ইস্তফা। ফের পুরোদমে লেখা শুরু, সঙ্গে অভাব দারিদ্র। ঠিক করলেন চাকরি করতে হবে। 'বঙ্গশ্রী' পত্রিকায় সাপ্তাহিক বিভাগের জন্য সহকারী সম্পাদক প্রয়োজন। মানিক আবেদন করলেন। চাকরি পেলেন। বেতন ৮৫ টাকা। সঙ্গে শর্ত 'অমৃতস্য পুত্রা' ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে হবে। তার জন্য পাবেন আরও ১০ টাকা মাসপ্রতি। কিন্ত ভাগ্যে চাকরি নেই।
সেই চাকরিও ছেড়ে দিলেন কিছু দিন পর। অভাবের মধ্যেই লিখে চলেছেন, আবার বাম আন্দোলন করছেন, ফ্যাসিবিরোধী লেখক-শিল্পী সংঘের আন্দোলনে যুক্ত, কলকাতার হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা রুখতে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। ১৯৫০ সালে যখন কমিউনিস্টদের ওপর নেমে এল সরকারি দমনপীড়ন নীতি, তখন বহু পত্র-পত্রিকায় মানিকের লেখা ছাপানো বন্ধ করে দেওয়া হল। আরও ভয়ংকর হল আর্থিক সঙ্কট।
দাদাকে আবার চিঠি লিখলেন, টাকা ধার চেয়ে। দাদা চিঠির উত্তরে লিখলেন, আত্মীয় হোক বা অনাত্মীয়, আমি কাউকে টাকা ধার দিই না। ভাইয়ের সঙ্গে পাবলিশিং হাউজের ব্যবসাও শুরু করলেন একবার, কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাবে সেই ব্যবসাও মুখ থুবড়ে পড়ল।
মানিক মদ্যপান করতেন। ঘনঘন অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, হাসপাতালে ভর্তি, লিভার নষ্ট হতে থাকা মানিক পুরোপুরি বিপর্যস্ত। চূড়ান্ত অনটন তো ছিলই। হাসপাতাল আর বাড়ি চলছে তাঁর।
কিছু দিন আগেই হাসপাতাল থেকে জেদ করে বাড়ি ফিরেছেন। বন্ধুবান্ধবদের দেওয়া আর্থিক সাহায্য নিতে ইচ্ছে হয় না তাঁর।
দিনের পর দিন বাড়ি ভাড়া বাকি, বাড়িওয়ালা মামলা ঠুকলেন তার বিরুদ্ধে। তিনি আর সহ্য করবেন না। মানিকের কয়েকজন বন্ধু মিলে মোটা টাকার বিনিময়ে আদালতে মামলার দিন পিছিয়ে দিতে পারলেন, কিন্তু মানিকের দিন ফুরিয়ে আসছিল।
৩০শে নভেম্বর, মানিক আবার জ্ঞান হারালেন।
২রা ডিসেম্বর, সম্পূর্ণ অচেতন অবস্থায় আবার ভর্তি করা হল নীলরতন সরকার হাসপাতালে। এমন অসুস্থতার খবর পেয়ে ছুটে এলেন কবি, কমরেড সুভাষ মুখোপাধ্যায়। অ্যাম্বুল্যান্সে তোলা হচ্ছে মানিককে। লেখকপত্নীকে অনুযোগের সুরে সুভাষ মুখোপাধ্যায় বললেন, 'বৌদি এমন অবস্থা, আগে টেলিফোন করেননি কেন?'
কমলা দেবী যা উত্তর দিয়েছিলেন, তা শুনলে লেখকদের অবস্থা বোঝা যায় বেশ সুন্দর। তিনি বলেছিলেন, 'তাতে যে পাঁচ আনা পয়সা লাগে ভাই।' সেটুকুও নেই যে ঘরে!
৩ ডিসেম্বর, ভোর চারটে সব লড়াই শেষ। দারিদ্রতা অভাবের সাথে নিত্য লড়াই থামল, আটচল্লিশ বছরের জীবন থেমে গেল। ঐদিন বিকেল চারটের সময় বের হল শোকমিছিল। নিমতলা ঘাটের সম্পন্ন হল শেষকৃত্য। চলে গেলেন মানিক। লেখক হওয়ার অদম্য লড়াই তিনি জিতে নিয়েছিলেন। তাঁর কথা সত্যি হয়েছে আজ তাঁর নাম শরৎবাবু, রবি ঠাকুরের সঙ্গে উচ্চারিত হয় কিন্তু ক্ষণজন্মা যে চলে গিয়েছেন এত কিছু দেখার আগেই। কাগজ কালি আর কলম পেষার লড়াই জিতলেও, অভাব দারিদ্রতা তাঁকে অল্প বয়সে আমাদের থেকে কেড়ে নিল।