বর্ষায় ভেজা পল্লীগ্রাম, দু-তট ছাপানো নদী; শ্রাবণের সংক্রান্তি তখনই আবির্ভূতা হন দেবী মনসা, লোকবিশ্বাস অনুযায়ী তিনি শিবের মানস কন্যা। তিনি এক মঙ্গলকাব্যের নায়িকা, মধ্যেযুগের লৌকিক সাহিত্যের নায়িকার আরাধনাতেও মিশে গিয়েছে লোকাচার। কোথাও তিনি অষ্টনাগে পূজিতা, কোথাও বা সরা, পট, কিংবা ফনিমনসার ডালে। তাঁকে ঘিরে চলে ঝাঁপান। বৃহত্তর রাঢ় বঙ্গে তাঁর আরাধনা দুর্গাপুজোর চেয়ে কম কিছু নয়।
মনসামঙ্গল বলে, বেহুলা নাচ-গানে তুষ্ট করেছিলেন সর্পকূলের দেবীকে। তাই মনসার পুজোকে কেন্দ্র করে নানান গানের চল রয়েছে। পল্লীগীতি, ছন্দবদ্ধ পদ একেবারে সাধারণ সুর করে পালাগানের ঢঙ।
গ্রামবাংলায় জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্ল দ্বাদশী থেকে গোটা শ্রাবণ মাসজুড়ে মনসামঙ্গল পালাগীত গাওয়া হয়, একে সয়লা বলে। রাঢ় বাংলায় জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্ল দ্বাদশীর দিন দশহারার সঙ্গেই মনসা পুজো করা হয়। গাওয়া হয়,
জৈষ্ঠ্য অতি পূজা হব দশরা-দিবসে।
আষাঢ়েতে হব নাগ পঞ্চমীর পূজা।।
ঝাঁপান করিব যত ঝাঁপানিয়া ওঝা।
শ্রাবণ মাসেতে পূজা লবে খরা তরা।।
খই দধি দিয়া লোক পালিবেক চিরা।
পঞ্চমী ব্রতও পালিত হয়। বাড়িতে বাড়িতে ফনিমনসার ডাল প্রতিষ্ঠা করে ফি মাসের পঞ্চমী তিথিতে পুজো দেওয়া হয়। মনসাবিজয়তে রয়েছে...
নানা কুতুহলে
বঞ্চয়ে সকলে
জৈষ্ঠ্য মাস পরবেশ
দশমী দশহরা
তিথি যোগ তারা
শুভক্ষণ সবিশেষ
বরিশাল হল জল, জলার দেশ। সেখানেও দেবীর পুজো ভীষণ জনপ্রিয়। বরিশালে দেবীর গানকে বলা হয় রয়ানী। শ্রাবণের দুপুর থেকে চলে রয়ানী পাঠ। বাড়ির মেয়ে, বৌ, ঝিয়েরা সুর করে পাঠ করেন। প্রতিবেশী এঁয়োরাও সামিল হন তাতে।
এই না শ্রাবণ মাসে ঘণ বৃষ্টি পড়ে
কেমন করে থাকবো লো আমি
অন্ধকার ঘরে।
সোনার বরণ লখাইরে আমার
বরণ হইলো কালো
কিনা সাপে দংশিল তারে
তাই আমারে বল।
সাপ কাটা অবধি শুনে ফেললে, পুরো রয়ানী পড়তেই হবে।
কী সাপে দংশিল লখাইরে,
ওঠো বেউলা, কত নিদ্রা যাও৷
শেষ থেকে মঙ্গলার্তি, রক্ষা পাওয়ার কামনা।
মা গো মা,
সাপে যেনো না কাটে,
বাদুরে না খায়
দুধ কলা দিয়ে যাবো তোমার তলায়।