সতীপীঠঃ মানস সরোবরের তীরে রয়েছেন রহস্যময়ী দেবী আদ্যাশক্তি দাক্ষায়ণী

আপামর ভারতীয় তো বটেই, বাঙালির কাছেও পরম পবিত্র তীর্থ হিসেবে বন্দিত মানস সরোবর। পুরাণ বলেন যে, মানস সরোবর হচ্ছে ব্রহ্মার সৃষ্টি। ব্রহ্মাণ্ডসৃজনের কর্তা তিনি। ব্রহ্মাণ্ডের সৃজনেরও তিনি কর্তা। তিনি সৃষ্টি করেন মনে মনে। ব্রহ্মাণ্ডে যখন কোন জীব ছিল না, তখন ব্রহ্মা মনের ইচ্ছা আর কল্পনা দিয়ে প্রথমে পুত্রসন্তানের সৃষ্টি করেছিলেন, তারপর সৃষ্টি করেছিলেন কন্যাসন্তানদের। মন থেকে সৃষ্টি হয়েছিলেন বলে এই সন্তানেরা তাঁর ‘মানসপুত্র’ ও ‘মানসকন্যা’ নামে পরিচিত। এই সন্তানদের মঙ্গলের জন্যই একবার ব্রহ্মা মন থেকে দেবগিরি হিমালয়ে বৈদ্যুত পর্বতের পাদদেশে সৃষ্টি করলেন অপরূপ এক সরোবর। মানসজাত সেই সরোবরের নাম দেওয়া হল, ‘মানস সরোবর’। ‘স্কন্দপুরাণ’-এ বর্ণিত হয়েছে এই সরোবর-সৃজনের উপাখ্যান। কীর্তিত হয়েছে মাহাত্ম্যগাথাও।

 

manosarovar

সেই গাথায় বলা হয়েছেঃ

হরিণের একটি দলকে একবার কয়েকজন ব্যাধ তাড়া করল হত্যার জন্য। হরিণেরা দারুণ ভয় পেয়ে প্রবলবেগে ছুটতে ছুটতে এসে পড়ল মানস সরোবরের তীরে। প্রাণ বাঁচানোর অন্য কোন উপায় না-দেখে তারা ঝাঁপ দিল একেবারে সরোবরের শীতল জলে। আর অমনি ঘটে গেল অলৌকিক এক ঘটনা। হরিণেরা সেই জলে অবগাহন করা মাত্রই মানুষে পরিবর্তিত হয়ে গেল। আসলে, পূর্বজন্মের কর্মফলে তারা হরিণরূপে জন্ম নিয়েছিল, সরোবরের পবিত্র জলে সেই কর্মফল ঘুচে গিয়ে তারা পুনরায় মানুষ হয়ে উঠল। বহুজন্মের তপস্যার যে পুণ্যফলে মানুষজন্ম পাওয়া যায়, সেই পুণ্যফল তারা সরোবরে একবার অবগাহনেই লাভ করল।

যাই হোক, খানিক পরেই যে ব্যাধেরা হরিণদের হত্যার জন্য তিরধনুক উঁচিয়ে তাড়া করেছিল, তারা সরোবরের তীরে এসে পৌঁছল। তারা ক্ষুধার্ত, তারা শিকারের নেশায় উন্মত্ত। তাই সরোবরের তীরে এসে হরিণদের কোথাও দেখতে না-পেয়ে দারুণ অবাক হল। কোথায় গেল হরিণের দল! বাঁক ফিরতেই অদৃশ্য হয়ে গেল কী করে! বিহ্বল ভাবনার পর্দা সরতেই সামনে দেখল একদল অচেনা লোক। এরা কারা! ক্ষুধার্ত শরীরে আর সেই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হল না। তাই মনের প্রশ্ন মনেই রেখে তারা সেই লোকগুলোকে জিজ্ঞেস করল হরিণের সন্ধান।

তখন লোকগুলো বলল যে, তারাই সেই হরিণ। সরোবরের জলে অবগাহন করে তাদের রূপান্তর ঘটেছে। তাদের কথা শুনে ব্যাধেরা অবাক হল, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারল না। তবে স্থান মাহাত্ম্যে লোকগুলোর কথা সত্যি কি না, পরখ করে দেখার বাসনা হল। অমনি নেমে পড়ল সরোবরের জলে। সেই জলে প্রাণ ভরে তারা অবগাহন করল। তারপরই তাদের জীবনে ঘটে গেল এক অদ্ভুত পরিবর্তন। তাদের মনের প্রবল হিংসা, বর্বরতা, নৃশংসতা, জঠরের অবাধ্য ক্ষুধা সব কোথায় যেন উবে গেল এক নিমেষে। জল থেকে তারা যখন উঠল, তখন প্রত্যেকেই ঋষির জ্ঞান আর ঋষির মতো মন নিয়ে উঠে এল। মানস সরোবরের এই পবিত্র গুণবত্তার কাহিনি শুদ্ধ হয়ে ওঠার বাসনা জুগিয়ে যুগে যুগে ভক্তকূলকে টেনে নিয়ে গেছে সেখানে, আজও টেনে নিয়ে যায়।

স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ জল মানসের। তাই তীর হতে সরোবর গহ্বরের শিলা বহুদূর স্পষ্ট দেখা যায়। এই সরোবরের সন্নিকটেই রয়েছে কৈলাস পর্বত। ভক্তদের কাছে এই পর্বত তাঁদের পরম আরাধ্য শিবের সাধনভূমি। বাসস্থান। এখানে তিনি দেবী পার্বতীর সঙ্গে অনন্তলীলায় মগ্ন থাকেন। পুরাণপাঠক ভক্তকূল জানেন যে, এই মানস সরোবরেই দেবী পার্বতী নিত্যস্নানে সিক্ত হন। নিত্য তাঁর স্পর্শে এই সরোবরের জল ধন্য হয়। এই সরোবরে স্নান করতে গিয়েই একদা পার্বতী জন্ম দিয়েছিলেন পুত্র গণেশকে। মা পার্বতী যখন এখানে স্নান করেন, তখন গণেশ পাহারা দেন। এমন লীলাময়স্থানকে তাই পুরাণে ‘স্বর্গ’ বলেই অভিহিত করা হয়েছে।

শিবের কর্মভূমি ও আদ্যাশক্তি পার্বতীর লীলাক্ষেত্র ছাড়াও মানস সরোবর আর-একটি কারণে পূন্যভূমি, তা হল এটি একটি গুপ্ত সতীপীঠ। এখানে দেবী সতীর ডান হাত পতিত হয়েছিল। ‘পীঠনির্ণয় তন্ত্র’ অনুসারে এই পীঠ হল দেবী সতীর নবম পীঠ। তন্ত্রগ্রন্থটিতে এই পীঠ সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

‘মানসে দক্ষহস্তো যে দেবী দাক্ষায়ণী হর

অমরো ভৈরবস্তত্র সর্বসিদ্ধিপ্রদায়কঃ।।’ 

অর্থাৎ, এখানে দেবীর শিলাময় দক্ষিণহস্ত ‘দাক্ষায়ণী’ নামে পূজিতা হন। তাঁর ভৈরব শিব পূজিত হন ‘অমর’ নামে। এই পীঠ মানস সরোবরের পশ্চিমতটে অবস্থিত।

মানসের পশ্চিম তীরে রয়েছে একটি সুউচ্চ পাহাড়। সেই পাহাড়ের গায়ে রয়েছে অসংখ্য প্রাকৃতিক গুহা। গুহাগুলো দীর্ঘ ও প্রশস্ত। এই সমস্ত গুহায় বাস করেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা। রাশি রাশি হস্তলিখিত পুঁথি নিয়ে তাঁরা এখানে জ্ঞানচর্চায় কালাতিপাত করেন, করেন ঈশ্বরের আরাধনা। 

ভারতে বৌদ্ধধর্মের প্রাবল্য যখন ইতিহাসের ধারা বেয়ে ক্ষীণ হয়ে উঠল, তখন হিন্দুধর্ম প্রবল হয়ে ওঠার সুযোগ পেল। শুরু হল হৃতগৌরব ফিরে পাবার সংগ্রাম। তারই জেরে নেমে এল বৌদ্ধদের ওপর অত্যাচার ও আক্রমণ। বিম্বিসার ও অজাতশত্রুর কাহিনিতে আমরা এই দ্বন্দ্বের প্রতিফলন পাই। তখন থেকেই শুরু হয়েছিল বৌদ্ধদের পুঁথিপত্র নিয়ে দুর্গম গিরিগুহায় গিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম। তের শতকে তুর্কী আক্রমণ ও তাদের অত্যাচারে আত্মরক্ষা এবং সংস্কৃতিরক্ষায় সেই পলায়নের চূড়ান্তরূপটি দেখা যায়।

এই ইতিহাসেরই কোন এক বাঁকে মানস সরোবরের তীরস্থ এই পাহাড়গুহায় বৌদ্ধসন্ন্যাসীরা এসে আশ্রয় নেন। কবে নেন, তার প্রামাণ্য ইতিহাস আমাদের কাছে নেই। কিন্তু এখানে এসে তাঁরা আবিষ্কার করেন যে এই গুহাগুলির একটিতেই রয়েছে দেবী সতীর শিলাভূত দক্ষিণহস্ত। তাঁরাই দেবীর পূজা ও উপাসনার ভার তুলে নেন। এখনও তাঁরাই উপাসনা করেন।

গুহার মধ্যে শিব ও শক্তির মূর্তি আছে, তাঁরা পূজিত হন নিয়মিত। কিন্তু দেবীর আসল পীঠ যেখানে, সেখানে গাঢ় অন্ধকার। বৎসরের বিশেষ কিছুদিন ছাড়া সেখানে আলো জ্বলে না। ফলে, সেই সময় ছাড়া দেবীদর্শন করা যায় না। দেবী এখানে গুপ্তবাসিনী। তাঁকে ঠিক কেমন দেখতে, তাঁর আবরণ কী, আভরণ কী, ভঙ্গিমা কী, স্বরূপ কেমন—তার কোন বিবরণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। দেবীর কাছ থেকে কতদূরে ভৈরবের অবস্থান বা ভৈরব লিঙ্গরূপে, না শিলারূপে অবস্থিত—সে কথাও জানা যায় না। যে সমস্ত সাধক-সাধু এই দেবীকে দর্শন করেছেন বলে দাবী করেছেন, তাঁরা কেউই দেবীর কোন বর্ণনা দেননি। তাই দেবীর স্বরূপ আপামর ভক্তদের কাছে উন্মোচিত হয়নি। তিনি আজও এখানে গহন রহস্যের আড়ালেই লুকিয়ে রয়েছেন।...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...