'পদ্মাবতী', 'বিষহরি', 'মনসা', 'কেতকী', 'জাগুলি' প্রভৃতি সুন্দর সুন্দর দেবীনাম যেমন বাংলার মনসামঙ্গল কাব্যগুলিতে পাওয়া যায়; তেমনি একটি কু-নামও পাওয়া যায়, দেবীর মানব প্রতিপক্ষ চন্দ্রধরের দেওয়া, সেটি হল-'চ্যাংমুড়ি কানি'।
'চ্যাংমুড়ি কানি' হোন, বা 'মনসা'; দেবী কিন্তু পৌরাণিক নন। তাঁকে নিয়ে বাংলায় যে মঙ্গলকাব্যগুলি পুঁথিতে লেখা হয়েছে, তা রচনার সূত্রপাত হয়েছে পনের শতক থেকে। সময়টা চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের বেশ কিছুকাল আগের সময়। চৈতন্যজীবনীকার বৃন্দাবন দাস তাঁর 'চৈতন্য ভাগবত' কাব্যে চৈতন্যদেবের জন্মের সময়কার সমাজ ও ধর্মাচারের দিকটি তুলে ধরতে গিয়ে স্পষ্টতই বলেছেন সে সময়ের মনসা পুজোর জাঁকের কথা-'দম্ভ করি বিষহরি পূজে কোন জন'।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পনের শতক নাগাদ যদি দেবীর পুজোর জাঁক দেখা যায় অর্থাৎ মনসা পুজো 'দম্ভ' বা আভিজাত্যের বিষয় হয়ে ওঠে, তাঁকে নিয়ে মঙ্গলকাব্য লিখে রাখার সূত্রপাত হয়; তাহলে তার আগে দেবী সমাজে কোন অবস্থায় ছিলেন?
মনসা পৌরাণিক দেবী নন, কিন্তু তাই বলে কী পুরাণে দেবীর একেবারেই উল্লেখ নেই?
আছে বৈকি। প্রাচীন ও মান্য পুরাণে নেই। আছে, 'পদ্ম পুরাণ', 'দেবী ভাগবত পুরাণ' ও ''ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ'-এর মতো অপেক্ষাকৃত আধুনিক পুরাণে। সেখানে কোথাও দেবীর উল্লেখ আছে, কোথাও বা দেবীর বিস্তারিত পরিচয় আছে। পণ্ডিতদের অনুমান, এই পুরাণগুলি দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে রচিত হয়েছিল। তাই যদি হয়, তাহলে দেবী মনসার প্রাচীনত্ব আরও তিন থেকে পাঁচশো বছর বাড়ল!
কিন্তু, তার আগে?
তার বহু আগে, 'মহাভারত'-এ নাগজাতির কথা আছে। সেখানে 'বাসুকি-ভগিনী'র স্বামী জরৎকারু ও তাঁর পুত্র আস্তিকের বিস্তারিত কাহিনি আছে; কিন্তু দেবী মনসার কোন নামোল্লেখ নেই।
আবার, ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার যখন ভারত আক্রমণ করেন, তখন যে এ-দেশে সাপের পুজো বেশ ভালোই প্রচলিত ছিল, তার ঐতিহাসিক উল্লেখ রয়েছে তাঁর সঙ্গে আসা গ্রিক পর্যটকদের রচনায়। তবে তাঁদের রচনায় 'মনসা'-নামে কোন দেবীর নাম পাওয়া যায়নি--এটাও সত্য।
তবে, এ-দেশে যে সাপের দেবী হিসেবে মনসাই একমাত্র ও সর্বত্র পূজিত হন, এমনটাও নয়। দক্ষিণ ভারতে 'নাগম্মা', 'মুদামা', 'মঞ্চাম্মা' প্রভৃতি নাগদেবীর পুজো প্রচলিত রয়েছে প্রাচীনকাল থেকেই। শেষোক্ত 'মঞ্চাম্মা' থেকে বাঙালির দেবী 'মনসা'র উদ্ভব--এমনটা অনেকেই প্রচার করার চেষ্টা করেছিলেন একসময়, কিন্তু দুই দেবীর মধ্যে রূপগত কোন সাদৃশ্য না-থাকায় ও সিদ্ধান্তের পক্ষে ঐতিহাসিক কোন প্রমাণ না-থাকায় সে-চেষ্টা ধোপে টেঁকেনি।
মনসা যে শুধু বাংলার দেবী এমনটাও নয়। কারণ, আসাম ও বিহারের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মনসার পুজো-গীত-কাহিনি অত্যন্ত সুপ্রচলিত। তাছাড়া পূর্ব-পঞ্জাব ও হরিদ্বারে তেরো থেকে পনের শতকের মধ্যে নির্মিত প্রাচীন মনসা মন্দির এখনও রয়েছে। যা প্রমাণ করে, এই সব অঞ্চলেও একদা দেবী মনসার কমবেশি পূজা প্রচলিত ছিল।
ঢাকা মিউজিয়ামে দেবী মনসার একটি হস্তিবাহনা মনসার মূর্তি রয়েছে। মূর্তিটি আসাম থেকে পাওয়া। পণ্ডিতদের অনুমান, এ-মূর্তির সময়কাল দশম থেকে একাদশ শতাব্দী।
অনেকেই অনুমান করেন যে, দেবী এই সময় ছিলেন মেঘ-বৃষ্টির দেবী। কারণ, হস্তি তাঁর শুঁড় দিয়ে জল ছিটিয়ে মেঘে বৃষ্টির সঞ্চার করে--আদিম এই ভাবনা থেকেই ইন্দ্রকে একদা হস্তি-বাহনে বসিয়ে মেঘবৃষ্টির দেবতা করা হয়েছিল। মনসা উল্লিখিত সময়ে এই দপ্তরের দেবী হন, পরবর্তীতে তাঁর দপ্তর পরিবর্তিত হয়। হাতির বঙ্কিম শুঁড় সাপে পরিণত হয়। এবং, দেবী ধীরে ধীরে সাপ-নিয়ন্ত্রা দেবীতে পরিণত হন।
ওই সময় অর্থাৎ দশম থেকে দ্বাদশ শতকে লিখিত পুরাণগুলিতে দেবীর জন্মবৃত্তান্ত লিখিত হয়। তাঁকে ঋষি কশ্যপের 'মানসকন্যা' বলে নির্দিষ্ট করা হয়। এবং তাঁর 'মানস' থেকে জন্ম বলে, দেবীর নাম দেওয়া হয়, 'মনসা'। দেবীর উদ্ভব ইতিহাসের ঠিক কোন পর্বে হয়েছিল, এটা নিশ্চিত করে বলা না-গেলেও তিনি যে এই পর্বে বিশিষ্ট হয়ে উঠছিলেন, তা নিশ্চিত বলা যায়।
তারপর ধীরে ধীরে তিনি লোকসমাজে ব্যাপকভাবে গৃহীত হতেই তাঁকে নিয়ে লোককাহিনি তৈরি শুরু হল। তাতে 'মহাভারত'-এর জরৎকারু ও আস্তিকের গল্পে 'বাসুকি-ভগিনী'র জায়গায় তাঁকে বসিয়ে দিয়ে প্রাচীন বাঁধা গল্পে তাঁর জায়গা করে দেওয়া হল।
এরপর কালের প্রভাবে এল শিবের কন্যা হিসেবে তাঁকে গড়ে তোলার প্রকল্পনা। কারণ, ততদিনে শিবকে আমরা কৈলাস থেকে আমাদের লৌকিক জীবনে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলাম, তাই।
কালের প্রভাবটা কেমন?
এ-প্রসঙ্গে আমি শুধু ধর্মভাবনার একটা অংশে চোখ রাখব:
বাংলায় মনসার মঙ্গলকাহিনি যখন পূর্ণ রূপ পাচ্ছে, তখন সমাজে ধর্মাচারে আগ্রাসী শৈবদের বেশ বাড়বাড়ন্ত। সেই শৈবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে দেবী মনসাকে প্রতিষ্ঠা করতে মনসার উপাসক লোক-কাহিনিকাররা বেশ আঁটঘাট বেঁধে নামলেন।
প্রথমেই অর্বাচীন পুরাণের ঋষি কাশ্যপকে হঠিয়ে তাঁরা ব্যভিচারী-গেঁয়ো ও পত্নী ভয়ে জর্জরিত সেকেলে বাঙালির মতো করে শিবের চরিত্রটি তৈরি করে মনসাকে তাঁর কন্যা করে দিলেন। এতে যেন শৈবদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেষ্টা করলেন যে, দেখ দেখ, তোমাদের দেবতা কত হীন! আমাদের দেবীর ওপর এত অত্যাচার হচ্ছে, তবু তিনি বাপ হয়ে কিছু করতে পারছেন না। নিজে দেবাদিদেব হয়েও নিজের পুজো-অধিকার ছেড়ে স্বার্থ ছেড়ে মেয়েকে ন্যায় ও প্রতিষ্ঠা দিতে পারছেন না! পরিশেষে শৈব চন্দ্রধরের মনসা-বিদ্বেষ ও পরিশেষে মনসার কাছে নতিস্বীকার সেই মানসিকতারই শৈল্পিক বিস্তার।
শুধু তাই নয়, মনসাকে তাঁরা আঁকলেন একক মেয়ের লড়াকু ও কঠিন মানসিকতা নিয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রতিনিধি হিসেবে। আর তাঁর ক্রুরতাকে সদর্থক করে দেখাতে তুলে ধরলেন, দেবী যা নেন, তার শতগুণ ভক্তকে ফিরিয়ে দেন-এই তত্ত্ব। আর এই দুটো ভাব-স্তম্ভের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে আজকের দেবী মনসার দৈবিক মাহাত্ম্য...