মনসা পুজোর কাহিনী কথা

গোটা বাংলা তথা ভারত জুড়েই সাপের আরাধনা করা হয়। বহুকাল ধরেই তা হয়ে আসছে। তবে বঙ্গদেশে সাপের দেবী আছেন একজন। মূলত ওপার বাংলার মানুষেরাই এপারে তাঁর পুজোর প্রচলন করেছিলেন। তিনি শিব দুহিতা মা মনসা। আদপে মনসা লৌকিক দেবী। গ্রামাঞ্চলেই তাঁর পুজোর প্রচলন বেশি। জল, জলা-জমি, জঙ্গলে নিয়ে যাদের দিন যাপন করতে হয়, সাপের ভয় যাদের কাজের অঙ্গ, বেঁচে থাকার অঙ্গ, সেই সমস্ত অঞ্চলেই মনসা পুজোর প্রচলন হয়েছে। জলা-জঙ্গলে ভরা পূর্ববঙ্গও তাই ছিল।
 
মনসা সাপের দেবী হলেও পরবর্তীকালে পৌরাণিক দেবী রূপে স্বীকৃত হন। গোটা মাস ধরে রয়াণীর পর শ্রাবণ মাসের শেষ দিনে ঘরে ঘরে মনসা দেবীর পুজো অনুষ্ঠিত হয়। চাঁদ বেহুলা লক্ষিন্দরের কিসসার কারণে মনসার গপ্পো আমাদের সকলের জানা। আর মধ্য যুগের কবিরাও মনসা মঙ্গলে হাত পাকিয়েছেন। পদ্মপুরাণ, দেবীভাগবত পুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণসহ কয়েকটি উপপুরাণে দেবীর উল্লেখ রয়েছে। মনসাদেবীর লীলা ও মাহাত্ম্যকাহিনি বর্ণিত হয়েছে। যদিও লৌকিক গবেষকদের ধারণা, দশম-একাদশ শতকে মনসা দেবীর অধুনা মূর্তিরূপে পুজোর প্রচলন ঘটে। নাগ ও পটে পুজোর চল বিরল হলেও কোথাও কোথাও তা এখনও দেখা যায়। দেবীর পরিবর্তে দেবীর প্রতীক হিসেবে অনন্ত, বাসুকি, পদ্ম, মহাপদ্ম, তক্ষক, কুলীর, কর্কট, শঙ্খ এই অষ্টনাগও পূজিত হন। চৈতন্যদেবের সময়ে অর্থাৎ  পঞ্চদশ শতকে, বাংলাদেশে মাটির প্রতিমা গড়ে মনসা পুজো হত। একদা বলি প্রথারও চল ছিল।
 
মনসা পূজার প্রতিমাতেও পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। কেউ কেউ মনসা প্রতিমা বানিয়ে পূজা করে থাকে। আবার কেউ কেউ পঞ্চ সর্পের ফণা যুক্ত প্রতিমার পূজা করে। গোত্র ও অঞ্চল ভেদে প্রথার ওপর ভিত্তি করে মনসা দেবী বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রূপে তার ভক্তদের দ্বারা পূজিত হয়ে থাকেন। সাধারণত মনসা সর্পকুলের অধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপে প্রচলিত হলেও তাঁকে কৃষির দেবীও বলা হয়। পুরাণ মতে, মনসা জরৎকারু সুনির পত্মীআস্তিকের মাতা এবং বাসুকির ভগিনী। ব্রম্মার উপদেশে খষি বশিষ্ঠ সর্পমন্ত্রের সৃষ্টি করেন এবং তাঁর তপস্যার দ্বারা মন থেকে অধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপে মনসার আবির্ভাব ঘটে। মন থেকে সাকার রূপ লাভ করেন দেবী।
 
দেবীমহাভাগব বলছে:
সা চ কন্যা ভগবতী কাশ্যপস্য চ মানসী।
তেনৈব মনসা দেবী মনসা বা চ দীব্যতি।।
 
মনস শব্দের সঙ্গে আপ প্রত্যয় যোগ করে স্ত্রীলিঙ্গ 'মনসা' শব্দের উৎপত্তি। ব্যুৎপত্তিগত অর্থে মনসা মনের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। তিনটি কারণে দেবীর নাম হয় মনসা। প্রথমত, তিনি কশ্যপ মুনির মানস কন্যা। দ্বিতীয়ত, মনুষ্যগণের মনই তাঁর ক্রীড়া ক্ষেত্র। তৃতীয়ত তিনি নিজেও মনে মনে বা যোগবলে পরমাত্মার ধ্যান করেন। মনসা শব্দটির বিশ্লেষণ করলে অর্থ দাঁড়ায় মনে চিন্তন। 
 
আবার স্তোত্র বলছে,
জরৎকারুজগদগৌরী মনসা সিদ্ধযোগিনী।
বৈষ্ণবী নাগভগিনী শৈবী নাগেশ্বরী তথা।।
জরৎকারুপ্রিয়াস্তীকমাতা বিষহরীতি চ।
মহাজ্ঞানযুতা চৈব সা দেবী বিশ্বপূজিতা।।
দ্বাদশৈতানি নামানি পূজাকালে চ জঃ পঠেৎ।
তস্য নাগভয়ং নাস্তি তস্য বংশোদ্ভবস্য চ।।
দেবী মনসা এই বারোটি নামে সমগ্র বিশ্বে পূজিতা হন। পুজোর সময় এই বারোটি নাম স্মরণ সর্পভয় থেকে মুক্তি হয়। জরৎকারু, জগৎগৌরী, মনসা, সিদ্ধযোগিনী, বৈষ্ণবী, নাগভগিনী, শৈবী, নাগেশ্বরী, জরৎকারুপ্রিয়া, আস্তীকমাতা, বিষহরী ও মহাজ্ঞানযুতা; এই দ্বাদশ নামই স্বয়ং দেবী মনসার। 
 
বাংলা ভাষায় মনসা নিয়ে অজস্র লেখা রচিত রয়েছে। কানাহরি দত্ত, কেতকা দাস, ক্ষেমানন্দ, নারায়ণ দত্ত, বিজয়গুপ্ত প্রমুখের চরিতকথা উল্লেখযোগ্য। পদ্মপুরাণ বা মনসামঙ্গলে দেবীর চরিত্রচিত্রণ করা হয়েছে, কাহিনীও প্রচলিত হয়েছে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, মর্তে পুজো পাওয়ার বাসনায় চাঁদ সদাগরের পূজালাভ করার জন্যে মরিয়া মনসা চাঁদের জীবনে একের পর এক ঝঞ্ঝা নিয়ে এসেছিলেন। বণিকপুত্রের প্রাণ সর্পাঘাতে কেড়ে নিলেন দেবী। বেহুলা স্বামীর প্রাণের সঙ্গে সব ফিরিয়ে আনলেন। মানুষ ও মনুষ্য সমাজের প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লক্ষ্যে মরিয়া এক দেবীর লড়াই নিয়েই মনসামঙ্গল কাব্য রচিত।
 
দেবীভাগবত ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, সর্পদংশনের ভয় থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মা কশ্যপমুনিকে মন্ত্র বা বিশেষ বিদ্যা আবিষ্কার করার আদেশ দেন। ব্রহ্মার আদেশ পেয়ে কশ্যপ যখন সে বিষয়ে চিন্তা করছিলেন, তখনই তাঁর মননক্রিয়া থেকে আবির্ভূতা হন এক স্বর্ণবর্ণা মহাদেবী। যেহেতু তিনি মানসজাতা, মন থেকে তাঁর জন্ম, তাই তিনি 'মনসা'। ইনি 'কামরূপা', অর্থাৎ ইচ্ছানুযায়ী রূপধারণ ও রূপপরিবর্তন করতে সক্ষম। সরস্বতীর মতো দেবী মনসার বাহন হাঁস। তাই মনে করা যেতে পারে, মনসাও জ্ঞানযুতা, জ্ঞানলক্ষণা। দেবী মনসার জ্ঞানশক্তি মনোময়। আবার কোথাও কোথাও তিনি কৃষির দেবী।
 
শিব মনসার পিতা, তাই দেবীর নাম 'শৈবী'। অণিমা, লঘিমাদি অষ্টসিদ্ধিরা মনসার শরীরে প্রবেশ করে তাঁকে সিদ্ধযোগিনী-তে রূপান্তরিত করেন। আবার শিবের থেকেই দেবী 'শ্রীং হ্রীং ক্লীং শ্রীকৃষ্ণায় স্বাহা'- আট অক্ষরযুক্ত বৈষ্ণবমন্ত্র পেয়ে পুষ্করতীর্থে গিয়ে তিন যুগ ধরে ভক্তিমার্গ অবলম্বন করে শ্রীভগবানের আরাধনা করেছিলেন। তাই দেবীর আরেক নাম বৈষ্ণবী। দেবীভাগবত অনুযায়ী, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজে সর্বাগ্রে মনসার পুজো করে দেবীকে সর্বলোকপূজ্যা হওয়ার বর দান করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের পর মহর্ষি কশ্যপ তাঁর আরাধনা করেন, তৎপরে মুনি, নাগ, গন্ধর্ব ও মানবগণ একে একে মনসায় পুজোয় ব্রতী হন।
 
আর্যঋষিদের মতে, বিষহরী দেবীরুপে সেরূপ বিষহরণ করে মনকে বিষযুক্ত করারও ব্যবস্থা মনসার হাতে। যদিও তারা অন্তরের বিষ বা রিপু তত্ত্বকেই ইঙ্গিত করেন। তবে মনসা দেবীর আরেক নাম বিষহরী। সর্পবিষ হরণ করার কৌশল দেবীর রপ্ত রয়েছে বলেই এমন নাম। দেশে যখন বর্ষাকাল চরম পর্যায়ে, ঠিক তখন শ্রাবণ সংক্রান্তি বা আষাঢ়ী পঞ্চমীতে মনসা পুজো অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। প্রকৃতির নিয়মে, বছরের এই সময়তেই সাপ ও বিষাক্ত কীট মাকড়ের আধিক্য দেখা দেয়। প্রাচীন কালে মন্ত্র, ওষধি, ক্রিয়া ও দৈব; এই চার পদ্ধতিতে সর্পদংশনের চিকিৎসা হত। যা মনসাদেবীর কৃপার ওপর নির্ভরশীল। সর্পদংশন এড়াতে সর্পদেবী মনসার পূজার প্রচলন হয়। 
 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...