মনসার পালা আসলে এক সামাজিক আখ্যান

  জয় জয় মা মনসা জয় বিষহরি গো

  বন্দনা করি আমি মা মনসার চরণে

  জয় জয় মা মনসা..

এই গানের সঙ্গে ঢোল, তবলা, বাঁশির এক বিচিত্র সুর সম্মেলন। 'শুরু হয়ে গেল' রব তুলে বাড়িতে তাড়াহুড়ো করে খাওয়া দাওয়া চলছে। নইলে ধারিতে (মাটির বাড়ির তলার দিকে বর্ধিত অংশ) বসবার জায়গা পাওয়া যাবে না। তারপর বাড়ি থেকে চট (পাট বা প্লাস্টিকের বস্তা) নিয়ে এসে বসে পড়লাম, যদি ধারিতে না জায়গা পাওয়া যায় অন্য কারো পেতে রাখা চাটাই বা ত্রিপল ম্যানেজ করে কুলির (গ্রামের রাস্তা) উপর বসে গেলাম, স্টেজ এর সামনে।

স্টেজ বলতে সেরকম কিছু না শুধুমাত্র ত্রিপল দিয়ে ঘেরা একটা জায়গা, আর উপরে দুটো রঙিন শাড়ির আচ্ছাদন। তিন রাস্তার মোড়ে যে বাড়ির সামনে স্টেজ হত সেই বাড়িতেই গ্রিন রুম। তখনও গ্রামে ইলেকট্রিক আসেনি তাই খুঁটি পুতে দু’পাশে দুটো হ্যাচেক লাইট। সেই আলোয় ভরে উঠছে পুরুষ সিংহ চাঁদ সদাগরের মুখ। সেই আমার খুব ছোট্টবেলায় দেখা বালিকা সংগীত।

 যদিও সেখানে সবাই বালক, কোনও বালিকা নেই- তবু যে কেন এরকম নামকরণ বুঝতাম না। তবে মনসার পালায় যখন সনকা বা বেহুলা মেয়েদের সাজে আসত তখন তাদের মেয়ে বলে মেনে নিতে শিশুমনে কোনো দ্বিধা তৈরি হয়নি। তাই পরদিন সকালে রাতের সনকা, খালি গায়ে লুঙ্গি পরে আমাদের বাড়িতে ধান ঝাড়তে আসলে আমি কোনওভাবেই বিশ্বাস করতাম না। আমি খেতে না চাইলে মা আমাকে খামারের দিকে নিয়ে যেত, আর বাবাকে চুপি চুপি ডেকে বলতো- 'একবার চাঁদ সদাগরকে ডাকো দেখি কোনোমতেই খাচ্ছে না'। দুলাল জ্যেঠু হাসতে হাসতে এসে বলতো- এ ব (বাঁকুড়ায় গ্রামীণ ভাবে কাকু ভাইপোর পারস্পরিক ডাক) খাইয়ে লাও। আমি গুম মেরে বসে থাকতাম। বাবা চোখ টিপে ইশারা করতো আর দুলাল জ্যেঠু বাজখাই গলায় শুরু করত-

 'কাঁধে আছে হিতালবাড়ি বিপরীত ডাক ছাড়ি

            আইজ তার ঘটাব পমাদ

  বিরচিলাম ঘন ঘন       যে কাটে নন্দন বন

             লাগ পাইলে করতাম বধ।'

সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠতো আর মায়ের কোলে উঠে মাকে জড়িয়ে ধরতাম। ওই ওষুধে খাবারটা হয়তো খেয়ে নিতাম কিন্তু এই পরিবেশে আর এই পোশাকে চাঁদ সওদাগরের চন্দ্রময় দীপ্তিটা যেন খুঁজে পেতাম না। যে লোকটাকে সেই ছোট্টবেলায় আমার স্বপ্নের স্টার বলে মনে হত সে কিনা গামছা কাঁধে ধান ঝাড়বে, এ আমি মানতে পারতাম না। তারপর মনে হয়েছে এরা হয়তো ওই স্বপ্নঘেরা রাতের তারা দিনের আলোয় ঠিক চেনা যায়না।

          'বালিকা সংগীত' হয়ে যাওয়ার পরেও অনেকদিন অব্দি সেই রেশ মনে রয়ে যেত। কেও না যোগ দিলেও আমি একাই সব চরিত্রে অভিনয় করতাম। মাঝে মাঝে মাকে বলতাম তুমি সনকার রোলটা করো, আর আমি মিনমিনে গলায় অস্পষ্ট স্বরে বেহুলার পার্ট বলতাম-

    'নাগিনী দংশিল লখাই মোরে কর রোষ

     আর ছ এ পুত্র মরে সেবা কার দোষ।' 


আজ এইসময়ে দাড়িয়েও ' রয়ানি পালা'র (রাতের পালা) ঘোর যেন মনে গেঁথে রয়ে গেছে। মনের চাওয়ার ঠিকানাগুলো বদল হলেও পাওয়ার ইচ্ছেটা একইরকম। মনোস্কামএর প্রবল প্রকাশেই তো মনসা। সে শিব হোক বা জীবেই হোক। মনসা যেন লিবিডো(libido), কুলকুন্ডলিনি। যে কুলকুন্ডলিনিকে যোগী থেকে ভোগী সবাই ছুঁতে চায়। শক্তিকে মিলিয়ে দিতে চায় শিবের সঙ্গে। মুলাধার থেকে স্বাধিষ্টান হয়ে আজ্ঞা চক্র ভেদ করে খুলে কুলুকুণ্ডুলিনীতে যাবার দরজা। যেখানে স্বয়ং শিব সহস্র দলের উপর বসে থাকেন শক্তির সঙ্গে মিলিত হওয়ার অপেক্ষায়। তবে শিবের এই কাঙ্খিত মনোস্কাম সাধক পুরুষ ছাড়া আর কেই বা পূরণ করতে। সাধক পারে মিলিয়ে দিতে আর সাধারণেরা মিলনের আকাঙ্খায় থাকে। শিবের সেই সাধারণী চিন্তার ফসলেই মনসা।

       'অতিশয় কামভোলে শঙ্করের চন্দ্র টলে

         পদ্মপত্রে হরচন্দ্র হইল অস্থির

          অম্বু ভেদিয়া পড়ে বাসুকির শির।'

তাই মনসা যেন সাধারণ মানুষের সেই না পাওয়া কাম, অবদমিত ক্রোধ, লোভ, হিংসার এক বহিঃপ্রকাশ। জন্ম থেকে দুঃখ কষ্ট পাওয়ায় যেন তার নিয়তি।

          'মা নাই ভাই নাই মনে বড় তাপ

          তোমার ক্রোধ দেখিয়া লুকাইয়া থুইল বাপ

           জন্মাবধি শোকে দুঃখে কেটে গেল কাল

           যেই ডাল ধরি আমি ভাঙে সেই ডাল।'

আর সেই নিয়তির লিখন খন্ডন করার উপায় খুঁজে বেড়িয়েছেন তিনি নিরন্তর। স্বর্গে বাস হলেও দেবতার অধিকার থেকে তিনি বঞ্চিত। আর সেই বঞ্চনার প্রকোপ পড়ছে চাঁদ সদাগরের উপর। চাঁদ মানেই আমাদের কাছে কল্পিত সুখের এক পরম ঠিকানা। মনসামঙ্গলে চাঁদ সওদাগর যেন চাঁদের অর্থাৎ সুখের সওদা করে বেড়ান। সেই অর্থে চাঁদ সওদাগর যেন এক সুখের প্রতীক। কিন্তু সুখ তো পদ্মপাতায় জলের মতো টলমল, আর পরিপূর্ণ সুখ বলে কিছু হয় না তাই চাঁদ বেনেকে লড়াই করতে হয় মনসার সঙ্গে। একদিকে দেবত্ব আর অপরদিকে পৌরুষাকার এই দুইয়ের দ্বন্দে পড়ে দেবতার শক্তিকে জিতিয়ে দিতে হয়। শিবের শক্তিতে বলীয়ান চাঁদ সদাগর অহংকারে মত্ত। তাই বঞ্চিত নিম্নবর্গীয় অযোনি  সম্ভূতা দেবীকে স্বীকৃতি দেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। এখানে চাঁদ সদাগর যেন উচ্চবিত্ত সামন্ততান্ত্রিক সমাজের প্রতিভূ। তাই এক নিম্নশ্রেণীর নারীকে স্বীকৃতি দেওয়া পৌরুষ প্রতাপের বিরোধী। কিন্তু মনসা তার আত্মপ্রতিষ্ঠার দ্বারা নিজেকে তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে। সেই সময় সমাজে চলতে থাকা উচ্চবর্ণের ভাব ও ভাবনার বিরুদ্ধে নিম্নবর্গীয় মানুষের ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারী শক্তির জাগরণের এক জ্বলন্ত চিত্র হিসাবে যেন উঠে এসেছে চাঁদ মনসার দ্বন্দ্ব। দীর্ঘ সময়ের এই সংগ্রামে মনসা তার সহযোগীদের আহ্বান জানায় কারণ সম্মিলিত শক্তির মধ্যে দিয়েই উচ্চবিত্ত সমাজের কাছে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব। এ যেন শোষক আর শোষিতের লড়াই। জন্ম থেকে নানারকম নির্যাতনের শিকার হতে হতে মনসার মধ্যে জন্ম নিয়েছে শ্রেনীচেতনা বোধের। সেই বোধ থেকেই ফেটে পড়া ক্ষোভের আগুনে আকাশের চাঁদ কে মাটিতে লুটিয়ে দেবার এক প্রবল প্রয়াস শুরু হয়। সঙ্গে মনসার জন্য সুপার পাওয়ার হিসাবে কাজ করেছে দেবাদিদেবের থেকে পাওয়া এক জিনগত দেবত্বের শক্তি। তাই উপরে ভক্তের প্রতি সমর্থন থাকলেও গোপন হৃদয়ে পারিবারিক সত্তাটি বড়ো হয়ে উঠে বাবা শিবের। এই সময়ের রাজনৈতিক দলের মতো কিছু মানুষের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও পারিবারিক সূত্র ক্ষমতার শীর্ষে উঠে আসে। তাই অগৌরবের জয় হলেও শিবের মমতাময় চাওয়াতে অভিষেক ঘটে দেবী মনসার।

                   নিপীড়ণের করুন কাহিনি থেকে মনসার এই দেবত্বে উত্তরণ কোনও সরল সমীকরণের মধ্যে হয়নি। বারবার তার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া দেবত্বকে প্রয়োগ করতে হয়েছে। এ যেন কোনও মেহনতী মানুষের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী শাসকের আস্ফালন। যে কিনা কোন কাজ না করেই তার দৈবশক্তিকে কাজে লাগিয়ে পাওয়া নিশ্চিত করে ফেলে। আর ওই কাজে মনসা তুরুপের তাস হিসাবে কাজে লাগান বেহুলা ও লখিন্দরকে। দেবত্বের শক্তি দিয়ে এই দুজনকে পুতুলের মতো ব্যবহার করবার মনোবাসনা ছিল মনসার মধ্যে। শত্রুপক্ষের সঙ্গে থাকলেও রিমোট কন্ট্রোলটা ছিল মনসার কাছে। প্রথমের দিকে বেহুলা সমস্ত সহ্য করেছে কিন্তু ধীরে ধীরে তার মধ্যে ও প্রতিবাদের সুর ধ্বনিত হয়ে উঠে। বাসরঘরে যখন স্বামীর প্রাণ কেড়ে নেয় মনসা আর নিরীহ শাশুড়ি সনকাও পর্যন্ত তাকে দোষারোপ করে-

  '  কাল রাত্রি পদ্মাবতী তোমা কৈল রাঁড়ি

    নারী কুলে জন্ম তুমি বিফলে লভিলে

    স্বামী সনে এক রাত্রি সুখে না রহিলে।

    আমার মরণে তুমি না জীবে পরানে

    তোমা হেন অভাগিনী নাহি ত্রিভুবনে।'

তখন তার ভেতরে থাকা পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বেরিয়ে আসে মনসাকে সে দোষারোপ করে। তার ফেলে আসা স্বর্গীয় অতীত তাকে দাবি আদায় করে নিয়ে আসবার শক্তি যোগায়। অতীত বেঁচে থাকে বর্তমানে আর বর্তমান তার কাজ নির্ধারিত করে অতীতের পাটাতনে। মনসমঙ্গলের যুদ্ধ যতটা শারীরিক তার চেয়ে অনেক বেশী মানসিক। তাই দৃঢ় মানসিকতা আর হার না মানা জিদ নিয়ে বেহুলা চললো স্বর্গের দিকে।  পুরুষের প্রাণ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়েই নারীত্বের জাগরণ, মধ্যযুগীয় এই ধারণাটি সত্য হয়ে উঠেছে বেহুলার ক্ষেত্রে। স্বামীকে বাঁচানোর তাগিদে, শশুরকে আর্থিক ও সাংসারিক প্রতিপত্তি ফিরিয়ে দিতে নাচে গানে দেবতাদের সন্তুষ্ট করে। দেব সভার নর্তকী মর্তে এসে আকাঙ্খিত মুক্তি পেতে গেলে সেই পুরুষতন্ত্রকে খুশি করতে হয়। পুরুষের সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত নানারকম বোঝাপড়ার পর দুই নারীকে খুশি করা হয়। ইচ্ছে না থাকলেও দেবতার বিধান মেনে চাঁদ সদাগরের অবজ্ঞা ভরা পূজাতে মনসাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। 'নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দেবে অধিকার'- এই কথাটি যেন বেহুলা ও মনসা দুই নারীর ক্ষেত্রেই সত্য হয়ে উঠেছে।

                     মনসার পূজা আদায়ের জন্য আর একজন তাকে সাহায্য করেছে সে তার সহচরী নেতা। মনসার প্রতিটি পদক্ষেপে তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করেছে নেতা। আধুনিক যুগের নেতার মতোই সে কৌশল অবলম্বন করেছে। যখন মনসা ভাবে চাঁদ সদাগর সবকিছু ছারখার করে তাকে নিঃস্ব করে ফেলবে। তখন-

     'নেতো বলে পদ্মাবতী শোনো কহি কথা

      চাঁন্দের ধন ভাসিয়া গেলে শেষে পাবে কোথা

      ধনজন গোছাইয়া থোয় গঙ্গার ঠাই

      তথা থুইয়া চল শিগ্রগতি যাই।'

এই কথার মধ্যেই পরিষ্কার বোঝা যায় কত সুদূরপ্রসারী চিন্তা ভাবনা ছিল নেতার। মনসার মাথা গরম হলে নেতা তাকে বুঝিয়ে দেয় শুধু শক্তি দিয়ে নয়, কৌশলী কিন্তু দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে তবেই চাঁদ সদাগরকে নত করা সম্ভব।

                   প্রতিটি চরিত্র যেন পৌরাণিক আবছায়ায় তৈরী হওয়া আধুনিক চিন্তা চেতনার  প্রতিমূর্তি। সেই ছেলেবেলায় দেখা আমার স্বপ্নের চরিত্রগুলির কথা ভাবতে বসে মন যেন জটিলতায় আটকে পড়ে। সেদিনের সেই ঝিম ধরা আলোয় দেখা মনসা বেহুলার চাঁদ মুখের মধ্যে যে অদ্ভুত দীপ্তিময়তা খুঁজে পেতাম, মনের মধ্যে যে ভক্তির ভাব জেগে উঠতো আজ তা যেন কে চুরি করে নিয়ে গেছে খুব গোপনে। আমার শৈশবের স্নিগ্ধতায় গোপনে লালিত হওয়া রহস্যঘেরা চরিত্রগুলো সত্যি কি এতটা জটিল না কি আধুনিকতার আবিলতায় পড়ে আমার মনের সরলতাটাই গেছে হারিয়ে। মাথায় এই কিলবিল প্রশ্নের মাঝেই মন খুঁজে বেড়ায় সেই দৃশ্য,শেষ রাতে মনসার পূজা পাবার খুশিতে দাড়িয়ে পড়া মা কাকিমা দের উলুধ্বনি, আকাশে বাতাসে ভেসে আসে মনসারূপী মদন কাকুকে উদ্দেশ্য করে চাঁদরূপী দুলাল জ্যেঠুর বাম হাতে ছুড়ে দেওয়া ফুল সঙ্গে অ-মাইক অথচ বজ্রকঠিন কণ্ঠস্বর-

         যে হাতে পূজেছি আমি দেব শুলপানি

         সে হাতে না পুজিব আমি চেঙ মুড়িকানি।


 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...