আসুন, আজ আপনাদের এক যুবকের গল্প শোনাই। তার ডাকনাম পল্টন। শৈশব থেকেই সে গান পাগল। সঙ্গীত তার রক্তধারায় বহমান। যুবকটির দুই কাকা বিখ্যাত ক্ল্যাসিক্যাল সঙ্গীতশিল্পী। সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায় এবং রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়। কাকা রত্নেশ্বর ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই যুবক যখন শৈশব ছাড়িয়ে সবে কৈশোরে পা দিয়েছে সেই সময় একদিন ছেলেটির সেই কাকা তাকে কাজী নজরুল ইসলামের কাছে নিয়ে গেলেন। কাকার আদেশে কিশোর ছেলেটি কবিকে কীর্তন গেয়ে শোনাল। কাজী নজরুল তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে দুটি গান নিজে শিখিয়ে দিলেন "সখি সাজায়ে রাখ লো পুষ্প বাসর" এবং "হে মাধব হে মাধব"..
ছেলেটি যখন কলেজে পড়েন তখন তিনি একবার আন্ত:কলেজ সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় নাম দিলেন। ততদিনে তিনি খেয়াল, ঠুংরি, টপ্পা সঙ্গীতের এই ধারাগুলোয় দারুন পারদর্শী হয়ে উঠেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গানটাই খুব ভাল ভাবে শেখা হয়ে ওঠে নি। কিন্তু কলেজ প্রতিযোগিতায় রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেই হবে। তখন যুবকটির কাকা তাকে বললেন দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। ছেলেটি পরের দিন খুব ভোরে উঠে সোজা দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়িতে গিয়ে মশারির ভিতরে ঢুকে দেবব্রত বিশ্বাসের ঘুম ভাঙিয়ে তাঁকে ডেকে তুললেন। দেবব্রত বিশ্বাস তো রেগে টং। তারপর সেই যুবকের কাকার নাম শুনে একটু শান্ত হলেন। ছেলেটির গান শুনে খুশি ও। তুলিয়ে দিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত "ধরা দিয়েছি গো আমি আকাশের পাখি"।
কিন্তু তাঁর অফিসে যাওয়ার তাড়া ছিল তাই তিনি তাঁর বোনকে বলে গেলেন যে যতক্ষন গানটা পুরোপুরি না শেখা হবে ততক্ষণ যেন সেই যুবক না চলে যায়। কিন্তু সেই ছেলে কি সে কথা শোনার! তাই গানটি তোলা হতেই তিনি চলে গেলেন। বিকেলে যখন কম্পিটিশন শুরু হতে চলেছে তখন সেই যুবক দেখলেন বিচারকের আসনে অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন স্বয়ং দেবব্রত বিশ্বাস। সেই যুবক এতটাই প্রতিভাবান ছিলেন যে রবীন্দ্রসঙ্গীত বিভাগে শূণ্য পেয়েও সেই প্রতিযোগিতায় যুবকটি প্রথম হয়েছিলেন কারণ দেবব্রত বিশ্বাস তাকে কোনো নম্বর দেন নি। অবশ্য পরেও তিনি রবীন্দ্রনাথের গানের দিকে বিশেষ ঝোঁকেন নি।
নজরুলের গান ছিল তার প্রাণ। একটা সময়ে বাঙালি ভুলতে বসেছিল নজরুলের গান। সেই সময়ে এই যুবকের গাওয়া নজরুলগীতির রেকর্ড বের হয়। চূড়ান্ত জনপ্রিয় হয় তাঁর সেই নজরুলগীতির রেকর্ড। সেই প্রথম রেকর্ডের গায়ে লেখা হয়েছিল "নজরুলগীতি" শব্দটি। যতদিন বেঁচে ছিলেন তিনি নজরুলগীতি গেয়েছিলেন। নজরুলের হারিয়ে যাওয়া বহু গান তিনি উদ্ধার করেছিলেন। নজরুলগীতির জনপ্রিয়তার পিছনে তাঁর অবদান ভোলার নয়।
তখন তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে চাকরি করতেন। একদিন দুটি প্রোগ্ৰামের মাঝখানের ব্রেকে পায়চারি করছিলেন। হঠাৎ প্রাণের বন্ধু গীতিকার শ্যামল গুপ্ত এসে উপস্থিত। বললেন তিনি একটা গান লিখেছেন। সেই গানটিতে তক্ষুনি সুর করে দিতে হবে। ওমনি সেই গায়ক পিয়ানোয় বসে গেলেন। তৈরি করে ফেললেন সুর। সৃষ্টি হল সেই বিখ্যাত... শুধু বিখ্যাত বললে কম বলা হয়... সম্ভবতঃ এমন ভালবাসার গান বাংলা ভাষায় আজ পর্যন্ত দ্বিতীয় সৃষ্টি হয় নি... অবিস্মরণীয় সেই গান....
আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি
তবু মনে হয় সে গো যেন কিছু নয়
কেন আরো ভালবেসে যেতে পারে না হৃদয়।।
বাংলার সর্বকালের সেরা পাঁচ গায়কের নামের তালিকায় তাঁর নাম চিরদিন উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। যতদিন বাঙালি গান ভালবাসবে ততদিন তাঁর নাম বাঙালির হৃদয়ে অমলিন হয়ে থেকে যাবে।