কালীকথা: হবিবপুরের বুলবুলচণ্ডী

হুগলির গুপ্তিপাড়ায় যেমন বারো জন বন্ধু মিলে বারোয়ারি দুর্গা পুজোর আরম্ভ করেছিল, ঠিক তেমনই উত্তরবঙ্গের এই কালীপুজোর সূত্রপাত হয়েছিল পাঁচ জন বন্ধুর হাতে। যেন পাঁচ ইয়ারি কথা, পাঁচ বন্ধুর বন্ধুত্বের জয়গাথা। আজ সেই পুজো গোটা বঙ্গে বিখ্যাত। যা মালদহের হবিবপুরের বুলবুলচণ্ডীর পুজো নামেই পরিচিত। কেবল কার্তিক মাসের অমাবস্যায় একদিনের পুজো নয়, দু-দিন বা পাঁচ দিন নয়, মা এখানে ১৩ দিন ধরে পুজো পান। এটাই এখানকার বিশেষ রীতি, বা বিশেষত্ব। পুজোর ১৪তম দিনে দেবীর বিসর্জন হয়।
 
হবিবপুরের বুলবুলচণ্ডীর আরেকটি বিশেষত্ব হল দেবীর আকার, অতিকায় প্রতিমা এককথায়। অতিকায় কালী প্রতিমা বললেই আমাদের শান্তিপুর, নয়ত নৈহাটির কথা মনে পড়ে কিন্তু পিছিয়ে নেই হবিবপুরের বুলবুলচণ্ডীও।
 
আজ থেকে সাড়ে সাত দশক আগে পাঁচ বন্ধুতে একজোট হয়ে মায়ের আরাধনা শুরু করেছিলেন। এই পুজো নিয়ে এক কিংবদন্তি রয়েছে, ১৯৪৯ সালে বুলবুলচণ্ডী এলাকারই বাসিন্দা, সেখানকার ফেরিঘাটের এক কেউকেটা কর্মী স্বপ্নাদেশ পেয়ে, তার বন্ধুদের নিয়ে কালীপুজোর সূচনা করেন। তখনও জমিদারি প্রথা ক্ষয়িষ্ণু হলেও ছিল। তৎকালীন জমিদার এভাবে সর্বজনীন কালীপুজো মেনে নিতে পারেননি। পুলিশে অভিযোগ জানিয়ে ফেরিঘাটের ওই কর্মী ত্রিবেণী সিং ও তাঁর সঙ্গীদের গ্রেপ্তার করা হয়। পরে পুজোর পক্ষে জনমত তৈরি হলে পুলিশ তাদের বাধ্য হয়ে ছেড়ে দেয়। তারপর থেকে জাঁকজমক করে এই কালীপুজো হয়ে আসছে।​
 
যখন প্রথম পুজো শুরু হয়েছিল, তখন অর্থবল ছিল না। তাই প্রথম বছর প্রতিমা আকারে ছিল ছোট, মাত্র সওয়া হাতের। কিন্তু কাল ক্রমেই মাতৃ আরাধনা বৃহৎ পরিসরে হওয়া শুরু হল। পুজোর আড়ম্বরের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিমার আকারও বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে এই পুজোর প্রতিমার উচ্চতা ৪৮ ফুটে পৌঁছে গিয়েছিল। যদিও পরে অবশ্য স্থায়ী মন্দির হওয়ায় এখন প্রতিমার উচ্চতা কমিয়ে ৪২ ফুট করা হয়েছে। প্রত্যেক বছর ৪২ ফুটের প্রতিমার আরাধনা করা হয়। এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিমা গড়া হয়। বংশ পরম্পরায় তিন পুরুষ ধরে স্থানীয় পাল পরিবার প্রতিমা গড়ে চলেছেন। ১০০ বাঁশ, এক ক্যুইন্টাল দড়ি ও পেরেক লাগে প্রতিমা নির্মাণে। পুজোয় কোনও বলির চল নেই। তবে মায়ের কাছে উৎসর্গ করার রেওয়াজ রয়েছে।
 
পুজোকে কেন্দ্র করে বিপুল সমাগম হয়। মেলা বসে, পুজো চলাকালীন ১৩ দিন ধরে মেলা চলে। বড় কালীর বিসর্জন পর্বও দেখার মতো। হবিবপুরের বুলবুলচণ্ডীর বিসর্জন দেখতেও মানুষ ভিড় জমান। বিসর্জনেও নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। পুজোর ১৪ তম দিনে প্রতিমা বিসর্জন করা এখানকার রীতি। পুজো দেখতে কেবল মালদহ নয়, রাজ্যের নানান প্রান্ত থেকে মানুষ আসেন বুলবুলচন্ডীতে। কাঠামোর উপর ভর করে বাঁশের উপর দিয়ে গড়িয়ে অভিনব কায়দায় প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...