তাঁর অনেক পরিচয়। কখনও তিনি শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, স্বাধীনতা সংগ্রামী, সাংবাদিক, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, লেখক আবার কখনও তিনি সমাজসেবক, সমাজ সংস্কারক। মহাত্মা গান্ধী তাঁকে "মহামনা" উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি মদনমোহন মালব্য। উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদ শহরে ১৮৬১ -এর ২৫ শে ডিসেম্বর পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য জন্মগ্রহণ করেন। যদিও পারিবারিক পদবি ছিল চতুর্বেদী।
তাঁর পূর্বপুরুষের আদি বাসস্থান ছিল মধ্য প্রদেশের "মালব" অর্থাৎ উজ্জ্বয়িনী। তারপর থেকেই মালব্য হিসেবেই পরিচিত হয়ে যান। তাঁর বাবা ছিলেন সংস্কৃতের মহাপন্ডিত পণ্ডিত ব্রীজনাথ এবং মা মুনা দেবী। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা ছিল পাঠশালায়। সংস্কৃতে তিনি ছিলেন পারদর্শী। ১৮৭৯ সালে মুইর কেন্দ্রীয় কলেজ (আধুনা এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে স্নাতক হয়ে স্থানীয় একটি স্কুলে পড়াতে থাকেন।
কালাকঙ্করের রাজা রামপাল সিং ১৮৮৬ সালে কলকাতায় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনে তাঁর ভাষণ শুনে ও ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে কংগ্রেসের যোগ দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। তখন থেকেই তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা। প্রায় পাঁচ দশক ধরে কংগ্রেসী রাজনীতি করেছেন মালব্য। এই পাঁচ দশকে তিনি চারবার কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেগুলি হল যথাক্রমে লাহোর, দিল্লি, দিল্লি, এবং কলকাতা। ভারতের স্বাধীনতার আগে মদনমোহন মালব্যই একমাত্র নেতা যিনি চার বার কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আইনসভার সদস্য হিসেবে তিনি কাজ করেছেন দীর্ঘ ১১ বছর (১৯০৯-২০)।
১৯১৬ সালে মদনমোহন মালব্য বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, ১৯১৯ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত উপাচার্যের দায়িত্ব সামলেছিলেন তিনি। এর আগে ১৯০১ সালে মদনমোহন মালব্য এলাহাবাদে হিন্দু হোস্টেল নামে একটি ছেলেদের হোস্টেল স্থাপন করেন। ১৯১৩ সালে তিনি স্কাউটিং-অনুপ্রাণিত সংগঠন 'সারা ভারত সেবা সমিতি' তৈরি করেছিলেন। পণ্ডিত মদনমোহন মালব্যর উদ্যোগে হরিদ্বারে কুম্ভমেলার সময় ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ৯ ই এপ্রিল সারা ভারত হিন্দু মহাসভা গঠিত হয়। একদিকে শিক্ষা বিস্তার অন্য দিকে দেশের স্বাধীনতার লড়াই। স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। কংগ্রেসের নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের মধ্যে মধ্যস্থতা করেছিলেন তিনি। নরমপন্থী গোখলে ও চরমপন্থী তিলকদের বেঁধে রেখে স্বাধীনতা আন্দোলনকে অক্সিজেন দিয়ে গিয়েছেন মদনমোহন মালব্য।
লবণ সত্যাগ্রহ ও অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৯৩২ সালের ২৫ মে দিল্লি থেকে মালব্য গ্রেফতার হন। আবার খিলাফৎ আন্দোলনে কংগ্রেসের যোগদানের বিরোধিতা করেছিলেন তিনি। মালব্য বিনা খরচে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার পক্ষপাতি ছিলেন। সেই ভাবনা থেকেই বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি।
১৯০৬ সালে হিন্দু মহাসভার স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। ১৯১৬ সালের লক্ষ্ণৌ চুক্তির বিরোধীতা ভারত ভাগের এক চক্রান্ত নস্যাৎ করেন। ১৯২৮ সালের সাইমন কমিশনের বিরোধিতা করেন, ১৯৩২ সালের ৩০ মে, বিলাতি দ্রব্য বর্জন করে ভারতীয় দ্রব্য কেনার আবেদন জানিয়ে স্বদেশী আন্দোলনের ঢেউকে প্রসারিত করেন। ১৯৩০ সালে তিনি প্রথম গোলটেবিল বৈঠকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। এই সময়ের মধ্যে প্রায় সবকটি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন তিনি।
মদনমোহন মালব্যের জীবনের অন্যতম বড় কৃতিত্ব ছিল হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি আজ এশিয়ার বৃহত্তম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত। কলা, বিজ্ঞান, যন্ত্রবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, কৃষিবিদ্যা, চারুকলা, আইন ও প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন বিভাগ মিলিয়ে প্রায় ৩৫ হাজার ছাত্রছাত্রী এখানে পড়াশুনো করেন।
১৯১৮ সালে দিল্লিতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার সময় পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য মুণ্ডকোপনিষদ থেকে "সত্যবেম জয়তে" অর্থাৎ সত্যের জয় অনিবার্য, এই কথাটিকে নীতিবাক্য হিসেবে স্থির করেন। পরবর্তীকালে এটি স্বাধীন ভারতবর্ষের নীতিবাক্যে পরিণত হয়েছে।
তাঁর আরেকটি দিকের কথা না বললেই নয়। স্কুলে পড়াকালীন তিনি মকরন্দ ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন। ১৮৮৩-৮৪ সালের মধ্যে 'মকরন্দ' ছদ্মনামে লেখা তাঁর কবিতাগুলি বিশিষ্ট সাহিত্যিক ভারতেন্দু হরিশ্চন্দ্র কর্তৃক প্রকাশিত হরিশ্চন্দ্র চন্দ্রিকা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। হিন্দি প্রদীপ পত্রিকায় তাঁর ধর্মীয় ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে রচিত প্রবন্ধগুলিও প্রকাশিত হয়।
১৮৮৭ সালে হিন্দি দৈনিক হিন্দুস্তান-এ সম্পাদনার মাধ্যমে মদনমোহন মালব্য তাঁর সাংবাদিক কর্মজীবন শুরু করেন। ১৮৮৯ সালে তিনি দ্যি ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন পত্রিকার সম্পাদনার কাজ শুরু করেন। দ্যি ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন, লক্ষ্ণৌ অ্যাডভোকেট পত্রিকার সঙ্গে মিশে গেলে মদনমোহন মালব্য তাঁর নিজস্ব হিন্দি দৈনিক অভ্যুদয়-এর সম্পাদনা শুরু করেন। ১৯০৭ থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত তিনি এই পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। ১৯০৮ সালে ব্রিটিশ সরকার মুদ্রণ আইন ও সংবাদপত্র আইন পাস করতে চাইলে মদনমোহন মালব্য এলাহাবাদে একটি সর্বভারতীয় সমাবেশ ডেকে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন।
এরপর তিনি একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করে সেই আন্দোলনকে সারা ভারতে ছড়িয়ে দিতে ব্রতী হন। মতিলাল নেহেরুর সাহায্যে ১৯০৯ সালে তিনি ইংরেজি পত্রিকা লিডার পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন। ১৯০৯ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত তিনি এই পত্রিকার সম্পাদক এবং ১৯১১ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত এই পত্রিকার সভাপতি থাকেন। একই সঙ্গে ১৯১০ সালে মদনমোহন মালব্য হিন্দি পত্রিকা মর্যাদা চালু করেন।
ধর্মীয় বিভিজনের বিরুদ্ধে তিনি লড়েছেন আজীবন। ১৯৩২-এর ২৫শে সেপ্টেম্বর ড: বি. আর. আম্বেদকর ও পণ্ডিত মদনমোহন মালব্যর মধ্যে পুণা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে ঠিক হয়, দেশের প্রাদেশিক আইনসভাগুলিতে অনগ্রসর হিন্দু শ্রেণির জন্য আসন সংরক্ষিত থাকবে। কোনও পৃথক আইনসভা তৈরি হবে না।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র্যামসে ম্যাকডোনাল্ড সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির ভিত্তিতে অনগ্রসর হিন্দু শ্রেণির জন্য ৭১ টি আসন বরাদ্দ করেছিলেন। পুনা চুক্তির দরুন তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪৮ টি। এই পুণা চুক্তিতে ব্যবহৃত "অবদমিত শ্রেণি" শব্দবন্ধটি উঠে যায় এবং তার বদলে ব্যবহৃত হয় "তফসিলি জাতি ও উপজাতি।" পরবর্তীকালে ১৯৫০-এর ভারতীয় সংবিধানেও এই একই শব্দবন্ধ ব্যবহৃত হয়।
সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা ব্যবস্থায় ভারতের সংখ্যালঘুদের জন্য পৃথক আইনসভা গঠনের বিরোধিতা করে মাধব শ্রীহরি আনের সঙ্গে কংগ্রেস ছাড়েন পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য। তৈরি করেন কংগ্রেস ন্যাশনালিস্ট পার্টি এবং কংগ্রেসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় আইনসভার নির্বাচনে এই দল ১২ টি আসনে জয়ী হয়।
কিন্তু এই মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী দেশের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি। ১৯৪৬ সালের ১২ ই নভেম্বর বারাণসীতেই পণ্ডিত মদনমোহন মালব্যর জীবনাবসান হয়।