"আসছে বছর আবার হবে" এই ধ্বনির মাধ্যমে জলে প্রতিমা নিরঞ্জনের সঙ্গে সঙ্গে আবাহনী গীত রচিত হয়। কাঠামোর মাটি ধুয়ে গিয়ে নতুন মাটি প্রলেপের অপেক্ষায় থাকে। রথের দিন কাঠামো পুজো হয়ে আবার নতুন মাটির প্রলেপ পড়ে। সেই সঙ্গে ঢাকে কাঠি পড়ে পুজোর গন্ধ আকাশে- বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলায় যে দুর্গা প্রতিমা তৈরি হয় তার মূলত দুটো প্রাচীন রীতি প্রচলিত রয়েছে। একটি হল "বিষ্ণুপুর রীতির প্রতিমা" অন্যটি হল "কংস নারায়ণ রীতির প্রতিমা"। কম-বেশি এই দুই রীতি মেনেই প্রতিমা তৈরি হয়।
বাৎসরিক শারদীয়া পুজোর সময় পাথরের মূর্তির পরিবর্তে কাদা-মাটি দিয়ে মূর্তি নির্মাণের রীতি আজ থেকে প্রায় এক হাজার পূর্বে শুরু হয়েছিল। বাংলার প্রতিমা শিল্পে কাদা-মাটি ব্যবহারের পথিকৃৎ হলেন বাংলার দুই রাজা। একজন হলেন পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের মল্লরাজা জগৎমল্ল। অপরজন হলেন পূর্ববঙ্গের ( বর্তমানে বাংলাদেশ) রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ণ। তাঁরা দু'জনেই দুটি ভিন্ন রীতির মৃৎপ্রতিমা নির্মাণ কৌশল সৃষ্টি করেছিলেন।
রাজা জগৎমল্ল সর্বপ্রথম "বিষ্ণুপুর রীতির প্রতিমা" সূচনা করেন। সময়টা ৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দ। নিজ মন্দিরের জন্য তিনি প্রতিমা নির্মাণ করিয়েছিলেন। সেই সময়ই প্রথম এই রীতি প্রয়োগ করা হয়। তারপর থেকেই "বিষ্ণুপুর রীতির প্রতিমা"র প্রচলন শুরু হয়। বর্তমানে বিষ্ণুপুর ছাড়া বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা রাজবাড়ীগুলি এই রীতি অনুসরণ করে প্রতিমা নির্মাণ করে চলেছে। তবে "কংস নারায়ণ রীতি" অপেক্ষা এটি কম জনপ্রিয়।
শুধুমাত্র বাঁকুড়া জেলা ও রাঢ় বাংলার হাতে গোনা কিছু পরিবারে এই রীতি অনুসৃত হয়। কাঠামোর উপরের দিকে থাকে গণেশ ও কার্তিক এবং নিচে থাকে লক্ষ্মী ও সরস্বতী। প্রতিমার পিছনে পটে আঁকা চালচিত্র থাকে না। তার পরিবর্তে মহাদেব তাঁর দুই অনুচর নন্দী ও ভিঙ্গির সঙ্গে কাঠামোর উপরে অবস্থান করেন। রাঢ় দেশের বহু জায়গায় দুর্গা প্রতিমার পরিবর্তে শুধু প্রতিমার মুখ থাকে।
রাজা কংস নারায়ণের বহুকাল আগে থেকেই বঙ্গদেশে দুর্গাপুজোর প্রচলন ছিল। তবে তাঁর হাত ধরে তা জনপ্রিয়তা পায়। ১৪৮০ খ্রিষ্টাব্দে মন্দির প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে সর্বজনীন দুর্গোৎসব আরম্ভ হয় তাঁর হাত ধরে। সেই পুজোয় প্রায় ৮ লক্ষ টাকা তিনি ব্যয় করেছিলেন। যা বাঙালি সমাজে কিংবদন্তি তৈরি করেছিল। এরপর "কংস নারায়ণ রীতি" সমগ্র বঙ্গদেশে ছড়িয়ে পড়ে। নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই রীতিকে আরও জনপ্রিয় করে তোলেন।
প্রতিমার চালির উপরের দিকে লক্ষ্মী ও সরস্বতী। গণেশ ও কার্তিক নিচে। প্রতিমার পশ্চাতে থাকে অর্ধচন্দ্রকার চালচিত্র। চালিতে দশমহাবিদ্যা ও মহাদেব আঁকা থাকে। এই ধরণের চালিকে "বাংলা চালি" বলা হয়। প্রতিমার মুখের আদলে থাকে অভিনবত্ব। দেবীর টানাটানা চোখ ও টিয়া পাখির ঠোঁটের মতো বাঁকানো নাক। গাল সামান্য চাপা। এই ধরণের মুখের আদলের নাম "বাংলা মুখ"। প্রতিমার বর্ণ হয় গাঢ় হলুদ।
কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ির প্রতিমা এই রীতিতে এখনও তৈরি হয়। পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ জমিদার ও রাজবাড়িগুলোর দুর্গা প্রতিমা এই ধ্রুপদী রীতি অনুসরণ করেই নিমার্ণ করা হয়। তবে সাবেকি রীতির প্রতিমায় স্থান ও সময়ভেদে পার্থক্য ঘটেছে। কিছু কিছু রাজবাড়ীতে নিজস্ব রীতিও অনুসৃত হয়। "বাংলা চালি"র পরিবর্তে "মার্কিন চালি" ব্যবহার করা হয়। "কংস নারায়ণ রীতি"তে "টানাচৌরি চালি" ও "মঠচৌরি চালি"ও লক্ষ্য করা যায়।
মূর্তি তৈরির প্রধান উপাদান মাটি ও জল। প্রতিমা নির্মাণ কাজে যে সকল উপকরণগুলো প্রয়োজনীয় সেগুলো হল জলধারা বা পারোল, পাট বা প্লাস্টিকের বস্তা, সুতো, পাট তন্তু( পাটের 'থেতু'), খড়, কাঠ ও বাঁশের টুকরো, সুতি জাতীয় কাপড়ের টুকরো, রং, খড়িমাটি, আঠা ও পিনকাঠি।
প্রতিমা তৈরির দরকারি যন্ত্রপাতিগুলো হল- কোদাল, চান্নি বা চালুনি, হাতুড়ি, করাত, আগর( আখোর), দা(দাও), কুরশি, কেলাই বা চাড়া, কাঁচি, বিভিন্ন আকারের ছাঁচ। এছাড়া ফাপি( বাঁশের তৈরি সরু ও মোটা) এবং বিভিন্ন পরিমাপের তুলি বা ব্রাশ।
প্রথমে মাটিকে ভালো করে প্রতিমা তৈরির উপযোগী করে নিতে হয়। প্রাথমিক পর্বে মাটি আনার পর কোদাল দিয়ে টুকরো টুকরো করে মাটি কাটা হয়। এরপর কাটা টুকরোগুলোকে একত্রিত করে কুরশির সাহায্যে মসৃণ করে গুঁড়ো করা হয়। গুঁড়ো মাটিকে চালুনির সাহায্যে ছেঁকে নেওয়া হয়। তারপর মসৃণ মাটিকে জলে ভিজিয়ে রাখা হয়। পরিমাণ মতো জল দিয়ে হাত ও পায়ের সাহায্যে চটকে নেওয়া হয়। মাটি নরম না হওয়া পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। খড়ের ছোট ছোট টুকরোর সঙ্গে মাটি ও জল মিশিয়ে একটি কাদা মাটির মিশ্রণ তৈরি করেন শিল্পীরা।
পাটের তন্তুর(পাটের বাটি বা সুতলি) সাহায্যে প্রতিমার আকৃতি অনুযায়ী খড় বেঁধে নেওয়া হয়। খড়ের সাহায্যে যে কাঠামো তৈরি হয় তা প্রতিমার আকার প্রদান করে। খড়ের কাঠামোর উপরে জল, মাটি ও খড় মেশানো প্রলেপ লাগানো হয়। প্রলেপ শুকিয়ে গেলে আবার পাট তন্তুর দ্বারা প্রলেপ দেওয়া হয়। মূর্তি তৈরির প্রথম অবস্থায় কাঠ বা বাঁশের পাটাতন তৈরি করে লোহার কাঠি( পচি/ খিলা) দিয়ে প্রতিমার পা ( বাঁশ দণ্ড) স্থাপন করেন।
এরপর বাঁশ বা কাঠের দণ্ডকে খড়ের সাহায্যে পেঁচানোর পর প্রতিমার আকৃতি অনুযায়ী প্রতিমার পা তৈরি করা হয়। পা তৈরির পর শুরু হয় দেহ তৈরির কাজ। বড় মূর্তির ক্ষেত্রে পা ও দেহ উভয় জায়গায় কাঠ বা বাঁশের দণ্ড যুক্ত করা হয়। এরফলে প্রতিমা সোজা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। ছোট প্রতিমার ক্ষেত্রে পিঠে দণ্ড থাকে। প্রতিমার মুখ তৈরি করা হয় কালো মাটি দিয়ে। এই মাটিকে শিল্পীর ভাষায় বলা হয় " কুমার মাটি"। এছাড়া মুখ তৈরি করতে "আলোয়া মাটি"ও ব্যবহার করা হয়।
বর্তমানে শিল্পীরা ডাইস বা ছাঁচের সাহায্যে প্রতিমার মুখ তৈরি করেন। পাটতন্তু ও কুমার মাটি মিশিয়ে তৈরি করা হয় প্রতিমার আঙুল। মূর্তি তৈরির পর রৌদ্রে শুকিয়ে নেওয়া হয়। শুকনোর পর মূর্তির মধ্যে কিছু অমসৃণ ও অসমান জায়গা দেখা যায়। কাদামাটির প্রলেপ দিয়ে তা বুজিয়ে দেওয়া হয়। নির্মিত প্রতিমা কাঠ ও বাঁশের তৈরি একটি পাটাতনের উপর লোহার কাঠির সাহায্যে বসানো হয়। এবার মূর্তি শুকনোর পালা।
কেশসজ্জায় শিল্পীরা এক বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করেন। পাট তন্তুর ( পাটের ফেসা) দিয়ে তৈরি হয় কালো চুল। গরম জলে কালো রং গুলে তৈরি হয় এই রং। খুব সরু ও নরম পাটের ফেসা পাট কাঠির মধ্যে পেঁচিয়ে কিছুক্ষণ রেখে দিলে কোঁকড়া হয়ে যায়। এইভাবে কোঁকড়া চুল তৈরি করা হয়।
কপালে যুক্ত করা হয় ক্রেপ চুল। রং হীন পাট তন্তুকে সাদা চুল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সাদা চুল দিয়ে সাধারণত শিবের চুল করা হয়। পুরুষ দেবতার কালো চুল করা হয় কালো রঙের ফেসা দিয়ে। চুল ছোট হলে তা আঙুলের সাহায্যে ভাঁজ করা হয়। এই ধরণের চুলের স্থানীয় নাম "মুটুক কুশা চুরি"।
শিল্পীরা নানা ধরণের রং ব্যবহার করেন প্রতিমার রূপ সজ্জায়। আগে প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে কেমিক্যাল রং ব্যবহার করা হচ্ছে। পূর্বে সুতির ন্যাকড়া, পায়রার পালক ও সরু কাঠিকে রং করার কাজে ব্যবহার করা হতো। এখন নানা সাইজের তুলি বা ব্রাশ ব্যবহার করা হয়। সবশেষে করা হয় প্রতিমার অঙ্গ সজ্জার কাজ। এইভাবে মৃন্ময়ী প্রতিমা ধীরে ধীরে চিন্ময়ী রূপ ধারণ করে।