সুডোকু ও মাকি কাজি

ফেলুদার এক অদ্ভুত অস্ত্র ছিল, যার জোরে মগনলাল থেকে মন্দার বোস সকলেই কুপোকাত হয়েছে। তার নাম মগজাস্ত্র, সেই মগজাস্ত্রের মাদকতায় মশগুল আমরা সবাই।
 
পেটের পুষ্টি, পেশির পুষ্টির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মগজের পুষ্টিও খুব দরকার। মগজের ব্যায়াম করতে যাঁরা ভালোবাসেন, তাঁরা সকলেই হয়তো ধাঁধা, হেয়ালি, পাজেল সমাধান করতে ভালোবাসেন। ঠিক তেমনই, এও এক ভুলভুলাইয়া। না না ভূতের কোন ব্যাপার নেই, এ জিনিস খাঁটি গোলকধাঁধা। তবে মজার, সঙ্গে রয়েছে সংখ্যার বেড়াজাল। মগজাস্ত্রে শান দিতে এ জিনিসের জুড়ি মেলা ভার, আপনার গ্রে সেল-কে উত্তেজিত করতে এর বিকল্প হয় না।
 
কী নাম সেই শান দেওয়ার হাতিয়ারের?
 
নামটির সঙ্গে আজ কমবেশি আমরা সকলেই পরিচিত। এর নাম সুডোকু। মজার খেলা এই সুডোকু। এটি একটি #বর্গক্ষেত্র, যার মধ্যে রয়েছে আরো ছোট ছোট নয়টি বর্গক্ষেত্র। সেই ছোট ছোট বর্গক্ষেত্রগুলিই আবার ছোট্ট ছোট্ট নয়টি বর্গাকার খোপ নিয়েই তৈরি। নয় নয় করে কিন্তু কম হল না খোপের সংখ্যা। মোট ৮১টি খোপ নিয়েই তৈরি হয় একটি সুদোকুর ব্লক।
 
এবার আসি খেলার কথায়, এই খোপগুলির কয়েকটি পূর্ণ করা থাকে, আর বাকি গুলো সংখ্যা দিয়ে পূরণ করতে হয়। এখানেও থাকে নয়। এক থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যা দিয়েই, সেই ফাঁকা খোপ পূরণ করতে হয় খেলোয়াড়দের।
 
তা বলে এত সোজা নয়, হুঁ হুঁ! বাবা, নয়ের খেলা। ছোট খোপ গুলির প্রতিটিতে ১-৯ -এর মধ্যে সংখ্যা এমন ভাবে লিখতে হবে, যাতে কোনো সংখ্যা একই খোপে দু'বার না বসে যায়। অর্থাৎ কোনো সংখ্যা রিপিট হলে, নয়ছয় হয়ে এই নয়ের ধাঁধা ভেস্তে যাবে। খেলোয়াড় আউট হয়ে যাবেন।
 
sod ss
 
এ তো গেল ছোট খোপেদের কথা, বড় বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রেও তাই নিয়ম, কোনো কলাম বা রো-তে একই সংখ্যা দু'বার বসানো যাবে না। পাশাপাশি, কোনাকুনি, উপরনীচে কোনো লাইনেই কোনো ভাবেই এক সংখ্যা দুবার আসবে না। এটাই নিয়ম এই খেলার। যতটা সোজা শুনে মনে হয়, খেলতে ততটা জটিল। বেশ বেগ পেতে হয়। আর যত বেগ পেতে হবে, তত মজা ধাঁধাপ্রেমী মানুষের। অনেকটা ম্যাজিক স্কয়ার #ম্যাট্রিক্সের মতো।
 
গোটা পৃথিবীর সঙ্গে ভারতসহ বাংলাও এখন সুডোকুর ম্যাজিকে মজেছে। বাংলা সংবাদপত্রে বহুদিন ধরেই শব্দছক দেওয়ার প্রচলন ছিল। ২০১২ সালে একটি বিখ্যাত বাংলা ট্যাবলয়েড প্রথম সুডোকু দিতে শুরু করে তাদের পত্রিকায়। সেই পত্রিকার হাত ধরেই সুডোকু পৌঁছে গেল আমাদের ড্রইংরুমে, চা কফি খেতে বাঙালি মেতে উঠল সংখ্যার ধাঁধার সমাধানে। আসলে সাহিত্য আর সিনেমার কল্যাণে আমাদের সবার মনেই একটা করে ফেলু, ব্যোমকেশ বাস করে। ব্যাস, আমরা আপন করে নিলাম সুডোকু-কে। দিন যত এগিয়েছে, এর জনপ্রিয়তা তত বৃদ্ধি পেয়েছে।
 
খেলতে গিয়ে মাথার ঘাম ছুটে যায়, সময়ও কাটে, মগজের ব্যায়ামও হয়। আধুনিক যে সুডোকুর কথা এতক্ষণ হল, তার জন্ম জাপানে। আর এমন না হলে কী জাপানি খেলা মানায়! যা সারা পৃথিবীকে এখনও মাতিয়ে রেখেছে।
 
সেই খেলার স্রষ্টাই চলে গেলেন না ফেরার দেশে, সোমবার জাপানের বিখ্যাত ধাঁধা পত্রিকা নিকোলাই-তে প্রকাশিত একটি শোকবার্তায় জানানো হয়েছে এই নীরব বিদায়ের কথা। গত ১০ আগস্ট ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে #মাকি_কাজি প্রয়াত হয়েছেন।
 
মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৬৯ বছর। এই মাকি কাজি নামটির সঙ্গে হয়তো আমরা অনেকেই পরিচিত নই। মাকি কাজিই হলেন সুডোকুর গডফাদার, সুদোকুর আধুনিকতম রূপ আবিষ্কার করেন তিনিই। কিন্তু কোনোরকম ট্রেডমার্ক বা পেটেন্ট নিতে চাননি মাকি। শুধু চেয়েছিলেন, সারা পৃথিবীর মানুষ স্বাদ পাক সুডোকুর, মেতে থাকুক সুডোকুতে। তাই হল, তিনি নেশা ধরিয়ে দিয়েই চলে গেলেন। সৃষ্টির মাদকতায় মেতে আছে দুনিয়া, স্রষ্টার কাছে এর চেয়ে বেশি আর কি প্রাপ্তি হতে পারে!
 
প্রকৃতপক্ষে সুদোকুর ইতিহাস কিন্তু ধোঁয়াশায় ঢাকা। কেউ কেউ বলেন গণিতজ্ঞ #অয়লারের হাত ধরে এই খেলার প্রচলন। আরেকটি জনশ্রুতির মতে, এই খেলার জন্ম বহু বছর আগেই চিনদেশে হয়েছিল, তারপর সেখান থেকে #ভারত হয়ে #আরবে পৌঁছেছিল। আরব থেকেই এই খেলার সম্পর্কে জেনেছিলেন অয়লার।
 
তবে ঐ সময়ে এই খেলা এমন চিত্তাকর্ষক, মনমোহিনী ছিল না। ফাঁকিবাজ পড়ুয়াদের শাস্তি দিতে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হত এই ধাঁধার সমাধানের জন্য।
 
ভাবুন, এক শাস্তি একবিংশ শতাব্দীতে এসে পরিণত হচ্ছে জনপ্রিয়তম খেলায়।
প্রাচীনকালে এই খেলার নাম এত সুন্দর ছিল না। একেই আধুনিকতম ও জনপ্রিয়তম রূপ দিয়েছেন মাকি, তাই আধুনিক সুডোকুর গডফাদার অবশ্যই মাকি কাজি।
 
১৯৮০-র দশকে মাকির হাত ধরে আধুনিক সুডোকু যাত্রা শুরু করে।
 
১৯৫১ সালে উত্তর জাপানের সাপ্পোরো শহরে জন্ম হয় মাকি কাজির, অঙ্কের প্রতি ছোট্টবেলা থেকেই অগাধ ভালোবাসা ছিল মাকির। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাকি মাঝপথেই তাঁর ইউনিভার্সিটির পড়াশোনা ছেড়েদিলেন।
 
হ্যাঁ, পৃথিবীর সব বিস্ময় সৃষ্টি বোধহয় এইভাবেই হয় অনিশ্চিয়তার মধ্যেই...বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার কারণ কী? তিনি তৈরি করবেন সম্পূর্ণ নতুন ধারার এক ধাঁধা পত্রিকা।
 
sod s
 
জাপানে নানান ধরণের ধাঁধাই বেশ জনপ্রিয়, ওরা ধাঁধা ভালোবাসেন। সেই ধাঁধা নিয়েই ধারাবাহিক পত্রিকা! আদৌ চলবে তো? অনেকেই অনেকে আপত্তি করলেন, বাধা দিলেন ধাঁধার ধারাবাহিকে। কিন্ত টললেন না মাকি, ধাঁধার পথ থেকে সরলেন না। কারোর কোনো কথাতেই কান দেননি তিনি। ১৯৮০ সাল থেকেই প্রকাশিত হতে শুরু করল নিকোলাই পত্রিকা। পত্রিকা কিন্তু প্রথম থেকেই জনপ্রিয়তা পায়নি, মাকি বুঝলেন, এমন একটা খেলা দরকার যা সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের এবং যার মধ্যে নতুনত্ব থাকবে।
 
ব্যাস, নানা দেশের ধাঁধা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন মাকি কাজি। খুঁজেও পেলেন এই সংখ্যার খেলা। তারপর সেই খেলাকে সহজ করে নিয়ে নতুন নিয়ম তৈরি করেন। এবার এই খেলার নাম দিতে হবে, তিনি প্রথমে দিয়েছিলেন ‘সুজি ওয়া দকুসিন নিকাগিরু’। জাপানি ভাষায় যার অর্থ, প্রতিটি সংখ্যা একবার। কিন্তু তাঁর সহকর্মীদের এই নাম পছন্দ হয়নি। ছোট এবং মজার, আকর্ষণীয় একটি নাম দরকার। মাকি নিজেই দুটো অক্ষর বাছলেন। খেলার নতুন নাম হয়ে গেল সুডোকু, বাকিটা ইতিহাস।
 
নিকোলাই পত্রিকা আর সুডোকুর জনপ্রিয়তাও বাড়তে লাগল একই সঙ্গে। ২০০৪ সালের আগে জাপানের বাইরে সুডোকু নিয়ে তেমন মাতামাতি ছিল না, কিন্তু সে বছর দ্য টাইমস অফ লন্ডন পত্রিকায় একটি সুডোকু প্রকাশ পেতেই ইউরোপ জুড়ে সাড়া পড়ে যায়। হইচই উন্মাদনা শুরু হয় সুদোকু নিয়ে। বাকিটা ইতিহাস। জীবদ্দশায় এর জনপ্রিয়তা তিনি দেখে গেলেন।
 
দেখতে দেখতে এই খেলা ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীতে, মাকি কাজি নিজেই সুডোকুর প্রচারের জন্য প্রায় ৩০টি দেশ ঘুরেছেন।
 
এখন প্রতি বছর শুধু সুডোকু প্রতিযোগিতাতেই অংশ নেন অন্তত ২০ কোটি মানুষ, ছোট-বড় সকলেই, আট থেকে আশি সকলেই আপন করে নিয়েছেন এই মজার ধাঁধাকে। সুডোকুর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ানশিপ ভারতের গোয়া এবং বেঙ্গালুরুতেও হয়ে গিয়েছে।
 
এই প্রতিযোগিতাগুলি থেকে কিন্তু একটি টাকাও নিতেন না মাকি। কারণ তাঁর কোনো পেটেন্টই ছিল না। সুদোকুর এই আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তাকেই, মাকি তাঁর নিজের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার বলে মনে করতেন।
 
তিনি কর্কট রোগে আক্রান্ত হন, অকেজো হয়ে পড়ে তাঁর খাদ্যনালী। দীর্ঘদিন ধরেই শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করেও তিনি নিকোলাই পত্রিকার যাবতীয় দায়িত্ব সামলে গিয়েছেন।
 
পরিশেষে কর্কট জিতে গেল। মাকি কাজি চলে গেলেন, পড়ে রইল তাঁর ফেলে যাওয়া এক ধাঁধা, যার নাম সুডোকু। যা মাতিয়ে রেখেছে গোটা বিশ্বকে, হয়ত প্রজন্মের পর প্রজন্ম মেতে থাকবে সুডোকুর নেশায়। ধাঁধা আর সংখ্যার ম্যাজিকে বুঁদ হয়ে কাটিয়ে দেবে অবসর। মগজাস্ত্রে শান দেওয়ার এই খেলার মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন মাকি কাজি।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...