হাওড়া অন্যতম প্রাচীন তথা ইতিহাস প্রসিদ্ধ এক জনপদ। একটু মশা-মাছির উপদ্রব কম হলে কলকাতা হয়ত ওপারেই গড়ে উঠত। হ্যাঁ, নাম অবশ্যই আলাদা হত। যাক সে অন্য কথা। হাওড়ার এক বিখ্যাত জায়গা হল মাকড়দহ। এখানেই রয়েছে দেবী মাকড় চণ্ডীর মন্দির। অনেকেই বলেন, দেবী মাকড় চণ্ডীর নাম থেকেই নাকি মাকড়দহ নামটির জন্ম। মাকড়দহের মা মাকড়চণ্ডী। হাওড়ার ডোমজুড় থানার অন্তর্গত মাকড়দহ। হাওড়া থেকে মুন্সীরহাট-ডোমজুড় সড়কের ওপরেই মাকড়দহ গ্রাম অবস্থিত। দেবী মাকড়চণ্ডীর নামেই এই জায়গার নামকরণ করা হয়েছে গবেষকরা এমনটাই বলেন। দেবীকে নিয়ে নানা কিংবদন্তি রয়েছে। শোনা যায়, এক সময় সরস্বতী নদী ত্রিবেনী থেকে বরাবর দক্ষিণ বাহিনীরূপে প্রবাহিত হয়ে মন্দিরের কাছে এসে পূর্ব বাহিনী হয়েছিল। বর্তমানে অবশ্য কয়েকটি জলাশয় দেখে নদীর গতিপথ সম্পর্কিত ধারণার সত্যতা বোঝা যায়। মজে যাওয়া খালগুলো সে সময়ের সাক্ষ্য বহন করে। দহ শব্দের অর্থ তো গর্ত। কিংবদন্তি অনুযায়ী, জনৈক শ্রীমন্ত সওদাগর সরস্বতী নদী পথে বাণিজ্য করতে যাওয়ার সময় স্বপ্নাদেশে এই মন্দির নির্মাণ করেন এবং মায়ের পুজো আরম্ভ করেন। তবে সেই মন্দির আজ আর নেই। নতুন মন্দির তৈরি হয়েছে তিন শতাব্দী আগে। এই মন্দিরে আজও তিনটি প্রস্তর খণ্ড ভগ্নস্তূপ বিদ্যমান, যা সে সময়ের সাক্ষী বহন করছে। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে মাকড়চণ্ডী দেবীর নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।
মন্দিরটির বর্তমান রূপটি নির্মাণ করেন মাহিয়ারির জমিদার রামকান্ত কুন্ডুচৌধুরীর। তার বয়সও তিনশো হতে চলল। মন্দিরটি ১৭৪৩ সালে মির্মিত হয়েছিল। বর্তমানে মন্দিরটিতে দেবীমন্দির , নাটমন্দির , নহবতখানা , ভোগমন্দির এবং শিবমন্দির সমস্তই রয়েছে। মায়ের মন্দিরের সামনে রয়েছে বেশ বড় একটি নাটমন্দির। এই মন্দিরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে দেবীর ভৈরবের একটি ছোট পূর্বমুখী মন্দির আছে। মন্দিরের পিছন দিকে রয়েছে সরস্বতী কুণ্ড। মাকড়চণ্ডী মায়ের মূর্তিটি লাল টকটকে সিঁদুরে রাঙানো শিলাখণ্ড। তারই উপরে রুপোর ত্রিনয়ন, নাকে নাকছাবি ও কানে কানপাশা দিয়ে সাজানো।
মাকড়চণ্ডী দেবীকে নিয়ে কিংবদন্তির অন্ত নেই। একটি মত অনুযায়ী বলা হয়, মার্কণ্ডেয় পুরাণ থেকে মাকড়চণ্ডী দেবীর নাম এসেছে। অন্য মতে, মকর থেকে মাকড়চণ্ডী নামটির উৎপত্তি। মকর শব্দের অর্থ কুমির। মাকড়দহের অনতিদূরে বয়ে গিয়েছে সরস্বতী নদী। সেখানে একসময় কুমিরের উৎপাত ছিল। এই নদী দিয়েই বাণিজ্য যাত্রা করতেন সওদাগরেরা। কুমিরের হাত থেকে বাঁচতে সে সময়ের বণিক-সওদাগররা মকরচণ্ডীর পুজো শুরু করেন। মকরচণ্ডী কালক্রমে মাকড়চণ্ডীতে পরিণত হন। কথিত আছে, বিখ্যাত শ্রীমন্ত সওদাগর নদীপথে বাণিজ্য করার সময় একবার দেবী মাকড়চণ্ডীকে স্বপ্নে দেখেন। তিনিই ওই অঞ্চলে দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময় নাকি সরস্বতী নদী ত্রিবেণী থেকে মুক্ত হয়ে দক্ষিণে বইতে শুরু করে। তারপর এই মন্দিরে কাছে এসে পূর্ব বাহিনী হয়। মাকড়চণ্ডীর কোনও মূর্তি নেই, লাল সিঁদুরে রাঙানো শিলাখণ্ডটিকে রুপোর ত্রিনয়ন, নাকছাবি ও কানপাশায় ভূষিত করে দেবী রূপে পুজো করা হয়। কার্তিক মাসের দীপান্বিতা অমাবস্যা অর্থাৎ কালীপুজোর দিন বিশেষ পুজো হয়, বিশেষ ভোগের ব্যবস্থাও থাকে। এই মন্দির ঘিরে অনেক গল্প শোনা যায়, যেমন একটা সময় মন্দিরের পুজোয় বাজা ঢাকের আওয়াজ যতদূর পৌঁছত, ততদূর আর অন্য কোনও পুজো হত না। মায়ের মন্দিরের সঙ্গেই রয়েছে শিব মন্দির। সেখানেও প্রতিদিন নিয়ম করে পুজো হয়। বলা হয়, এই শিব মন্দিরের পাশ দিয়েই সরস্বতী নদী বয়ে যেত যদিও এখন আর তা নেই। মন্দির লাগোয়া পিছন দিকে একটি পুকুর। সরস্বতী নদী অবরুদ্ধ হয়ে মজে গিয়ে পুকুরে পরিণত হয়েছে এমনটাই বলেন স্থানীয় মানুষজন।
শিলাখণ্ড আজও প্রাচীন সময়ের স্মৃতি বয়ে চলেছে। একদল বলেন, যুগের নিয়মে বিশাল মাতৃমূর্তি হাজার হাজার বছর ধরে পূজিত হচ্ছে। যত সময় যাচ্ছে, শিলাখণ্ড ক্রমশঃ ক্ষয়ে যাচ্ছে। এই সরস্বতী নদী পথেই এক সময়ে যাতায়াত করত বড় বড় বাণিজ্যিক তরী। বহু বণিক সরস্বতী নদী পথে বাণিজ্য করতেন। কোনও এক বণিক স্বপ্নাদেশ পেয়ে সরস্বতী তীরবর্তী বেতের জঙ্গলে পাতাল ফুঁড়ে ওঠা চণ্ডীর মূর্তির পুজো শুরু করেন। মা চণ্ডীর দেখভাল করেন আন্দুলের কুন্ডু পরিবার। চণ্ডীর মূর্তি ছিল বিশাল আকার, মায়ের গলায় মালা, চন্দন দিতে হত মইয়ের সাহায্য নিতে হত। সেই বিশাল মূর্তির মাথায় দেওয়া জল পুরোহিতের পায়ে পড়ত। জাগ্রত মা চণ্ডীর মাথার জল পুরোহিতের পায়ে পড়ে পুরোহিত পাপের ভাগীদার হচ্ছে, সে প্রতিদিন মাকে ডাকতে শুরু করে এবং এই পাপ স্খলনের উপায় জানতে চায়।পুরোহিতের কথা শুনে মা পাতালে প্রবেশ করতে শুরু করেন। পুরোহিত তা দেখে মূর্তিকে জড়িয়ে ধরেন, সেই থেকেই মাকড়দহ মায়ের দেহ অর্ধ আকার জেগে রয়েছে উপরে। হাজার হাজার বছর ধরে এভাবেই পূজিত হচ্ছেন মা। প্রতিদিন ভোরে জাগরণ মঙ্গল আরতি হয়, তারপর হয় মায়ের স্নান, সকাল থেকে চলে পুজো। দুপুর ১২ টায় ভোগ নিবেদন। ভোগে মাকে খিচুড়ি, চচ্চড়ি, তরকারি, পাঁচ রকম ভাজা, মাছ, পরমান্ন ও চাটনি নিবেদন করা হয়। ভোগের পর মন্দিরের দরজা বন্ধ করা হয়। বিকেল ফের খোলা হয়। সন্ধ্যায় আরতি হয়, পুজো চলে। মাকড় চণ্ডী অন্নপূর্ণা ও দুর্গা রূপেও পূজিতা হন। প্রতি বছর দোল উৎসবের পঞ্চম দিনে চাঁচর ও বাজি পোড়ানোর রীতি রয়েছে।পুজো উপলক্ষ্যে ১৫ দিন ব্যাপী মেলা বসে। জাগ্রত মা মাকড় চণ্ডীর পুজো দিতে আজও দূর-দূরান্ত থেকে বহু ভক্ত আসেন মন্দিরে। বাংলা এমন অনেক চণ্ডী রয়েছেন, নদীয়ার জাগুলিতে রয়েছে মশান চণ্ডীর মন্দির। পূর্ব বর্ধমানের আসানসোলে রয়েছে ঘাঘর চণ্ডীর মন্দির। প্রতিটি জায়গাতেই কোনও মূর্তি নেই। শিলাখণ্ডে পূজিতা হন দেবী চণ্ডী।