মকরসংক্রান্তি, ইতিহাস, উৎপত্তি এবং বিবর্তন

ভাস্কর চক্রবর্তী লিখেছিলেন, শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা? বাঙালির শীতকাল তো পিঠে-পুলির পিঠে চেপে আসে। পৌষের সংক্রান্তির কথা উঠলেই ভেসে উঠে পিঠে, পুলি, পায়েস দিয়ে রসনাতৃপ্তি, পিঠে-পুলির পার্বণ মানেই হল পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি। সংক্রান্তি শব্দের অর্থ সঞ্চার বা গমন করা। সংক্রান্তি শব্দটি বিশ্লেষণ করলেও একই অর্থ পাওয়া যায়।
 
সং+ক্রান্তি, সং অর্থ সঙ সাজা এবং ক্রান্তি অর্থ সংক্রমণ। ভিন্ন রূপে সেজে বা নতুন সাজে, নতুন রূপে সেজে অন্যত্র সঞ্চারিত হওয়া বা গমন করাকেই সংক্রান্তি বলা হয়। সূর্য এদিনই ধনু রাশি থেকে মকর রাশিতে প্রবেশ করে। সূর্য এদিন নিজের ছেলে, মকর রাশির অধিপতি শনির বাড়ি এক মাসের জন্য ঘুরতে গিয়েছিলেন। এর থেকেই মকর সংক্রান্তি তিথির উৎপত্তি।
 
এই তিথিটিকে ঘিরেই প্রাচীনকাল থেকে এই উৎসব চলে আসছে। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, ১৪ই জানুয়ারির আশেপাশে এই তিথিটি পড়ে। কিন্তু এক হাজার বছর আগেও ৩১ ডিসেম্বর নাগাদ মকর সংক্রান্তি পালিত হত। আবার হাজার খানেক বছর পরে, সেটি ফেব্রুয়ারিতে সরে যাবে।
 
এই তিথিতে বাংলা বছরের পৌষ মাসের অবসান হয়, হাওয়ার গতির দিক থেকে দেখলে ধরে নেওয়া হয় যে, এরপর শীতের প্রকোপ কমতে শুরু করবে। ভারতের উত্তরের প্রতিবেশী দেশগুলোতে ২২ বা ২৩ ডিসেম্বরের সময়টি খুব আনন্দের সঙ্গে পালিত হয়, কারণ ওই সময় সূর্য উত্তরে যাত্রা শুরু করে, যার নাম সূর্যের উত্তরায়ণ, যার ফলে আসতে আসতে ঠান্ডা কমতে থাকে। খ্রিস্টপূর্ব আমলে এটিই ছিল ইয়ুলটাইড উৎসব, পরে ক্রিসমাসের ব্যাপকতায় যা ম্লান হয়ে গিয়েছে।
 
মকর সংক্রান্তি নিয়ে নানান কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। মহাভারত অনুযায়ী, মকর সংক্রান্তি তিথিতেই, ভীষ্ম শরশয্যায় ইচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করেছিলেন। অন্য একটি মতানুযায়ী, এই দিন দেবতাদের সঙ্গে অসুরদের যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। অসুরদের বধ করে, বিষ্ণু তাদের কাটা মুন্ডু মন্দিরা পর্বতে পুঁতে দিয়েছিলেন।
 
তাই মনে করা হয় মকর সংক্রান্তির দিনই, সমস্ত অশুভ শক্তির বিনাস হয়ে শুভ শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই দিন থেকে সূর্য উত্তরায়ণের দিকে যাত্রা শুরু করে, তাই একে উত্তরায়ণ সংক্রান্তি বলা হয়। প্রচলিত বিশ্বাস মতে মনে করা হয়, এই তিথির ব্রহ্মমুহূর্তে যমুনা নদীতে মকরস্নান করলে আয়ুবৃদ্ধি হবে। এদিন মাতা যশোমতী বালক কৃষ্ণকে স্নান করাতে নিয়ে যান।
 
পৌষ সংক্রান্তিকে তিল সংক্রান্তিও বলা হয়। এদিন তিল দিয়ে নাড়ু, মিষ্টি তৈরি করে পূজায় নিবেদিত হয়। লোকবিশ্বাস, এই দিন তিল না খেলে নাকি দিন বাড়ে না অর্থাত্‍ সূর্যের মকর যাত্রা সংঘটিত হয় না। জনশ্রুতি রয়েছে, মকর সংক্রান্তির দিন যাত্রা করা শুভ নয়। 
 
মকরসংক্রান্তি আদ্যন্ত একটি ফসলী উৎসব। যা বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী, পৌষ মাসের শেষ দিনে এই উৎসব পালন করা হয়। পুজো করা হয়। বাঙালিরা পিঠে-পুলি, পায়েস বানিয়ে খাওয়ার মাধ্যমে এই উৎসব পালন করে থাকে। কেউ বাড়িতে এলেই তাকে মিষ্টি মুখ করানো হয়। কথিত, এই বিশেষ দিনটিতে সূর্যদেব পুত্র শনির প্রতি তাঁর ক্ষোভ ভুলে যান এবং তাঁর গৃহে সূর্যদেবের আগমন ঘটে।
 
তাই এই দিনে সকলে মিলিত হন এবং মিষ্টিমুখ করানোর মাধ্যমে মিষ্টি সম্পর্ক বজায় রাখার অঙ্গীকার করেন। আত্মীয়-পরিজনের আগমনে উৎসব পূর্ণতা লাভ করে। পিঠে বানানোর জন্য 'বাউড়ি'-র আগের দিন চাল কোটা হয়। এখানে এক মজার রীতি দেখা যায়, চালের গুঁড়ো, ভেজা চাল সর্বদা উঠোন-ঘর করতে হয় বলে, তুলসি পাতা আর শুকনো লঙ্কা দিয়ে তা পাত্র দিয়ে ঢেকে নিয়ে যেতে হয়। তা না হলে নাকি ভূতে পায়!
 
মকর সংক্রান্তির দিন সাধারণত সূর্যদেবের পুজো করা হয়। মকর সংক্রান্তির দিন সকালে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে সংক্রান্তির স্নান সেরে বাড়ির উঠোনে নানা রঙের আলপনা এঁকে ধান, দূর্বায় বাড়ির মা ঠাকুমারা সূর্যদেবের পুজো সারেন।
 
ভক্তদের বিশ্বাস, সূর্যদেবের আশীর্বাদে সকল রোগ-ব্যাধি নিরাময় হয়। দিনটিতে সকলেই নিজের ঘরবাড়ি, বিশেষ করে রান্নাঘর ও রন্ধন দ্রব্যাদি পরিষ্কার করেন, যাতে সমস্ত রকম 'অপরিশুদ্ধতা' দূর হয়। আসলে নিজের ঘরবাড়ি ও আশপাশ পরিষ্কার করে সুস্থতা বজায় রাখার জন্যই নিয়মটি পালন করা হয় বলে মনে করা হয়।
 
মকর সংক্রান্তি, নানান বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যের এক উৎসব:
 
গঙ্গাসাগর মেলা: 
 
মকরের সবচেয়ে বড় উৎসব, গঙ্গাসাগর মেলা। গঙ্গা ও বঙ্গোপসাগরের মিলনস্থান, তীর্থভূমি গঙ্গাসাগর। ছোটবড় ৫১টি দ্বীপ নিয়ে ৫৮০ বর্গ কিমি জুড়ে সাগরদ্বীপ। ভগীরথের গঙ্গাকে মর্ত্যে নিয়ে আসা ও সগর রাজার পুত্রদের জীবনদানের কাহিনীকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে এই তীর্থভূমি। কপিল মুনির আশ্রমটিকে কেন্দ্র করেই এই উৎসব। পবিত্র গঙ্গাসাগরে স্নান সম্পন্ন করেন ভক্তরা। বাংলার অনেক স্থানে এককালে কুমারী মেয়েরা এইদিন থেকে একমাস ব্যাপী মকরস্নান-ব্রত শুরু করত। ছড়া গান গেয়ে পাঁচ ডুব দেওয়ার নিয়ম ছিল:
 
"এক ডুবিতে আই-ঢাই।
দুই ডুবিতে তারা পাই।।
তিন ডুবিতে মকরের স্নান।
চার ডুবিতে সূর্যের স্নান।
পাঁচ ডুবিতে গঙ্গাস্নান।।"
 
 
gangasagarfair1
 
 
মকর সংক্রান্তির পুণ্য তিথিতে গঙ্গাসাগরে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম হয়। প্রয়াগ, হরিদ্বার প্রভৃতি স্থানেও এই উপলক্ষ্যে মেলা বসে। এদিন থেকেই প্রয়াগে কুম্ভ মেলার সূচনা আর শবরীমালায় তীর্থযাত্রার সমাপ্তি। 
 
জঙ্গলমহলের মকরপরব: 
 
জঙ্গলমহলে এদিন মকরপরব পালিত হয়। এটি জঙ্গলমহলের সব চেয়ে বড় ও লোকপ্রিয় উৎসব। মকরসংক্রান্তি উপলক্ষ্যে মেলা বসে, পৌষলক্ষ্মীর পুজো করা হয়। কৃষিজীবি সমাজের এই উৎসব কৃষি লক্ষ্মীর আরাধনা। লক্ষ্মীর প্রতীক হিসেবে ধানসমেত গাছকে পুজো করা হয়। পৌষ সংক্রান্তি দিনে গ্রাম-বাংলার অনেক স্থানে উঠোনে মড়াইয়ের পাশে উঠোন লক্ষ্মীর পুজো হয়।
 
এদিন বাড়ির উঠোন গোবরজল দিয়ে নিকিয়ে, শুচি-স্নিগ্ধ করে তোলা হয়। ধান কাটার পরে পৌষ তোলার চার-পাঁচ গুচ্ছ ধানগাছ সাদরে গৃহস্থ বাড়িতে আনা হয়েছিল, তাই গাদা থেকে নামিয়ে মাথায় বহন করে উঠোনে নামানো হয়। লক্ষ্মীকে স্থাপন করে, চারপাশে আলপনা দেওয়া হয়। লক্ষ্মীর নানান গয়না; চাষের সমস্ত উপকরণ-গরু, লাঙল, জোয়াল, মই; আর লক্ষ্মীর পা--পৌষ গাদা থেকে পুজোস্থল পর্যন্ত, পুজোস্থল থেকে গৃহের সিংহাসন পর্যন্ত লক্ষ্মীর চরণ চিহ্ন আঁকা হয়।
 
বাংলার কোন কোন স্থানে একে বার বাহির লক্ষ্মীপুজোও বলা হয়। সন্ধ্যায় এক বিশেষ আচার পালন করা হয়, একে ''ডাকধরা'' বলা হয়। সন্ধ্যাবেলায় শেয়াল বা ডাক ডাক শুনলেই জলছড়া দিয়ে লক্ষ্মীকে প্রদক্ষিন করে শাঁখ বাজিয়ে ''ডাক'' ধরা হয়। তিন, পাঁচ বা সাতবার ওই ডাক ধরা হয়। দক্ষিণ দামোদর অঞ্চলে শেয়ালকে লক্ষ্মীর বাহন বলে ধরা হয়। পৌষলক্ষ্মীর পুজোয় বিশেষ ভোগ নিবেদন করা হয়। একে স্থানীয়ভাষায় মকর বলা হয়। যার মধ্যে লেবু বাদে ফল থাকে, চালের গুঁড়ো, মুগডালভেজা, ছোলাভেজা, নারকেল কোরা, খেজুরগুড় এক সাথে মেখে ভোগ দেওয়া হয়। রাত পর্যন্ত পুজো চলে।
 
পুজো শেষ হলেই ঠাকুর তোলা যায় না। রাতে লক্ষ্মীপেঁচা বা শেয়ালের ডাক শুনে উঠোন থেকে লক্ষ্মীকে ঘরে তোলা হয়। গভীর রাতে লক্ষ্মী তুলে উঠোন নিকিয়ে ঘুমতো যান গৃহকর্ত্রী। মকরসংক্রান্তির পরের দিন হল খামারবিশ্রাম। লোক কথায় একে খলা বিশ্রাম বলে। এই দিন কৃষিকাজ করা হয় না, কোন চাষযন্ত্রের ব্যবহার করার নিয়ম নেই। এই দিন মাংস খাওয়ার রীতি প্রচলিত।
 
ভোর বেলা থেকেই খড়ের তৈরি বাঁদর নিয়ে মজার মজার গান গেয়ে পিঠে, চাল,পয়সা সংগ্রহ করে বাচ্চারা। সংগৃহীত পিঠে চাল পয়সা দিয়ে বনভোজন করা হয়।
 
কেশপুর থানার নেড়াদেউলে প্রাচীন কামেশ্বর ভৈরব মন্দির রয়েছে, মকরসংক্রান্তি উপলক্ষ্যে এখানে প্রায় ১৫দিনব্যাপী মেলা বসে। গোরুর গাড়ির দৌড় এই মেলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ।
 
টুসু:
 
আদিবাসী জনগোষ্ঠী মানুষেরা এদিন ''টুসুউৎসব'' পালন করে। পয়লা পৌষে টুসুর ঘট প্রতিষ্ঠা করে প্রতিদিন সন্ধ্যেতে নারীপুরুষ নির্বিশেষে লৌকিকরীতিতে পুজো করা হয়, টুসুগান গাওয়া হয়। পৌষ সংক্রান্তির আগের রাতে রাঢ় তথা পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় 'টুসু জাগরণ' হয়। পৌষ সংক্রান্তির ভোরে সূর্যোদয়ের আগে নদীতে বা পুকুরে টুসু বিসর্জন দেওয়া হয়। 
 
তুষ-তুষলীর ব্রতিনীরা এই দিন মাস-কালীন ব্রতের শেষে জমিয়ে রাখা তুষ-গোবরের গুলি মাটির হাঁড়িতে রেখে আগুন ধরায়। তারপর তা ভাসিয়ে দেয় নদী বা পুকুরের জলে।
 
 
tusu
 
 
বাস্তুপুজো:
 
vastupuja
 
 
উত্তরায়ণ সংক্রান্তিতে বাস্তুপুজোর প্রচলন আছে। পাটশলমির আগুনে, নতুন মাটির হাঁড়িতে দুধ-চাল-বাতাসা ফুটিয়ে চরু রান্না হয়। এই চরু বাস্তুপুজোর প্রধান অঙ্গ।
 
আওনি-বাউনি:
 
পৌষ সংক্রান্তি সম্পর্কিত একটি লোকাচার হল এই আওনি-বাউনি বা আউরি-বাউরি। এটি সংক্রান্তির আগের দিন পালিত হয়। তবে তবে দামোদরের দক্ষিণে এর নাম 'চাঁউনি-বাউনি' বা 'চাউড়ি-বাউরি'। ধানগাছকে পুজো করে শস্য-সম্পদের শ্রীবৃদ্ধি কামনা করা হয়। তারই অঙ্গ হিসাবে বাংলার মেয়েরা ছড়া কেটে পৌষ বন্দনা করেন, "পৌষ পৌষ- সোনার পৌষ/এস পৌষ যেয়ো না/জন্ম জন্ম ছেড়োনা।/না যেয়ো ছাড়িয়ে পৌষ-/না যেয়ো ছাড়িয়ে,/পৌষ পৌষ - সোনার পৌষ।"
 
দধি সংক্রান্তির ব্রত:
 
পৌষ সংক্রান্তির দিন দধি সংক্রান্তির ব্রতের সূচনা হয়। প্রতি সংক্রান্তিতে তা পালন করে, পরের বছর ঐ একইদিনে ব্রতের প্রতিষ্ঠা বা সমাপ্তি করা হয়। এই দিন দই দ্বারা বিষ্ণু ও লক্ষ্মীকে স্নান করিয়ে, দধি ও ভোজ্য ব্রাহ্মণকে দান করা হয়। ফল-সংক্রান্তি ব্রতের অনুষঙ্গ হিসেবে, এই সংক্রান্তিতে হরিতকী দান করলে হংসযুক্ত রথে আরোহণ করে বৈকুন্ঠে গমন করা যায়। 
 
এছাড়াও পিঠেপিরুলী ব্রত পালিত হয়। বাংলার কোন কোন স্থানে গৃহস্থের মঙ্গলকামনায় এইদিন 'ধর্মের পিঠে' উত্‍যাপিত হয়। এই লোকাচারটি ধর্ম বা সূর্য পুজোর অঙ্গ। নতুন কলকে নিয়ে গোয়ালে, গবাদিপশুর দেহে, গোলায়, ঢেঁকিশালে এবং ঘরের মধ্যে পিটুলির ৫টি গোলাকার ছাপ দেওয়া হয়। 
 
মেহি পুজো: 
 
এদিন বাংলার কোন কোন প্রান্তিক অঞ্চলে মেহি পুজো করা হয়। মেহি শব্দের অর্থ হল খুঁটি। এদিন বত্‍সরান্তের কৃষিকাজের শেষে খুঁটিকে কেন্দ্র করে উত্‍সবের আয়োজন হয়। 
 
এই খুঁটি গরু বাঁধার স্থান, নানান কৃষিকাজের সাক্ষী, তাই কৃতজ্ঞতাস্বরূপই এই পুজোর আয়োজন করা হয়। খুঁটিকে কেন্দ্র করেই নানান কৃষি উপকরণের আলপনা আঁকা হয়। কৃষকপুরুষ শেয়ালের ডাক শুনে পুজোয় বসেন। পুজো শেষে সেই বছরের মতো কৃষিকার্যের সমাপ্তি হয়।
 
আখ্যান দিন: 
 
পৌষ সংক্রান্তির পরেরদিন রাঢ় অঞ্চলের কোন কোন জায়গায় আক্ষেন বা আখ্যান দিন পালিত হয়। একে এখ্যান যাত্রাও বলা হয়। এদিন লোকদেবতা ও অপদেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হয়। অনেক স্থানে এইদিন গ্রামের বালকেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে যে চাল, ডাল, সবজি মাগন করে আনে। নিজেরাই মাঠে তা রান্না করে কুলাই ঠাকুরকে নিবেদন করে এবং একত্রে ভোজন করে। ঐ মাগনকে কুলাইর মাগন বা কুলের মাগন বা পৌষ মাগন পালন করে।   
 
নানান লৌকিক পুজো:
 
মেদিনীপুরে এইদিন লৌকিকদেবী বড়াম, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, হুগলীতে সিনিদেবী এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণায় বারা ঠাকুরের যুগ্মমূর্তি, নারায়ণী ও দক্ষিণ রায়ের বাত্‍সরিক পুজো অনুষ্ঠিত হয়।
 
মেদিনীপুর, পিংলা, ময়না, সবং অঞ্চলের মাহিষ্য কৃষক সম্প্রদায় এদিন বিকেলে বণিপুজোর আয়োজন করে। এটি একটি লোকাচার। এর তিনটি পর্যায় যথা, মই খুঁটি প্রতিষ্ঠা, খেত মাড়ান এবং সাঁথ ধরা। চাষের জমিতে রক্ষিত একগুচ্ছ ধান গাছের গোড়ায় লবাৎ অর্থাৎ নতুন ধানের চাল বেটে প্রস্তুত মিষ্টান্ন ও ফলমূল নৈবেদ্য রেখে সরষে ও সাদা কলকে ফুল দিয়ে পুজো করা হয়। তারপর তা মইখুঁটির সঙ্গে বাঁধা হয়। আগামী বছর ভাল ফসল লাভের আশায় প্রার্থনা করা হয়। সাঁথ ধরা হল বন্য প্রাণির ডাক শুনে সেই অনুযায়ী পুজোর পরে পুজো করা ধন গাছকে সযত্নে ধানের গোলায় তুলে রাখার অনুষ্ঠান। প্রচলিত মতে, শেয়ালের সাঁথ ধরা সৌভাগ্যের।
 
আমাদের দেশের মকর সংক্রান্তির বিভিন্ন রূপ পরিলক্ষিত হয়। তামিলনাড়ুতে মহাধুমধামে পোঙ্গল উদযাপন করা হয়। সংক্রান্তিতে শুরু হয়ে, পরের মাসের তৃতীয় দিন পর্যন্ত তা চলে। তেলেগু ভাষাভাষী অঞ্চলে তা এক বা দুদিন ধরে চলে। পঞ্জাবে হয় লোহরি। তামিলরা প্রথম দিনে কাঠকুটো জড়ো করে আগুন জ্বালান এবং সেই আগুনে পুরনো কাপড়চোপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্র আহুতি দেন: জীর্ণ পুরাতনকে বিসর্জন দিয়ে নতুনের আবাহন।
 
পরের দিন দুধ আর গুড় মিশিয়ে তার মধ্যে নতুন ভাজা চাল এবং মুগডাল ফোটানো হয়। যতক্ষণ না সেই দুধ উথলে ওঠে, ততক্ষণ ফোটানো চলে। দুধ উথলানোকে শুভ বলে গণ্য করা হয়, তাই সবাই উচ্চকণ্ঠে 'পোঙ্গালো পোঙ্গল' বলে ওঠেন। তামিল বা তেলেগু ভাষায় শব্দটির অর্থ হল 'হাঁড়িতে ভাত সেদ্ধ করা'। এক কথায় পোঙ্গল হল, নতুন চাল, ভাজা মুগ, বাদামি আখের গুড়, ইক্ষু-শক্কর, দুধ ও নারকেল দুধের সঙ্গে কিশমিশ, কাজু, এলাচে প্রস্তুত এক সুস্বাদু মিষ্টান্ন।
 
এই সময় পঞ্জাব থেকে তামিলনাড়ু পর্যন্ত সব জায়গায় গুড় এবং তিলের মিষ্টি তিল-গুড় বা তিল-লাড্ডু থাকে। কারণ আখ এবং তিলের ফসল এই সময় উৎপন্ন হয়। কিন্তু কেরল বাংলায় এই দুই ফসলের কোনওটিই তেমন হয় না, নারকেলের মিষ্টির রমরমা চলে।
 
অসমেও এই সময় নতুন ধান ওঠে, তাই উপবাস, ভোজের মধ্যে দিয়ে জমে ওঠে ভোগালি বিহু। পঞ্জাব থেকে বিহার পর্যন্ত গোটা উত্তর ভারতে তিল, গুড় এবং দুধের মিষ্টান্নের পাশাপাশি অত্যন্ত জনপ্রিয় হল চাল, ডাল এবং মরসুমি সবজি দিয়ে তৈরি খিচুড়ি। আবার পঞ্জাবমহারাষ্ট্রে আছে সুজির হালুয়া, আর তামিলনাড়ুর মতো কিছু রাজ্যে দুধ আর চালের পায়েস এবং মিষ্টি।
 
অন্ধ্রপ্রদেশ-তেলেঙ্গানায় গবাদিপশুকে এদিন নানান সামগ্রী ভোজন করানো হয়। গুজরাটে তাদের গায়ে আঁকা হয়। গুজরাত বা কর্নাটকে এই সময় ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব হয়। ওডিশার ভুঁইয়া জনজাতির মানুষ এবং বাংলার পশ্চিম প্রান্তের মানুষ টুসু উৎসব পালন করেন।
 
মণিপুরে অনেকে তাঁদের পরম ঈশ্বর লিনিং-থোউয়ের কাছে প্রার্থনা করেন, এমনকী সুদূর অরুণাচল প্রদেশে চিন সীমান্তের কাছে ব্রহ্মকুণ্ডে রামায়ণ, মহাভারত ও কালিকাপুরাণের সূত্র ধরে দেবতার আরাধনা করা হয়, এই দিনটিতে সেখানে হাজার হাজার মানুষ আসেন। উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ি এলাকায় লোকনৃত্যের আসর বসে। শবরিমালার প্রসিদ্ধ হিন্দু মন্দিরে এক সময়ের বিরাজিত বৌদ্ধ দেব শাস্তা, এই দিন পূজিত হন।
 
পশ্চিম ভারতে এটি 'মকর সংক্রান্তি', দক্ষিণের রাজ্যে 'পোঙ্গাল', উত্তর ভারতে 'লোহরি', অসমে 'ভোগালি বিহু', কর্ণাটকে 'ইল্লুবিল্লা' এবং 'মকর সংক্রমণা', উত্তর প্রদেশে 'খিচড়ি', গুজরাটে 'উত্তরায়ণ', হরিয়াণা, হিমাচল প্রদেশে 'মাঘী', মহারাষ্ট্রে 'তিলগুল', বিহার-ঝাড়খন্ডে 'সকরাত', কাশ্মীরে শায়েন-ক্রাত, এমন কি দেশের বাইরে নেপালে, এই সময়ে মাঘে সংক্রান্তি পালিত হয়, তাইল্যান্ডে সোংক্রান, কাম্বোডিয়ায় মোহা সোংক্রান, মায়ানমারে থিংইয়ান, লাওস-এ এর নাম হল পি মা লো। কথায় বলো অন্নচিন্তা চমত্‍কারা। চাষের শেষে কৃষকের গোলায় যখন পরিপূর্ণতা লাভ করে, তখনই ফসলোত্তর এই সংক্রান্তি সেই শান্তির বার্তাই নিয়ে আসে। শান্তি ও সমৃদ্ধির এই উৎসব বৈচিত্রের ভারতকে এক এবং অদ্বিতীয় করেছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...