পৌষ-সংক্রান্তিতেও বাঁকুড়ার কুয়াশামাখা জবুথবু শীতের সকালে সূর্যদেব যখন আড়মোড়া ভেঙে ‘এই উঠছি’, ‘সেই উঠছি’ করে তিরিশবার ভাবতে বসেন, তখন এ-দিন কাকভোরেই গরম বিছানার বায়না ভুলে চিড়িক মেরে উঠে পড়েন ছেলে-বুড়ো সক্কলে। না-উঠে উপায় কী, সংক্রান্তির আগের দিনটিকে বলে 'বাউড়ি', সেই বাউড়ির সন্ধ্যে-রাতেই গুচ্ছের পিঠেপুলির বাহার ঘটেছে বাড়িতে, ভোরে তারই জিভে-জল-আনা খোশবাই চাদ্দিকে কান্নিক মারছে যে!
তবে উঠলেও উপায় নেই। কোন এক আলপ্পেয়ে নিয়মে কম-সে-কম কুব কুব করে তিন ডুব না-দিলে নাকি পৌষ-পার্বণের পিঠেই খাওয়া যায় না! তাই গাঁয়ের স্যাঙাৎ পুকুর বা নদীর বরফহিম জলে অবগাহনের উদ্দেশ্যে ‘যত ডুব, তত পিঠে' ঘুষতে ঘুষতে পাড়ে হাজির হতেই হয় বিছানা ছেড়ে।
তা পাড়ে হাজির হয়েই কী আর শান্তি থাকে! কনকনে বাতাস হু হু করে বইতে শুরু করে। তায় আদুল গায় দুল দুল করে কাঁপন ধরে। বরফ জলে নামতে গিয়ে এক পা এগিয়ে তিন পা পেছনোর পালা চলে। দাঁতে দাঁতে বিষম খটাখটি পালা শুরু হয়। তবে তার মধ্যেই এক সময় দাঁতমুখ চিবিয়ে মরিয়া হতেই হয়। তখন শব্দ ওঠে, ঝপাং। তারপর, কুব কুব কুব। ব্যস। শীতে শীতে শীতক্ষয়। জল থেকে ওঠার পর তেমন আর ঠাণ্ডা লাগে না। তবে হাত-পা খানিক অবশ লাগে। মনে হয় যেন গায়ে কেউ একপ্রস্থ বরফের আস্তর চাপিয়ে দিয়েছে!
সেই অবশভাব কাটানোরও অস্ত্র আছে গাঁয়ে। তার জন্য ছেলেপুলেরা ক'দিন আগে থেকেই তাল-খেঁজুরের পাতা কেটে বেশ করে শুকিয়ে রাখে, আলগা বিচুলি জোগাড় করে রাখে। বাউড়ির বিকেলে ঘাট ঘেঁষে তাল-খেঁজুরের পাতা গোল চিমনি বা চারকোনা ঘরের মতো করে সাজিয়ে মধ্যিখানে বিচুলি দিয়ে ভরাট করে দেয়, একে বলে 'কুমা'। ডুবটি দিয়েই জ্বালিয়ে দেওয়া হয় এই কুমা। অমনি দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন। চলে সেই আগুনে বরফজমা হাত-পা সেঁকার পালা। গা গরম করে সেখানেই পরে নেওয়া হয় নতুন কাপড়, গরম পোশাক। এভাবেই সমবেত স্নানে হৈ-হল্লার তুমুল আনন্দে জমজমাট হয়ে ওঠে ঘাট। পরব লেগে যায়, জেগে ওঠে প্রাণ। সেই প্রাণ পিঠের জন্য আনচান করে ওঠে। পা নামে বাড়ি ফেরার পথে।
পথে দেখা হয়ে যায় হরিভক্তদের একটি দলের সঙ্গে। খোল-করতাল-হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে চাদরমুড়ি দিয়ে প্রভাতফেরিতে বেরিয়েছেন তাঁরা। ফি-বছর এমনি করেই বেরোন। ষোল নাম বত্রিশ অক্ষরে সুর তুলে গাঁয়ের পথ ভরিয়ে তোলেন বন্দনা গানে। তাঁদের সঙ্গে ভিড়ে যাওয়ার আনন্দই আলাদা।
হরিভক্তদের গমনপথে দাঁড়িয়ে থাকেন গেরস্তবাড়ির কর্তারা। ভক্তদের আবাহন করে বাড়িতে নিয়ে আসেন। ভক্তেরা উঠোনে খানিক নামগান করার পর গেরস্ত তাঁদের বসতে দেন। তারপর শালপাতার দোনা ভরে 'মকর চাল' খেতে দিয়ে আপ্যায়ন করেন। এটাই নিয়ম।
'মকর চাল' তৈরি হয় খাঁটি গরুর দুধ দিয়ে। তার সঙ্গে চালের গুঁড়ো, চিনি বা আখের গুড় জ্বাল দিয়ে ফুটিয়ে ক্ষীরের মতো ঘন করে তা উনুন থেকে নামানো হয়। এই অবস্থায়, আগে থেকে গরম জলে ভিজিয়ে রাখা আতপ চাল আর কুচনো নানান ফল এই ক্ষীরের সঙ্গে মিশিয়ে তৈরি হয়, ‘মকর চাল'। কনকনে শীতের সকালে গরম গরম মকর চালে শরীর ওম তো হয়ই, সেই সঙ্গে বুক ভরা সুস্বাদ পেয়ে রসনা বলে ওঠে-'আহা!'
পৌষ-পার্বণের এই মকর চাল একদা একে-অপরকে খাইয়ে বেশ ঘটা করে ছেলেতে-ছেলেতে আর মেয়েতে-মেয়েতে এ-দিন বন্ধুত্ব পাতানো হত; সেই বন্ধুত্বের নাম দেওয়া হত, ‘মকর’। 'মকর'-পাতানো বন্ধুরা একে-অপরকে চিরকাল 'মকর' বলেই ডাকত। এখন অবশ্য এমন বন্ধু-পাতানোর রীতিটি হারিয়ে গেছে। তবে উনিশ শতকের কবি ঈশ্বর গুপ্ত তাঁর ‘পৌষ-পার্বণ’ কবিতায় এই বন্ধু-নামটিকে অমর করে রেখেছেন:
"মকর-সংক্রান্তি-স্নানে জন্মে মহাফল।
মকর মিতিন সই চল চল চল।।"
যাই হোক, মকর চাল খাওয়ার পরই শুরু হয়ে যায় পার্বণের পিঠে খাওয়ার হররা। সেই হররায় একে একে পাতে এসে পড়ে 'আস্কে', 'আরসা', 'গড়গড়ে', 'কাখরা' প্রভৃতি হরেক ও অদ্ভুতনামের সব লালা ঝরানো লা-জবাব পিঠে। আগে এসব পিঠের গায়ে ছিল এ-অঞ্চলের উৎকল সমাজের সিলমোহর, এখন অবশ্য এরা সর্বজনীন।
উৎকল কারা? বলছি। মূলত পাঁচ ছ'শো বছর আগে উৎকল প্রদেশ অর্থাৎ উড়িষ্যা থেকে যে-সব ব্রাহ্মণ বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও মেদিনীপুরে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন, তাদের বলা হয়, 'উৎকল ব্রাহ্মণ'। এঁরা উৎকল প্রদেশ থেকে রান্নাবান্না ও পিঠেপানার ঐতিহ্য নিয়ে এলেও তাতে ক্রমশ কিছু নিজস্বতা যুক্ত করেছেন। পৌষ-পার্বণের পিঠেমালাতেও তার ছাপ আছে।
পৌষ-পার্বণের পিঠের মধ্যে সবচেয়ে নামবৈচিত্র আছে 'আস্কে' পিঠের। সে কারও কাছে ‘চিতো পিঠে’, তো কারও কাছে বা ‘খোলা পিঠে’। আসলে, মাটির স্পেশ্যাল খোলা ছাড়া এ পিঠে বানানো যায় না বলেই এর ‘খোলা পিঠে’ নাম। এই পিঠে শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ নয়, সমগ্র বাংলাতেই সে পরিচিত।
আস্কে পিঠে বানাতে গেলে প্রথমেই চালের গুঁড়ো পরিমাণমতো নুন আর জল দিয়ে ঝোলা গুড়ের মতন তরল অথচ গাঢ় করে গুলতে হয়। তারপর মাটির খোলায় আধবাটির মতো সেই গোলা দিয়ে শঙ্কু-আকৃতির ঢাকনা (এটা খোলার সঙ্গেই কিনতে পাওয়া যায়) দিয়ে সেটা ঢাকা দিয়ে দিতে হয়। ঢাকনার চারপাশে জলে চোবানো একফালি ন্যাকড়া বেড়ির মতো করে বসিয়ে দিয়ে দিতে হয়। তার মিনিট খানেক পরে ঢাকনা খুললেই পিঠে তৈরি। ঠাণ্ডা হোক বা গরম এ পিঠে ঝোলা গুড় বা মিষ্টি দুধে চুবিয়ে খেতে হেব্বি লাগে।
পৌষ-পার্বণের অন্যতম পিঠে 'আরসে' বা 'আরসা'। আ-রসা বা কোনরকম রস থাকে না বলেই এর এমন নাম। এছাড়াও এর আর একটি নাম আছে, সেটি হল, ‘গুড় পিঠে’। চাল গুঁড়ো ও গুড় মিশ্রিত মণ্ড থেকেই এ-পিঠে তৈরি হয় বলেই এর এমন নাম। এটি একরকমের ভাজা পিঠে। চাল গুঁড়ো ও গুড় শক্ত করে মেখে ছোট ছোট গোলা বানিয়ে চপের আলুর মতো চেপটে তেল বা ঘিয়ে ভেজে নিলেই নরম, তুলতুলে, ফোঁপরা গুড় পিঠে তৈরি হয়ে যায়। ক'দিন রেখে খেলেও এ-পিঠে সহজে নষ্ট হয় না। অনন্য স্বাদের এই পিঠের রেসিপি শুনতে ভীষণ সহজ, কিন্তু অভিজ্ঞ হাত না-হলে ঠিকমতো তৈরি হয় না।
পৌষ-পার্বণের সবিশেষ পিঠে হল, 'গড়গড়ে'। পিঠেটি দেখতে ছোট, আকারে চ্যাপ্টা-গোল। এ-অঞ্চলের মানুষ একে ডাকেন 'গড়গড়িয়্যা' বলে। এই ডাকের মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে আছে এর নামকরণের ইতিহাসও। কারণ, এই অঞ্চলের মানুষ কোনকিছু 'গড়িয়ে যাওয়া'-কে বলেন 'গড়গড়াই গেল'। গড়গড়ের গোলপানা গড়ন হওয়ায় কড়াই থেকে নামাতে নামাতে, পাতে দিতে দিতে বড্ড গড়িয়ে যায়। তার এই স্বভাবের জন্যই হয়তো এমনধারা নাম।
গড়গড়ে আসলে পুরওয়ালা পুলিপিঠে গোত্রের একটি পিঠে। এতে তেলের কোন ছোঁয়াচ নেই। এই পিঠে সম্পূর্ণরূপে জলে সেদ্ধ করেই তৈরি হয়। তাই এই পিঠে একদিকে যেমন দারুণ সুস্বাদু, অন্যদিকে তেমনি সহজেই হজম হয়।
গড়গড়ে পিঠে বানাতে লাগে চালের গুঁড়ো, সামান্য নুন, খোয়া ক্ষীর আর জল। পিঠে বানানোর জন্য প্রথমেই চালের গুঁড়োর মণ্ড বানাতে হয়। এর জন্য কড়াইতে পরিমাণমতো জলে এক চিমটে নুন দিয়ে জলটা আগে ফোটাতে হয়। জল ফুটতে শুরু করলে এক হাতে তায় চালের গুঁড়ো ঢালতে হয়।
অন্য হাতে রুটি বেলার বেলুনি দিয়ে সমানে নেড়ে নেড়ে জলের সঙ্গে সেই চালের গুঁড়োগুলো দ্রুত মিশিয়ে যেতে হয়। লক্ষ্য রাখতে হয়, চালের গুঁড়ো যেন জলের সঙ্গে খুব ভালো ভাবে মেশে, কিছুতেই যেন ডেলা ডেলা না-হয়ে যায়। নাড়তে নাড়তে চালের গুঁড়ো যখন সেদ্ধ হয়ে যায়, জল শুকিয়ে লেই হয়ে বেলুনির গায়ে লেগে যেতে চায়, একতাল কাদার মতো নরম মোলায়েম হয়ে ওঠে, তখনই বোঝা যায় যে, পিঠের জন্য মণ্ড এক্কেবারে প্রস্তুত।
চালের গুঁড়োর এই যে মণ্ড, একে বাঁকুড়ার ভাষায় 'খইল' বলা হয়। মণ্ড নাড়ার জন্য সচরাচর বেলুনি ব্যবহার করা হয় না। ছুতোরের বানানো শাল কাঠের সুদৃশ্য একহাত লম্বা একটি লাঠি ব্যবহৃত হয়, একে বলা হয়, 'খইল খাড়ি'। 'খাড়ি' মানে, 'কাঠি'। এই 'খাড়ি'র অভাব ঘটলে তবেই বেলুনি ব্যবহার করা হয়।
যাই হোক, মণ্ডটা গরম থাকতে থাকতেই পিঠে বানাতে হয়। কারণ, ঠাণ্ডা হয়ে গেলে মণ্ডটা খুব শক্ত হয়ে যায়, তখন তা দিয়ে ভালোভাবে পিঠে বানানো যায় না।
গরম মণ্ড এক চিমটে হাতে নিয়ে প্রথমে ছোট একটা গোলা পাকাতে হয়। তারপর হাতে ঘোরাতে ঘোরাতেই আঙুল ডুবিয়ে সেটাকেই একটা খোল বানিয়ে ফেলতে হয়। এবার খোলের মধ্যে খোয়ার পুর রেখে তালুর মধ্যে সেটা ঘোরাতে ঘোরাতেই মুখ বন্ধ করে দিতে হয়। তারপর আলতো করে চেপে চেপ্টে দিলেই হয়ে যায় সুদৃশ্য গড়গড়ে। হাতে মণ্ডের গরম সইয়ে নিতে ছোট্ট বাটিতে ঠাণ্ডা জল রাখতে হয়। পিঠে বানানোর সময় এক একবার তাতে হাত চুবিয়ে নিতে হয়। গরম সওয়া ছাড়াও এতে আর একটা লাভ হয়। আসলে, হাত ভিজে থাকলে মণ্ড হাতে সেঁটে যায় না এবং পিঠের সুদৃশ্য আকারটিও সহজে বজায় রাখা যায়।
কয়েকটি পিঠে তৈরি হয়ে গেলেই আর-একটা কড়াইতে জলে এক চিমটে নুন দিয়ে প্রথমে জলটা গরম করে নিতে হয়। জলটা বেশ গরম হয়ে ফুটে উঠলেই পিঠেগুলো তাতে ছেড়ে দিতে হয়। পিঠে সেদ্ধ হলেই জলে ভেসে ওঠে। তখন ঝাঁঝরি দিয়ে জল ঝরিয়ে তুলে নিলেই হয়। তারপর থাকে শুধু খাওয়ার অপেক্ষা। গরম হোক বা ঠাণ্ডা, মুখে নিলেই মেলে খালি অমৃতের স্বাদ।
তবে গড়গড়ে পিঠেতে শুধু যে খোয়াক্ষীরের পুর ব্যবহৃত হয়, এমন নয়। দুধ, নারকেল কোরা, চিনি বা গুড় দিয়ে নারকেলের পুর বানিয়েও ব্যবহার করা যায়। মিষ্টির মাঝে স্বাদবদলের জন্য অনেকেই পছন্দ করেন ঝাল-নোনতা পুর। সেক্ষেত্রে জাই মুগ বা বরবটি সেদ্ধ করে মসলা দিয়ে ভেজে সুস্বাদু পুর বানিয়ে নেওয়া যায়। তিলের পুরও অনেকেই পছন্দ করেন। তাছাড়া চালের গুঁড়ো, দুধ ও চিনি ফুটিয়েও এক রকমের পুর বানানো যায়, একে বলা হয় 'এটকালি পুর'। এছাড়াও চিনির সঙ্গে ছানা ফুটিয়ে বানানো যায়, ছানার পুর। তবে ক্ষীরের তুলনায় এগুলো তেমন সুস্বাদু নয়।
বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুরে উৎকল সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে পুড়হা পরব, পৌষ-পার্বণ ও শ্রীপঞ্চমীর পরদিন ষষ্ঠী প্রভৃতি পার্বণে গড়গড়ে একটি অত্যন্ত আবশ্যিক পিঠে। তাছাড়া মৃতের বাৎসরিক অনুষ্ঠানেও নিমন্ত্রিতদের পংক্তিভোজনে গড়গড়ে পিঠে খাওয়াতেই হয়, এ অঞ্চলের এটাই নিয়ম।
পৌষ-পার্বণের পিঠের মধ্যে 'কাখরা পিঠে'র বেশ নামডাক। বাড়িতে জামাইকুটুম এলে কাখরা না-বানালে এখনও মান থাকে না। এ-পিঠে কিন্তু পুরোপুরি ভাজা পিঠে। কাখরা বানাতে গেলে গড়গড়ের মতোই চালের গুঁড়ো চিনি বা গুড় মেশানো জলে ফুটিয়ে প্রথমে মণ্ড তৈরি করে নিতে হয়। তারপর মণ্ডটি হালকা গরম থাকতে থাকতেই লেচি কেটে ছোট ছোট লুচি বানিয়ে ফেলতে হয়।
একখানা লুচির ওপর খোয়াক্ষীর বিছিয়ে ওপরে আর-একখানা লুচি বিছিয়ে চারপাশ চেপে চেপে মুড়ে তেলে বা ঘিয়ে ভেজে নিলেই তৈরি হয়ে যায় কাখরা পিঠে। কামড় দিলেই ভেতরের টসটসে ক্ষীরের স্বাদ জিভ বেয়ে একেবারে আকুল করে দেয় মনপ্রাণ। চারপাশ ভরে ওঠে তার ম ম গন্ধে। এ-পিঠে এমন অপূর্ব তৃপ্তি দেয় যে, তা খেয়ে এককালের বুড়োদের জমিজিরেত লিখে দেওয়ার গপ্পোও বেশ শোনা যায়।
যাই হোক, পৌষ-পার্বণে পিঠে খাওয়ার পর আর একটাই কাজ পড়ে থাকে। সেটা হল, সারাদিন টইটই করার পালা। আর তার জন্য রয়েছে এন্তার মেলা।
সিনি দেবী অর্থাৎ গাছতলার হাতিঘোড়া ঠাকুরের থানে থানে বাঁকুড়া জুড়ে এ-দিন বাৎসরিক পুজোর ধুম পড়ে যায়। কমলাসিনি, বাঁশতলাসিনি, পায়রাসিনি প্রভৃতি তাঁদের নাম। তাঁদের এই পুজোকে কেন্দ্র করেই বসে যায় মেলা। তায় মেয়েপুরুষ ছেলেমেয়ের ভিড় উপচে পড়ে। চলে অস্থায়ী দোকানদানিতে বিকিকিনির হররা। মেলাপ্রাঙ্গণের আটচালায় চলে অষ্টপ্রহর বা চব্বিশ প্রহর হরিনাম সংকীর্তন।
মেলার জন্য নদীর বিশিষ্ট ঘাটগুলিও শূন্য থাকে না। ঘাটে ঘাটে এ-দিন থেকেই কয়েকদিনের জন্য শুরু হয়ে যায় 'গঙ্গামেলা'। পার্বণের দিনে স্বর্গ থেকে মর্তে ভগীরথের গঙ্গা আনয়নের কাহিনি স্মরণ করে নদীর জল ছুঁয়ে তা মাটির মূর্তির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। তাতে সম্মুখে শঙ্খ হাতে থাকেন ভগীরথ, পেছনে মকরবাহনা মা গঙ্গা। গঙ্গা অবতরণের কাহিনি ছাড়াও এখানে অনেক পৌরাণিক ও লৌকিক কাহিনি মাটির মূর্তির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। যেমন, হিরণ্যকশিপু বধ, বাল্মীকির তপস্যা, লখিন্দর-বেহুলা প্রভৃতি।
গঙ্গামেলার প্রাঙ্গণেও আটচালায় চলে প্রহরমাপা সংকীর্তন। তাকে ঘিরেই বসে তেলেভাজা, পাঁপড়, ঘুগনি, ফুচকা, চাউমিন-রোল, চুড়িমালা-মনোহারি, খেলনার সারি সারি দোকান। থাকে নাগরদোলার হররা। তার মধ্যেই ঘুরে ঘুরে অন্তহীন আনন্দে কেটে যায় দিন। দিন চলে যায়, পার্বণ শেষ হয়, আনন্দ স্মৃতি হয়, তবু রয়ে যায় তার রেশ আবহমান...