দু’জনেই কিংবদন্তি। একজন হকির, অপরজন ক্রিকেটের।
দুই কিংবদন্তির একজন হলেন হকির জাদুকর ধ্যানচাঁদ, অপরজন ক্রিকেটের ‘ডন’ স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান। হকির জাদুকর ও ডনের সাক্ষাতের ঘটনা আজ থেকে ৮৬ বছরে আগের ব্র্যাডম্যানের হোমটাউন অ্যাডিলেডে।
অ্যাডিলেড ওভালে দু’জনেই উপস্থিত ছিলেন। ডনের দেশে ধ্যানচাঁদ মাঠে খেলছেন হকি। ব্র্যাডম্যান তখন দর্শকের আসনে। ধ্যানচাঁদ এলেন, খেললেন, জয় করলেন। স্টিকের ম্যাজিকে জয় করে নিয়েছিলেন কিংবদন্তি ব্যাটসম্যানের হৃদয়। ব্র্যাডম্যান নাকি বলে উঠেছিলেন, ‘ইট ইজ ফ্যাসিনেটিং টু ওয়াচ হিম উইথ আ হকি স্টিক’। এই কথা শোনা কথা। লোকমুখে ছড়িয়ে যাওয়া। কিন্তু আসল ঘটনাটি কী ছিল? মোহিত ব্র্যাডম্যান ঠিক কী বলেছিলেন ধ্যানচাঁদের খেলা দেখার পর?
১৯৩৫ সালে প্রথম অস্ট্রেলিয়ায় খেলতে যায় ভারতীয় হকি দল। ২ মে ভারতের প্রথম ম্যাচ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে। অ্যাডিলেডে ভারত জেতে ১০-১ গোলে। ওই ম্যাচের আগে সফরকারী ভারতীয় হকি দলের ম্যানেজার পঙ্কজ গুপ্ত অ্যাডিলেডের মেয়রকে অনুরোধ করেন যদি ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে ভারতীয় দলে দেখা করানো সম্ভব হয়। সেই অনুরোধ রেখেছিলেন মেয়র।
ব্র্যাডম্যান অ্যাডিলেডে টাউন হলে এসে ভারতীয় হকি দল ও ধ্যানচাঁদের সঙ্গে দেখা করেন। ধ্যানচাঁদের সঙ্গে ছবিও তোলেন। এরপরে সন্ধ্যায় অ্যাডিলেড ক্রিকেট মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ভারতীয় দলের ওই ম্যাচ দেখেন। সেটাই ছিল ডনের প্রথম হকি ম্যাচ দর্শন। খেলা শেষে ডন ব্র্যাডম্যান ধ্যানচাঁদকে বলেছিলেন, 'আমি খেলা দেখে মুগ্ধ'। একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘ক্রিকেটে যেভাবে আমরা রান নিয়ে থাকি, তুমি সেভাবে গোল করো'।
এমন ভাবেই বহু দেশে খেলতে গিয়েছেন হকির জাদুকর। খেলায় মন জয় করেছেন মানুষের। কখনও বা বিদেশে ব্যাপক উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচ খেলেও তাঁর মনে লেগে থাকা ভারতের ক্লাব স্তরের হকি ম্যাচের কথা তিনি জানিয়েছেন ঘনিষ্ঠমহলে। যেমন ১৯৩৬-এর বার্লিন অলিম্পিক হকিতে ভারত প্রথম ম্যাচ জেতার পর জার্মানির বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় হেডলাইন হয়েছিল, ‘অলিম্পিক কমপ্লেক্স ম্যাজিক শো শুরু করেছে’। এমনকী, বার্লিন শহর পোস্টারে ঢেকে গিয়েছিল- ‘ভারতীয় ম্যাজিশিয়ান ধ্যানচাঁদের খেলা দেখতে হকি স্টেডিয়ামে আসুন’।
আবার ১৯২৮ আমস্টারডাম অলিম্পিকে ধ্যানচাঁদ সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন। ১৪টি গোল করেছিলেন। ভারতের এত বড় সাফল্য নিয়ে এক সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়, ‘এটি হকি ছিল না, ছিল জাদু৷ আর জাদুকর ছিলেন ধ্যানচাঁদ।' মনে করা হয়, তখন থেকেই ধ্যানচাঁদ ‘হকির জাদুকর’ নামে পরিচিত হয়েছিলেন।
পূর্ব আফ্রিকায় খেলতে গিয়ে তাঁর জীবনের সেরা ম্যাচের স্মৃতিচারণা করে ধ্যানচাঁদ বলেছিলেন, “কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনার জীবনে সেরা ম্যাচ কোনটি? নির্দ্বিধায় বলব, ১৯৩৩-র বেইটন কাপ ফাইনালে ক্যালকাটা কাস্টমস বনাম ঝাঁসি হিরোস ম্যাচ।"
কিংবদন্তি হকি খেলোয়াড় মেজর ধ্যানচাঁদের জন্মদিন ২৯ অগাস্ট। ১৯০৫ সালের এই দিনে এলাহাবাদে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর বাবা সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। সেই সূত্রে ছেলেবলাতেই ঝাঁসিতে চলে আসেন ধ্যানচাঁদের পরিবার। তাঁর বাবাও সেনাদলে নিয়মিত হকি খেলতেন। তিনি ছেলেবেলায় চাননি যে তিনি বড় হয়ে হকি খেলোয়াড় হবেন। বরং, খেলাধুলোর মধ্যে তিনি পছন্দ করতেন কুস্তিকেই। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই ধ্যানচাঁদ নিজেও সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। আর তাঁর হকি খেলা মোটামুটিভাবে শুরু সেখান থেকেই।
তাঁর জন্মদিনটিকে জাতীয় ক্রীড়া দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এই দিন দেশের রাষ্ট্রপতি যোগ্য প্রার্থীদের অর্জুন পুরস্কার ও ক্রীড়া জগতে দেশের সর্বোচ্চ পুরুস্কার প্রদান করা হয়।
সম্প্রতি তাঁর সম্মানে খেলরত্ন পুরস্কার ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। রাজীব গান্ধী খেলরত্ন পুরস্কারই এখন 'মেজর ধ্যানচাঁদ খেলরত্ন পুরস্কার'। টোকিও অলিম্পিকে ভারতীয় হকি দলের দুরন্ত পারফরম্যান্সের পর এই ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি টুইটে লেখেন, "মেজর ধ্যানচাঁদের নামে খেলরত্ন পুরস্কারের নাম রাখার জন্য আমি সারা ভারতবর্ষের নাগরিকদের কাছ থেকে অনেক অনুরোধ পেয়েছি। তাদের মতামতের জন্য আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই। তাদের অনুভূতিকে সম্মান দিয়ে খেলরত্ন পুরস্কারকে মেজর ধ্যানচাঁদ খেলরত্ন পুরস্কার বলা হবে!"