সালটা ১৯৩১। সবে পথ চলতে শুরু করেছে কলকাতা বেতার কেন্দ্র। অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন সেখানকার তরুণ ব্রিগেড। নেতৃত্বে স্টেশন ডিরেক্টর নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ মজুমদার। চলছে নানা পরীক্ষা। তার মধ্যেই "বেতার জগৎ পত্রিকা"র সম্পাদক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী হঠাৎই বুদ্ধি দিলেন শ্রী শ্রী চণ্ডীর কাহিনি নিয়ে এক্টি গান এবং শ্লোক সংকলন রচনা করার। ভাবনা। সে আইডিয়া বেশ মনে ধরল স্টেশন ডিরেক্টর নৃপেনবাবুর।
তার আগেই এই ভাবেই সরস্বতী শীর্ষক একটি সংগীত বিচিত্রা রচনা করেছিলেন বাণীকুমার। ‘বসন্তেশ্বরী’ নামের সেই প্রযোজনা বেশ সফল হয়।
তার ওপর ভিত্তি করেই বাণীকুমার রচনা করলেন শারদ বন্দনার একটি গীতি আলেখ্য। ১৯৩২ সালের দেবী পক্ষের মহাষষ্ঠীতে সেটি প্রচারিত হয়। তখন সেই অনুষ্ঠানের নাম ছিল "মহিষাসুর বধ" । তারপর নাম হয় "মহিষাসুরমর্দিনী"। সেটা ১৯৩৭।
সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন বেতারের জনপ্রিয় গানের ক্লাসের মাস্টারমশাই। নাম পঙ্কজ কুমার মল্লিক। তখনই তিনি এক নাম। বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছেন। সুর দিয়ে ফেলেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের গানে। প্রশংসা করেছিলেন গুরুদেব। শারদপ্রাতের আলেখ্যতে প্রাণ প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন তিনি।
১৯০৫ সালে কলকাতায় পঙ্কজ কুমার মল্লিকের জন্ম। তার পিতার নাম মণিমোহন মল্লিক ও মায়ের নাম মনোমোহিনী দেবী। মণিমোহনের সঙ্গীতের প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল। পঙ্কজ কুমার দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নেন।
১৯২৭ সাল থেকে তিনি কলকাতার ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনে কাজ শুরু করেন। এই সংস্থা পরে অল ইন্ডিয়া রেডিও (এআইআর বা আকাশবাণী) নামে পরিচিত হয়।
২৪ বছর বয়সে রেডিয়োতে শুরু করেন সঙ্গীত শিক্ষার আসর। তখনকার স্টেশন ডিরেক্টর নৃপেন মজুমদারের আগ্রহে। সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান। প্রতি রবিবার সকালে রেডিয়োতে চলত গানের ক্লাস। শুধুমাত্র কলকাতা বেতারকে জনপ্রিয় করে তোলা নয়, সঙ্গীতচর্চাকে মধ্যবিত্ত বাঙালির মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়া ছিল অনুষ্ঠানের অন্যতম উদ্দেশ্য। বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে। তখন বাড়ির বাইরে গান শিখতে যাওয়া এত সহজ ছিল না।
অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল এই "সঙ্গীত শিক্ষার আসর"। টানা ৪৭ বছর ধরে তিনি রেডিয়োতে গানের ক্লাস নিয়েছেন বাঙালির জন্য।
গান গাইলেন সুপ্রীতি ঘোষ, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, শিপ্রা বসু, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণা দাশগুপ্ত, বিমলভূষণ, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, তরুণ মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, আরও আটটি গান ছিল। সমবেত কণ্ঠে শ্যামল মিত্র, অরুণকৃষ্ণ ঘোষ, ধীরেন বসু, রবীন বন্দোপাধ্যায়, ইলা বসু, আরতি মুখোপাধ্যায়, পঙ্কজ মল্লিক প্রমুখ।
পঙ্কজ মল্লিককে সহায়তা করতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সঙ্গতে সহায়তা করতেন মৃত্যুঞ্জয় বন্দোপাধ্যায়।
শারদ উৎসবের এই প্রভাতী অনুষ্ঠান প্রাণ ছিল পঙ্কজ মল্লিকের। সন্তান স্নেহে গড়ে তুলেছিলেন প্রযোজনাটিকে। অনেক ঝড় সামলেছেন অনুষ্ঠানের জন্য। আনকোরা শিল্পীদের তালিম দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন অনুষ্ঠানের জন্য। কিন্তু কর্তাদের খেয়ালে রাতারাতি বাতিল করা হল সেই অনুষ্ঠান। শোক পেয়েছিলেন।
বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল সঙ্গীত শিক্ষার আসরও। বাড়িতে চিঠি পাঠিয়ে। সেবারও রাতারাতিই। তাঁর নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছনে দিনটির কথা, মীরাবাঈ ভজন শেখাতে আরম্ভ করেছিলাম। এমন সময় অকস্মাৎ এক দিন আমার বাসভবনের ঠিকানায় এল এক চিঠি, পত্রলেখক কলকাতা বেতার কেন্দ্রের তদানীন্তন স্টেশন ডিরেক্টর। … অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হল। এক বোবা যন্ত্রণা আমাকে নির্বাক করে দিয়েছিল।… যে মীরাবাঈ ভজনটি শেখাতে আরম্ভ করেছিলাম সেটিকে, বলা বাহুল্য, শেষ হতে দেওয়া হল না।’’
গণ প্রতিবাদের উত্তাপে ফিরে এসেছিল "মহিষাসুরমর্দিনী", কিন্তু ফেরেনি রবিবারের গানের ক্লাস।