"অন্তরে যা লুকিয়ে রাজে অরুণবীণায় সেই সুর বাজে
এই আনন্দযজ্ঞে সবার মধুর আমন্ত্রণ"
ভুবন মাতানোর এমন ডাক শুনে প্রতিবছর আকুল হয় বাঙালি। স্মৃতির টানে ঘরমুখী হয় মন। মনে পড়ে হারিয়ে যাওয়া বাড়ির বসার ঘরের কোণ। বড় ট্রানজিস্টার সেটটার সামনে কে যেন ধূপ-ধূনো রেখে গিয়েছে হিমের ছোঁয়ায় শিউলি ফুলের গন্ধ। পাতলা চাদরটা গায়ে জড়িয়ে দেয় কে যেন। আধো-ঘুমে, আধো জাগরণে কানের মধ্যে ঘুরতে থাকে মায়াস্বর। রেডিয়োর ভিতর থেকে কী যেন এক আশ্চর্য প্রাণের ডাক। যাকে কোনওভাবেই এড়ানো যায় না। চোখের সামনে মুহুর্তে ভেসে ওঠে আলোর মধ্যে অতসীবর্ণা দেবী অবয়ব। পুজোর ডাক। যার ডাকের অপেক্ষায় বছরভোর কান পেতে থাকে বাঙালি। এই ছবি প্রতিটা বাঙালির ছোটবেলার গল্প। আট দশকেরও বেশি সময় ধরে যে গল্প একই ধারায় বয়ে চলেছে প্রজন্মে প্রজন্মে।
তখন সবে জন্ম হয়েছে ‘কলকাতা বেতার কেন্দ্রে’র। নিত্য নতুন অনুষ্ঠানে সাজিয়ে তোলার চেষ্টা চলছে। অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন বাণীকুমার , বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, পঙ্কজ মল্লিকরা। নানারকম অনুষ্ঠান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।
সেভাবেই একদিন ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকার সম্পাদক সাহিত্যিক প্রেমাঙ্কুর আতার্থী এক নতুন ভাবনার কথা জানালেন ঘরোয়া আলোচনায়। শ্রী শ্রী চণ্ডীর কাহিনি নির্ভর শ্লোক ও গান সংকলন নতুনভাবে পরিবেশন করার। তার আগেই এই ভাবেই সরস্বতী শীর্ষক একটি সংগীত বিচিত্রা রচনা করেছিলেন বাণীকুমার। ‘বসন্তেশ্বরী’ নামের সেই প্রযোজনা বেশ সফল হয়। সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন রাইচাঁদ বড়াল। সঙ্গীতে ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল।
সেই অনুষ্ঠানই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র উৎস। বানী কুমার রচিত গীতি আলেখ্যটির প্রথম প্রচারিত হয় আশ্বিন ১৩৩৯-এ । বাংলা সন অনুযায়ী ১৯৩২। দিনটা ছিল মহাষষ্ঠী। তখনও পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানের নাম হয়নি। বেতার জগতে শিরোনাম ছিল ‘ প্রত্যুষ প্রোগ্রাম’। ১৯৩৭ থেকে এই অনুষ্ঠানের নাম হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠানটির ঘোষণার বয়ানটিও বাণীকুমারের রচনা।
মহিষাসুরমর্দিনী-রচনা ও প্রবর্তনা— বাণীকুমার
সঙ্গীত-সর্জন— পঙ্কজকুমার মল্লিক
গ্রন্থনা ও স্তোত্রপাঠ— বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র
সঙ্গীতবীথি— মহিষাসুরমর্দিনী
সেসময়ের সেরা সঙ্গীত যন্ত্রীরা অংশ নিয়েছিলেন এই অনুষ্ঠানে। ৯০ মিনিটের অনুষ্ঠানটি হত লাইভ।
প্রধান গায়ক পঙ্কজ মল্লিক, কৃষ্ণ ঘোষ, আভাবতী, মানিকমালা, প্রফুল্লবালা, বীণাপানি, প্রভাবতি ও তখনকার দিনে শ্রেষ্ঠ গায়ক-গায়িকা ছিলেন তাঁরা একক ও কোরাসে অংশগ্রহণ করলেন। পরবর্তী সময়েও চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাটের দশকের বাংলার প্রায় সমস্ত খ্যাতমানা শিল্পীরাই এই মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন।
সারা ভারতে ৩৫টি বেতার কেন্দ্র থেকে 'মহিষাসুরমর্দিনী' অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হত। বহুবার বিতর্ক হয়েছে এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে। পিতৃপক্ষের দিন দেবী বন্দনা, মহালয়ার দিন ৪টে থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত অর্থাৎ পিতৃতর্পণের সময় নিয়ে প্রশ্ন জেগেছে। কখনও বা কায়স্থের চণ্ডীপাঠ, মুসলমান যন্ত্রী বিষয় একাধিক। আবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ রাতারাতি বাতিল করে উত্তমকুমারের ‘ দেবী দুর্গতিহারিণীম’- তবু ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র আবেদন একইভাবে অবিচল থেকেছে মানুষের মনে।