নবনীলাচলের রথযাত্রা

সময়টা চতুর্দশ শতক। ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী নামে এক বাঙালি সন্ন্যাসী গিয়েছেন নীলাচলভূমিতে তীর্থ করতে। তাঁর ইচ্ছে হল দারু দেবকে নিজের হাতে ভোগ রেঁধে খাওয়াবেন।

কিন্তু সেই ইচ্ছে পূরণ করতে গিয়ে পান্ডা এবং সেবাইতদের প্রবল বিরোধীতার মুখে পড়লেন। তাঁর আর শ্রী জগন্নাথকে ভোগ নিবেদন করা হল না। ক্ষোভ-দুঃখ-অপমানে তিনি আমৃত্যু অনশন শুরু করলেন। তিন দিনের দিন ভক্তের কৃচ্ছসাধনে জগন্নাথ দেব স্বয়ং আবির্ভূত হলেন তাঁর কাছে।

ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী আদেশ পেলেন, ‘আমি তোমার হাতে অন্ন সেবা গ্রহণ করার জন্য উদগ্রীব। বঙ্গ দেশ ফিরে যাও। ভাগীরথী তীরে মাহেশ গ্রাম। সেখানে দারুব্রহ্মে সুভদ্রা, বলভদ্র এবং আমাকে প্রতিষ্ঠা কর।’  

মাহেশ ফিরে এলেন সন্ন্যাসী। প্রস্তুতি শুরু করলেন। এক ঝড় বাদলের রাতে ভাগীরথীর ঘাটে ভেসে এল প্রকান্ড নিমকাঠ। তিনি বুঝতে পারলেন এ আসলে দারু দেবের নির্দেশ। জল থেকে কাঠ তুলে মূর্তি গড়া শুরু করলেন তিনি।

আরও একটি গল্প শোনা যায় লোক কাহিনিতে। প্রভু জগন্নাথ মিহিদানা খেতে খুব ভালোবাসতেন। তিনি নিজেই মাহেশের মিহিদানার স্বাদ নিতে পুরী থেকে মাহেশে আসেন। মসিটি খাওয়ার পর দাম দিতে পারেন নি। দোকানী দাম ছাইলে নিজের বাজুবন্ধটি রেখে যান। পরে পুরীর ম্নদিরের সেবাইতরা আবিষ্কার করেন জগন্নাথের একটি বাজুবন্ধ নেই। মাহেশকে ঘিরে জগন্নাথজীর এই কাহিনি ‘বালাবন্ধ পালা’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে লোককথার দুনিয়ায়।

১৭৫৫-তে কলকাতার নিমাইচাঁদ মল্লিক মাহেশের মন্দির গড়ে দেন। যা আজ তীর্থস্থানে পরিনত হয়েছে। ফি বছর এই মন্দিরকে কেন্দ্র করেই জমে ওঠে মাহেশের রথ উৎসব।

চৈতন্য মহাপ্রভুর দ্বাদশ সেবাইতের অন্যতম কমলাকার পিপলাই মাহেশ জগন্নাথ মন্দিরের প্রধান সেবাইত নিযুক্ত হন। রথ উৎসবের সূচনাও তাঁর হাত ধরেই। ৬২৪ বছর ধরে চলে আসছে এই ধারা। এখনও পর্যন্ত তাঁর বংশধররাই এই মন্দিরের সেবার কার্য পরিচালনা করে আসছেন।

মাহেশের বর্তমান রথটি প্রায় ১২৯ বছরের পুরনো। হুগলির দেওয়ান কৃষ্ণচন্দ্র বসু রথটি তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলা নবরত্ন শৈলীতে নয় চূড়া বিশিষ্ট লোহার তৈরি ৫০ ফুটের রথ।  ১২টি লোহার চাকা রয়েছে।  মার্টিন বা বার্ণ কোম্পানি রথটি তৈরি করে। ২০ লক্ষ টাকা ব্যয় হয় রথ নির্মাণে। আগের রথটি মাসির বাড়ি গুণ্ডিচাবিটিতে এক অগ্নিকান্ডে দগ্ধ হয়ে যায়।  

স্নানযাত্রার দিন ২৮ ঘড়া জল আর দেড় মন দুধ দিয়ে তিন বিগ্রহকে স্নান করানো হয়। তারপর জগন্নাথের জ্বর হয়। কবি রাজ আসেন। জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রার অসুখ পর্বে মন্দিরে ভক্ত-সমাগম বন্ধ রাখা হয়। প্রতি বছর জগন্নাথ মাসির বাড়ি যাওয়ার আগে নতুন করে অঙ্গরাগ করা হয় বিগ্রহের। রথ যাত্রার একদিন আগে মন্দির খোলে। নব-কলেবর অনুষ্ঠিত হয়।

সোজা রথে তাঁরা রওনা হন মাসির বাড়ি কুঞ্জবাটিতে।

   চৈতন্যদেব মাহেশের মন্দিরে এসেছিলেন। তিনি মাহেশের নাম দেন ‘নব নীলাচল’।  পুরীর মন্দিরে জগন্নাথ দেবের রথ যাত্রার পরেই মাহেশের রথ যাত্রা। গোটা বাংলার মধ্যে প্রাচীনতম এই উৎসব। লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম হয় শুধু একবার রথের রশি স্পর্শ করার জন্য। এই রথযাত্রায় এসেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ স্বয়ং।  রথ চালানোর জন্য বিউগল কাসর, ঘণ্টা বাজানো হয়। যাত্রা থামে বন্দুকের তোপে।

  

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...